দেশের প্রথম সেনাপ্রধান ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ (বীর-উত্তম) আর নেই। গতকাল রবিবার সকাল পৌনে ৯টায় রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর চার মাস।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার সফিউল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে ভুগছিলেন।
তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন), স্মৃতিক্ষয় (ডিমেনশিয়া), ফ্যাটি লিভার (যকৃতে চর্বি জমা), থাইরয়েডসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন। গত ২ জানুয়ারি থেকে সিএমএইচে ভর্তি ছিলেন তিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিউল্লাহর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। শ্রদ্ধা, গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত স্বজন-পরিবার-সহযোদ্ধাদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)।
শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সেনাবাহিনীতে সফিউল্লাহর অবদান স্মরণ করে বলেন, ‘দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর (কে এম সফিউল্লাহ) অবদান আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ তাঁর বীরগাথা আজীবন চিরকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘বাংলাদেশ অ্যাট ওয়ার’ (১৯৮৯) ও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার ঘটনা নিয়ে ‘ফিফটিনথ অগাস্ট এ ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি’ (২০১৪) নামের দুটি গ্রন্থের রচয়িতা কে এম সফিউল্লাহ। তিনি ১৯৩৫ সালে তদানীন্তন ঢাকা জেলার (বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলা) রূপগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৫৩ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে জেনারেল সফিউল্লাহ ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড ইন কমান্ড থাকাকালে ওই ব্যাটালিয়ন নিয়ে বিদ্রোহ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মেজর সফিউল্লাহ তাঁর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে ‘এস ফোর্স’ নামে একটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করেন এবং সেই ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন। একাধিকবার সম্মুখযুদ্ধেও অবতীর্ণ হন তিনি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণকালে শফিউল্লাহ তাঁর ব্রিগেড নিয়ে ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর-উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের এপ্রিলে প্রথম সেনাপ্রধান হিসেবে সফিউল্লাহকে নিয়োগ দেয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৭৫ সালের পর থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ১৬ বছর মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইডেন ও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন সফিউল্লাহ। ১৯৯২ সালে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন তিনি। ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সফিউল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধে জীবিত সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে ২০০৭ সালে গঠিত সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
সফিউল্লাহ সেনাপ্রধান থাকাকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনা সদস্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যা করে। সে সময় সেনাপ্রধান হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকারের প্রতি আনুগত্যও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই সেনাপ্রধানের পদ হারাতে হয় তাঁকে।
বিতর্কের জবাবে পরে একাধিক সাক্ষাৎকারে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, পরিস্থিতির শিকার ও বাধ্য হয়েই মোশতাক সরকারের প্রতি সমর্থন দিতে হয়েছিল তাঁকে। ১৫ আগস্টের ঘটনায় ‘একক ব্যক্তি’ হিসেবে সেনাপ্রধানের খুব বেশি কিছু করার সুযোগও ছিল না বলেও দাবি করেন সফিউল্লাহ।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কে এম সফিউল্লাহর দাফন
এদিকে গতকাল আইএসপিআর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, গতকাল বিকেল ৪টায় ঢাকা সেনানিবাসের সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদে মরহুম সফিউল্লাহর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন, সাবেক সেনাবাহিনী প্রধানরা এবং ঢাকা ও মিরপুর সেনানিবাসের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। জানাজা শেষে মরহুমের মরদেহ বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে।