তাই একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর যথাশিগগির সম্ভব সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। গত ২১ মে ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান তাঁঁর বাহিনীর সদস্যদের কাছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে এই মনোভাব জানান বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
সম্প্রতি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে বিশিষ্টজন ও রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে সরকারের সমালোচনায় আর রাখ-ঢাক নেই। বিশেষ করে গত প্রায় এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের মূল্যায়ন এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, অনির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর সঙ্গে আরো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, আমদানি জটিলতা এবং অর্থনৈতিক নীতির অনিশ্চয়তা। ফলে সরকারি-বেসরকারি খাত নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ প্রবাহ এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারি পরিসংখ্যানে বিনিয়োগ বৃদ্ধির দাবি করা হলেও বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে সেই প্রবাহে রয়েছে বড় ধরনের স্থবিরতা। নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি জবাবদিহিমূলক ও স্থিতিশীল সরকার ছাড়া দেশে টেকসই বিনিয়োগ সম্ভব নয় এমন মত দিচ্ছেন দেশের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তারা। তাঁদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। পাশাপাশি দরকার স্বচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ এবং একটি প্রকৃত অর্থে উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ।
গতকালের ওই সেমিনারে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরো বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার যত দিন ক্ষমতায় থাকবে, সংকট ততই গভীর হবে।’ ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ‘যখন কোনো রাজনৈতিক শক্তি সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হয়, তখনই রাষ্ট্রব্যবস্থায় চরম দুর্বলতা দেখা দেয়। তখনই জরুরি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দেয়, যা কখনো কখনো অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপকে পরবর্তী সরকার কী পরিমাণ বৈধতা দেবে, তা এখনই চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে যেসব সংস্কারকাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা প্রয়োজন। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু নয়, আবার প্রয়োজনের কমও নয়—এমন ভারসাম্যপূর্ণ সংস্কারনীতিই গ্রহণযোগ্য। নইলে আমরা আবারও অসংস্কার প্রক্রিয়ায় ফিরে যাব।’
সেমিনারে ডেমোক্রেসি ডায়াস বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহ আল মামুন ২৬টি দেশে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকাল, সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে একটি গবেষণার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
গবেষণায় দেখা যায়, ২৬টি দেশের মধ্যে ১৬টি দেশেই খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা হয়েছে। এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং দ্রুত সংস্কার কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে।
সেমিনারে আলোচকরা বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সময় দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের সংস্কার কার্যক্রমও কার্যত সময়ক্ষেপণ ছাড়া কিছু নয়।
গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি (পিআর) কতটা বাস্তবসম্মত। এ নিয়ে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখনো এই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নয়। যাঁরা এই পদ্ধতির দাবি তুলছেন, তাঁরা মূলত দলের স্বার্থে কথা বলছেন, দেশের স্বার্থে নয়। অনেকেই মনে করেন, সরকারকে সময় বাড়ানোর সুযোগ দিতেই এই দাবি তোলা হচ্ছে।
এ ছাড়া বক্তারা বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকায় দেশের অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা ও সামগ্রিক পরিস্থিতি দিন দিন ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। তাই দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এ সংকটের সমাধান হওয়া উচিত।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ওই সেমিনারে বলেন, এই সরকারের অনেক সংস্কার কমিশন হয়েছে। সেটা তাদের উল্লেখযোগ্য কাজ। যদিও গঠনের মধ্যে সমস্যা ছিল। কিন্তু সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে শুধু সংবিধান ছাড়া আর কোনো প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মনোযোগ নেই। সংবিধান সংস্কার কমিশন নিয়ে একমাত্র আলোচনা। সেখানে সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজন, যাঁদের একমাত্র আগ্রহ সংবিধানের মধ্যে এমন পরিবর্তন, যাতে তাঁদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া অন্য কোনো দিকে অগ্রগতি নেই।
বিশেষজ্ঞরা আরো যা বলছেন : সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত বছর আগস্টে যখন স্বৈরশাসক পালিয়ে যায়, তখন আমরা সবাই বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে এগোতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, কালো দিনগুলো চলে গেছে, এখন নতুন দিন এসেছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে তো আমরা দেশের সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখি। তাঁর নেতৃত্বের সরকারের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বছরপূর্তিতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, সে প্রত্যাশার খুব অল্প অংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। জনগণের উন্নতি হয় সে ধরনের কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়ছে না। যা চোখে পড়ছে তা হলো, দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কারের সংলাপ। সে সংস্কারও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা আশাহত হয়ে গেছি। এখন এটাও স্পষ্ট, প্রথম দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি যে সমর্থন ছিল, সেটিও আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। অতএব, এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন না দিয়ে এই সরকারের আর কোনো গত্যন্তর নেই। নির্বাচন যত দেরি হবে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ততই অবনতি হবে। এখন এই বাস্তবতা মেনে নেওয়ার সময় এসেছে, ভালো হোক, মন্দ হোক দেশটাকে রাজনীতিবিদদেরই চালাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দিয়ে এই সরকারকে বিদায় নিতে হবে। আর নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য।’
বিষয়টি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আনার বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত। তবে এবারের নির্বাচন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হতে পারে। নির্বাচন হওয়ার আগে এই সরকারের যেসব উদ্যোগ, অর্জন, সুবিধা গ্রহণ সেগুলোর সুরক্ষার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। এই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় যে দল গঠন হয়েছে বলে শোনা যায়, সে দলটির সেটলমেন্টও দরকার। পতিত স্বৈরাচার যাতে না ফিরতে পারে তারও ব্যবস্থা করে যাওয়া প্রয়োজন। এসবের ব্যবস্থা দ্রুত হওয়া দরকার। কারণ, নির্বাচন বিলম্বিত করে এই সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করলে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।’