অনেকের ধারণা, রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে সরকার বেশ আন্তরিক। সরকার সবার মতামতের ভিত্তিতে সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে চায়। সংস্কারের বিষয়ে জনমত তৈরি করার লক্ষ্যে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছে। কারো ওপর চাপিয়ে দিয়ে প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় না সরকার।
সরকারের অবস্থান জানিয়ে ড. ইউনূস বৈঠকে বলেছেন, ‘সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। আমরা কেবল সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি, আমরা শুধু সাচিবিক কাজ করে দিলাম। এটা আমার কাজ নয়, এটা আপনাদের কাজ, যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন।’
প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলছেন, সংস্কার কতটুকু বাস্তবায়ন করা হলো তা নিয়ে সরকার কোনো দায় নিতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর ‘চাহিদা’ অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়ন করা হবে। ফলে যেসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে না, তার দায়ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি জোটের একজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধরা যাক, কোনো ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এই সুপারিশে কোনো দলের দ্বিমত থাকতে পারে। এর বিপক্ষে ওই দলের যাওয়াটাও কঠিন, কারণ ওই মতামত সরকার প্রকাশ করবে। কিছু সুপারিশের বিষয়ে এরই মধ্যে এক ধরনের জনমত তৈরি হয়ে গেছে। ফলে ওই দল কেন ওই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির বিপক্ষে গেল, সেই কৈফিয়ত তাদের দিতে হবে।
অবশ্য রাজনৈতিক দলের কেউ কেউ মনে করেন, কোন দল কী চাইল তা প্রকাশ করা হলে ওই দলের মনোভাবের বিষয়ে জনগণ জানতে পারবে। ভোটাররা কাদের ভোট দেবে সে বিষয়েও তাদের ধারণা তৈরি হবে। এতে স্বচ্ছতা তৈরি হবে।’
ঐকমত্যের প্রয়াস নিয়ে নাম প্রকাশ করে কেউ কোনো নেতিবাচক কিছু বলতে চাইছেন না। নাম প্রকাশ না করে শনিবারের বৈঠকের বিষয়বস্তু তুলে ধরে একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “ওয়েবসাইটে প্রস্তাবগুলো দেওয়া হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে গিয়ে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ চিহ্ন দেবে। কোন কোন দল বেশির ভাগ সুপারিশে ‘হ্যাঁ’ টিক চিহ্ন দিল, আর কোন দল বেশির ভাগ সুপারিশে ‘না’ টিক চিহ্ন দিল, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা আলোচনা হবে। কোন দল কোনটা চাইল তা সবাই দেখতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে? যে কয়েকটি বিষয়ে ন্যূনতম ঐকমত্য হলো সেটুকুই বাস্তবায়ন করা হবে? নাকি সরকার তার মতো সিদ্ধান্ত নেবে? বিষয়টি পরিষ্কার নয়।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের প্রথম সভায় প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদনগুলো নিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার কথা বলেছেন। এরপর একটা ঐকমত্যে পৌঁছার চেষ্টা করা হবে। সেটিই বৈঠকের মূল কথা। আমরা আশা করি, খুব দ্রুত সংস্কার বিষয়ে ন্যূনতম যে ঐকমত্য তৈরি হবে এবং সেটির ওপরে ভিত্তি করে অতি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
বৈঠক থেকে বের হয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি এবং বলেছি, সব ইতিবাচক সিদ্ধান্তে জামায়াতে ইসলামী সমর্থন জানাবে। সরকারের টিমের সঙ্গে আমাদের আলাদা বৈঠক হবে, মতবিনিময় হবে। সেখানেই আমাদের মূল সিদ্ধান্ত জানাব।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে কতটুকু সংস্কার দ্রুত করতে হবে, আর কতটুকু পরে করা যাবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন করবে সরকার। এই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন হবে। ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ছয় মাস।
অর্থাৎ জুলাই সনদ প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসছে না। যদি জাতীয় সনদ তৈরি করতে সময় বেশি লাগে তাহলে ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে। তা ছাড়া সরকারকে বিভিন্ন সংকট যেভাবে মোকাবেলা করতে হচ্ছে এবং সামনে যদি আরো সংকট আসে তাহলে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় বেশি লাগাটা স্বাভাবিক।
বিভিন্ন দলের নেতারা যা বলেন
সংস্কারের সুপারিশের প্রক্রিয়া ও উদ্যোগের বিষয়ে এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, “ভালো যেকোনো উদ্যোগের জন্য সময় দিতে হবে। সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে হবে। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব্যাপক ভিত্তিক আলোচনার প্রয়োজন আছে। তবে প্রশাসনে আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে রেখে সরকারের সফল উদ্যোগ কতটা সফল করা যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংবিধান কোনো গদ্য কিংবা পদ্য নয়। তাই এ নিয়ে সময় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক বলেন, ‘উদ্যোগ ভালো। সরকার কিছু চাপিয়ে দেবে না বলেছে, এটাই বাস্তবতা। দল ও জোটগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে, এটাও ইতিবাচক। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে এমসিকিউ পদ্ধতিতে টিক চিহ্ন দেওয়ার বিষয় নয়। এ জন্য যুক্তি, আলোচনা-সমালোচনা ও ঐকমত্য প্রয়োজন।’
শনিবারের বৈঠকে সরকারের ঐক্য প্রচেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, ‘আপনাদের কোনো আলোচনায়, ছবিতে কোথাও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো অবদান ঠাঁই পায় না। তাহলে কিভাবে জাতীয় ঐকমত্যের জন্য সব দলের সহযোগিতা চান?’
গতকাল কালের কণ্ঠকে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সব দলের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যেগুলো সবারই প্রস্তাব, সেগুলোর আলাদা তালিকা করলে বোঝা যাবে কোন বিষয়ে সব দল একমত। যেসব বিষয়ে ভিন্নমত আছে শুধু সেগুলো নিয়ে আলোচনা হলে সময় বেশি লাগবে না। জটিলতাও কমবে। সরকার দ্রুত নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে পারবে।’