‘সেনা কর্মকর্তাদের একটি তালিকা করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে পিলখানায় সহকর্মী সেনা কর্মকর্তাদের পরিকল্পিত ও নৃশংসভাবে হত্যার কয়েক দিন পর ওই বছরের ১ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা যাঁরা কিছু প্রশ্ন করেছিলাম, বিচার চেয়েছিলাম, তাঁদের তালিকা। এই তালিকার প্রথম শিকার আমরা ছয়জন। সহকর্মীদের হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বিচার চাওয়ার অপরাধে কোনো তদন্ত এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে আমাদের বরখাস্ত করা হয়।
প্রশ্ন তুলে হাসিনার রোষানলে শত সেনা
চাকরিচ্যুতি গুম নির্যাতনে জীবন তছনছ
কাজী হাফিজ

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। দাবি উঠেছে ঘটনার পুনঃ তদন্তের।
ভুক্তভোগী আরেক লে. কর্নেল (অব.) মাহদী নাছরুল্লাহ শাহীর, বিপি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পিলখানার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমরা সেনা সদরের অগ্রযাত্রা ভবনের ১১ তলায় এবং সেনাকুঞ্জে ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদের সঙ্গে মিটিং করি। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেনা সদরে আসার জন্য বলার প্রস্তাব এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করার জন্য কিছু প্রশ্ন নির্দিষ্ট করা হয়। দেশর সব সেনানিবাস থেকেও এ বিষয়ে সেনা কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্ন পয়েন্ট সংগ্রহ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে কারা এই প্রশ্নগুলো করবেন তা-ও নির্ধারণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এমআইর (মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) পরিচালক এই প্রস্তাব ও প্রশ্নগুলো নিয়ে যান। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা সেনানিবাসে আসতে সম্মত হন। কিন্তু ওই সব প্রশ্ন উত্থাপন এবং পিলখানা হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত তদন্ত ও বিচার চাওয়ার বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারেননি। আমার ধারণা, ঢাকা ও অন্য সেনানিবাস মিলিয়ে প্রায় ১০০ জনের তালিকা করা হয়েছিল। এঁদের সবাইকে শেখ হাসিনা এবং তাঁর অনুগতদের আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা ছাড়াও অনেকের প্রমোশন বন্ধ করে দিয়ে চাকরির মেয়াদ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
শেখ হাসিনাকে সরাসরি প্রশ্ন করে চাকরি হারিয়েছিলেন এমন একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘১ মার্চের ঘটনায় যাঁদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, তাঁদের সংখ্যা ১০০ জনের কাছাকাছি বলেই জেনেছিলাম।’
যা ঘটেছিল ১ মার্চ : রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে (বর্তমানে বিজিবি) ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঘটেছিল দেশের ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। বিডিআরের একাংশের বিপথগামী সদস্যরা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৮ জন সেনা সদস্যকে (৫৭ জন কর্মকর্তা এবং একজন সৈনিক) হত্যা করেন। নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডে ৫৮টি সেনা পরিবারের মোট ১১০ জন সন্তান পিতৃহীন হয়। চারজনের জন্ম হয় তাদের পিতা নিহত হওয়ার কয়েক মাস পর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছরের ১ মার্চ সেনাকুঞ্জে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে সম্মত হন। সেখানে বিভিন্ন পদমর্যাদার প্রায় দুই হাজার সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাও। বৈঠকে শেখ হাসিনার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তখনকার কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। সেখানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজমের বিতর্কিত অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। অবিলম্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও হুইপকে বরখাস্ত করার দাবি জানানো হয়।
কেন সেনা কর্মকর্তা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, র্যাব ও সেনাবাহিনীকে কেন অভিযান চালাতে দেওয়া হলো না, সেই প্রশ্নও করা হয়। জানানো হয়, সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের নারী সদস্যরাও সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
ওই বৈঠকের অডিও ক্লিপ সে সময় প্রকাশ্যে আসে। সেনানিবাস থেকে ফিরে শেখ হাসিনা সংসদে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ওরা তো দেখি বিএনপির ভাষায় কথা বলে।’
