১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী সংঘটিত গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবদের নেতৃত্বে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর বিকেলে ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসিম উদ্দিন বৈঠক সম্পর্কে অবহিত করেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমি পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো উত্থাপন করেছি, যেমন—আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পাঠানো বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া।
’
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমরা বলেছি, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির মাধ্যমে একটি মজবুত, কল্যাণমুখী ও সামনের দিকে তাকানোর সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করি।’
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ গতকালের বৈঠকে তাঁর দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকের পর তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা অনুসন্ধানে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। এসব কাটিয়ে ওঠার উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’
এ সময় অতীতের বিষয়গুলো স্বীকার করে আমনা বালুচ বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে অবশ্যই দুই দেশের মধ্যে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
আমনা বালুচ আরো বলেন, “আমাদের নিজেদের আয়ত্তে বিশাল আন্ত বাজার সম্ভাবনা রয়েছে; এবং আমাদের এটি ব্যবহার করা উচিত।
আমরা প্রতিবার ‘বাস মিস’ করতে পারি না।”
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সার্কের কাঠামোতে পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তিনি সব সময়ই পছন্দ করেন। তিনি বলেন, ‘জনগণের মধ্যে বন্ধন বাড়াতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উচিত দুই দেশের মধ্যে আরো বেশি যুব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিনিময় করা। আমাদের প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে কায়রোতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথা স্মরণ করে বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সার্ক, ওআইসি ও ডি-৮-এর মতো বহুপক্ষীয় ও আঞ্চলিক ফোরামে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবে।
এ সময় এসডিজিবিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ উপস্থিত ছিলেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছিল ২০১০ সালে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ ঐতিহাসিক চারটি দাবি উত্থাপন করেছিল। গতকালের বৈঠকেও বাংলাদেশ এ বিষয়গুলো তুলেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। এর পাশাপাশি ঐতিহাসিক এই দাবিগুলোরও সুরাহা হওয়া দরকার।
গতকালের বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের বাংলাদেশ সফরসূচি চূড়ান্ত হয়েছে। দুই দিনের সফরে তিনি আগামী ২৭ এপ্রিল ঢাকায় আসবেন।
বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়া পররাষ্ট্রসচিব মো. জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতাপূর্ব ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪৩২ কোটি ডলারের বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করেছে। তিনি জানান, ‘বাংলাদেশের আগের একটি হিসাবে ৪০০ কোটি ডলার এবং আরেকটি হিসাবে ৪৩২ কোটি ডলার। এই হিসাব আজকের আলোচনায় বলেছি।’
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। বৈঠকে উভয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে সামনের দিনগুলোতে আরো এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছি। পাকিস্তানের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে বাজারে প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি, বাণিজ্যপ্রক্রিয়া সহজীকরণ, শুল্ক বাধা দূরীকরণ এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানের বিনিয়োগ বৃদ্ধিকরণের জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করার ওপর আমি গুরুত্বারোপ করি। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্যও আলোচনা হয়েছে, যাতে প্রযুক্তি, উন্নত প্রজাতি এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়।’
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল রুট চালু হয়েছে। সরাসরি ফ্লাইট আবার চালু করার মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সংযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়টিও আলোচনা করা হয়েছে।