এ বিষয়ে লে. কর্নেল (অব.) মাহদী নাছরুল্লাহ শাহীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আমিও সেদিন শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করার দায়িত্বে ছিলাম এবং প্রশ্ন করি। সে সময় সেনা কর্মকর্তারা নারকীয় ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান।’
লে. কর্নেল (অব.) মো. সামসুল ইসলাম বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে আসা সেনা কর্মকর্তারা বক্তব্য দেওয়ার সময় কান্না আটকাতে পারেননি। এটি অন্যদের মধ্যেও প্রভাব ফেলে। আবেগতাড়িত ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনাও ঘটে। কিন্তু সহকর্মীদের হারানোর বেদনা থেকে স্বাভাবিক এই ক্ষোভ প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের চরম মাসুল দিতে হয়।
প্রথমে যাঁদের বরখাস্ত করা হয়েছিল : প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ২০০৯ সালের ৭ জুনের প্রজ্ঞাপন (নং প্রম/সাঃস/বর/০৯/ডি-১৮/১৫৩) থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১ মার্চের ঘটনায় বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট সেকশন-১৬, আর্মি অ্যাক্ট (রুলস) ৯এ, আর্মি রেগুলেশনস (রুলস) ৭৮(সি), ২৫৩(৩), ২৫৪ অ্যাপেনডিক্স জি, ২৬৯-এ এবং ২৬১ ধারা মোতাবেক ছয়জনকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। প্রজ্ঞাপনে তাঁদের পরিচয় জানানো হয়—(১) বিএ-৩১৩২ লে. কর্নেল মো. সামসুল ইসলাম, পিএসসি, আর্টিলারি, (২) বিএ-৩৩৬০ লে. কর্নেল মাহদী নাছরুল্লাহ শাহীর, বিপি, পদাতিক, (৩) বিএ-৩৫৬৩ লে. কর্নেল মো. শফিউল হক চৌধুরী, পিএসসি, সিগন্যালস, (৪) বিএ-২৬১৭ মেজর মো. মোহসিনুল করিম, পদাতিক, (৫) বিএ-৬৪১১ ক্যাপ্টেন হাবিবা ইসলাম ইঞ্জিনিয়ার্স এবং (৬) বিএ-৬৫৬০ ক্যাপ্টেন এ কে এম আন্নুর হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার্স।
পরে ২০১০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ও ২ মে বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে পাঁচজনকে অকালীন অবসর দেওয়া হয়।
এই বরখাস্তের ঘটনাটি সে সময় উইকিলিকসের ফাঁস করা ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের তারবার্তাগুলোর একটিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। ওই তারবার্তায় সাতজনকে বরখাস্ত করার কথা বলা হয়।
বিষয়টি সম্পর্কে লে. কর্নেল (অব.) মাহদী নাছরুল্লাহ শাহীর বলেন, ‘প্রথমে আমাদের ছয়জনকেই বরখাস্ত করা হয়েছিল। আমরা পাঁচজন আমাদের বরখাস্তের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু মোহসিনুল করিম স্যার সম্ভবত আবেদন করেননি।’
কথিত হত্যাচেষ্টায় পাঁচজনের সশ্রম কারাদণ্ড : ২০০৯ সালের ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় মতিঝিলে বাংলার বাণী কার্যালয়ের সামনে শেখ ফজলে নূর তাপসের গাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। প্রচার হয়, গাড়িতে দূরনিয়ন্ত্রিত (রিমোট কন্ট্রোলড) বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে ১৩ জন আহত হয়েছেন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তাপস। এ ঘটনায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে মেজর ডালিমের ভাই কামরুল হক স্বপন, মেজর (অব.) বজলুল হুদার ভাতিজা আতাউল হুদা, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিনের দুই ছেলে নাজমুল হাসান সোহেল ও মাহাবুবুল হাসান ইমরান, কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদ খন্দকারের মেয়ে মেহেনাজ রশিদ এবং ফ্রিডম পার্টির সদস্য আবদুর রহিমসহ মোট আটজনকে গ্রেপ্তার ও এজাহার নামীয় আসামি করা হয়। পরে ডিবি পুলিশ ওই ঘটনা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের জেরে ঘটে থাকতে পারে বলে তাদের সন্দেহের কথা জানায়। এরপর কর্তব্যরত অবস্থায় উঠিয়ে নেওয়া হয় সেনাবাহিনীর পাঁচ কর্মকর্তা মেজর হেলাল, মেজর রেজাউল করিম, ক্যাপ্টেন রাজিব, ক্যাপ্টেন ফুয়াদ ও ক্যাপ্টেন খান সুবায়েল বিন রফিককে। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় এক বছর আটক অবস্থায় রেখে তাপসকে হত্যাচেষ্টায় তাঁদের সংশ্লিষ্টতার স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চালানো হয়। এরপর তাঁদের বরখাস্ত করে সামরিক আদালতে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। কারাভোগ শেষে এই পাঁচ সেনা কর্মকর্তা মুক্তি পান ২০১৪ সালের এপ্রিলে। শুরু হয় একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় জীবন-জীবিকার প্রাণান্তকর লড়াই। এদিকে তাপসকে হত্যাচেষ্টার মামলায় পুলিশ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। পুলিশ আদালতে দাখিল করা তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদনগুলোতে বহু বছর ধরে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে এলেও গত ১৮ সেপ্টেম্বর এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এতে এজাহার নামীয় আটজন আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর মো. স্বপন মিয়া এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এ ঘটনার ভুক্তভোগী সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন খান সুবায়েল বিন রফিক বর্তমানে মালয়েশিয়াপ্রবাসী। এরই মধ্যে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পিলখানা হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর অনুগতদের অন্যায় আদেশ না মানার কারণেই আমাকে ও আমার সহকর্মীদের তাপসের ওপর কথিত বোমা হামলার দায় চাপানো হয়।
আরেক ভুক্তভোগী রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাকে যখন তুলে নেওয়া হয়, সে সময় আমি সদ্য মেজর পদে পদোন্নতি পেয়েছি, কিন্তু র্যাংক ব্যাজ পরার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়নি। আটকে রেখে আমাকে এই স্বীকারোক্তি দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয় যে তাপসের ওপর বোমা হামলা হয়েছে তারেক রহমানের পরিকল্পনায়। শেখ হাসিনার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম—এঁরা এ বিষয়ে তৎপর ছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হইনি।’
তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে খান সুবায়েল বিন রফিক বলেন, ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের চার মাস পর বিডিআরে আমার পোস্টিং হয়। সে সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে বিচারের লক্ষ্যে একাধিক তদন্ত চলমান ছিল। সেনাবাহিনী ও র্যাবের পক্ষ থেকেও তদন্ত চলে। পুলিশের পক্ষ থেকে চলা তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন আবদুল কাহার আকন্দ ও মনিরুল ইসলাম। আর বিডিআরের অভ্যন্তরীণ তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। আমার দায়িত্ব ছিল সব তদন্ত কমিটির মধ্যে সমন্বয় করা। সে কারণে আমার কাছে বিভিন্ন প্রতিবেদন আসে। ২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর বিডিআরের তৎকালীন ডিজি মইনুল ইসলাম ও আমাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে ডাকেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তদন্তের রিপোর্ট পেশ করি। এতে ব্যারিস্টার তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম—এঁদের নাম ছিল। উনি রিপোর্টটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিশেষ ইনস্ট্রাকশন অনুসারে কাজ করতে বলেন। মইনুল ইসলাম আমাকে বলেন, রিপোর্টে যেন কোনো রাজনৈতিক নেতার নাম না আসে, পুলিশের রিপোর্টের ভিত্তিতেই সব কিছু করতে হবে, সেনাবাহিনী ও র্যাবের রিপোর্টের ভিত্তিতে কিছু করা যাবে না। এরপর আবারও আমাদের দুজনকে প্রধানমন্ত্রী ডাকেন। সেদিনও ‘ইনস্ট্রাকশন’ অনুসারে কাজ না হওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। এরপর আমাকে পিলখানা থেকে তুলে নেওয়া হয়। ৩৬১ দিন ডিজিএফআইয়ে রাখা হয় আমাকে। পরে কারাগারে। ওই বছরের ১ মার্চও সেনা সদরে শেখ হাসিনাকে যাঁরা প্রশ্ন করেন, সহকর্মীদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তাঁদের তালিকায়ও আমাদের নাম ছিল।’
তাপসের ওপর বোমা হামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমরা আমাদের কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করছিলাম। আমাদের তিনজনের পোস্টিং ছিল পিলখানায় বিডিআর হেডকোয়ার্টার্সে। পরে জেনেছি, গাড়ির এসি বিস্ফোরণকে বোমা বিস্ফোরণ বলে চালানো হয়।’
খান সুবায়েল বিন রফিকদের ওপর অমানবিক আচরণের বিবরণ বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের কাছে একাধিকবার তুলে ধরেন তাঁদের স্বজনরা। সর্বশেষ ২০১১ সালের ৯ মে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তাঁরা জানান, তদন্তের নামে ২০১০ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে এই সেনা কর্মকর্তাদের দীর্ঘ এক মাস চোখ ও হাত বেঁধে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন ও প্রাণনাশের ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এ অবস্থায় তাঁদের উত্কণ্ঠিত পরিবারের সদস্যরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করে জানতে পারেন, তাঁদের ওপর আনা বোমা হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্বীকার না করা পর্যন্ত বিশেষ সেলে তদন্ত অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চলবে। এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ব্যারিস্টার তাপসের ওপর কথিত বোমা হামলার ঘটনা দেখিয়ে ২০১০ সালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদে শেখ পরিবারের জন্য আজীবন এসএসএফ নিরাপত্তা বিল পাস করে।
প্রতিকার চেয়ে আবেদন : সাবেক সেনা কর্মকর্তা রেজাউল করিম ও ড. খান সুবায়েল বিন রফিক শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত আগস্টেই সেনাপ্রধানের কাছে পৃথকভাবে তাঁদের প্রাপ্য সুবিধা ও সম্মান পুনরুদ্ধার চেয়ে আবেদন করেছেন। অন্যরাও এই আবেদন করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। ড. খান সুবায়েল বিন রফিক বলেন, ‘বর্তমান সেনাপ্রধান সব তথ্য-প্রমাণ যাচাই করে সামরিক আদালত থেকে আমাদের যে দণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তা পুনর্বিবেচনা করবেন বলে আশা করছি।’
গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত এক সেমিনারে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সশস্ত্র বাহিনী থেকে চাকরি হারানো ২৩০ জন কর্মকর্তার পক্ষে তাঁদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া অথবা ক্ষতিপূরণের দাবি জানানো হয়। রাওয়া রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডি ফোরাম (আরআরএসএফ) আয়োজিত ‘জুলাই-আগস্ট-২০২৪ বিপ্লবে সশস্ত্র বাহিনীর অবদান এবং বিপ্লবোত্তর ভূমিকা’ শীর্ষক ওই সেমিনারে জানানো হয়, এ বিষয়ে আবেদনকারী ২৩০ জন কর্মকর্তার মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৮৫ জন এবং নৌবাহিনীর ৪৫ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের আবেদন ও তালিকা গত ১ সেপ্টেম্বর সেনা সদরের সেন্ট্রাল রেকর্ড অফিসে জমা দেওয়া হয়েছে। একই আবেদন ও তালিকা গত ৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবরও জমা দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গত রবিবার আওয়ামী লীগ শাসনামলে অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত সশস্ত্র বাহিনীর (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী) সদস্যদের প্ল্যাটফরম ‘সহযোদ্ধা’র পক্ষ থেকে চাকরিতে বহাল অথবা ক্ষতিপূরণসহ তিন দফা দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক সাবেক সেনা কর্মকর্তা নাইমুল ইসলাম বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ৩০০ সদস্যকে বিগত সরকার অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করেছে। সে কারণে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা চাই আমাদের যৌক্তিক এই দাবিগুলো মেনে নেওয়া হোক।’
সহকর্মীদের কফিনের সামনে তৎকালীন তিন বাহিনী প্রধান এবং স্বজনের কান্না। —ফাইল ছবি
সম্পর্কিত খবর

মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৪৮%, বেড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি
নিজস্ব প্রতিবেদক

বহুদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা। প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে। তবে অবশেষে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে ৮.৪৮ শতাংশে, যা গত ৩৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে এই চিত্র উঠে এসেছে। ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.০৫ শতাংশ, জুনে তা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
মূল্যস্ফীতির এই পতন দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তির বার্তা বয়ে আনলেও বাজারের বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
খাদ্যমূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে
বিবিএসের ভোক্তা মূল্যসূচক অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুনে নেমে এসেছে ৭.৩৯ শতাংশে, যা মে মাসে ছিল ৮.৫৯ শতাংশ।
তবে বাজারের চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ঢাকার খুচরা বাজারে মিনিকেট চালের দাম বেড়ে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা/কেজিতে পৌঁছেছে, যেখানে ঈদের আগে তা ছিল ৭২ থেকে ৮২ টাকা। মাঝারি মানের চাল ব্রি‑২৮ এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৪ টাকা কেজি দরে, যা আগের তুলনায় তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন সবজির দাম ৭০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।
আয় বেড়েছে কম, ব্যয় বেড়েছে বেশি
মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে এক ধরনের ‘অদৃশ্য কর’-এর মতো। বিশেষ করে মজুরিনির্ভর মানুষের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে। বিবিএসের তথ্য মতে, জুনে জাতীয় মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.১৮ শতাংশে, কিন্তু একই সময়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮.৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ আয় বৃদ্ধির চেয়ে ব্যয় বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় প্রকৃত আয় কমেছে।
প্রবৃদ্ধিতে ফিরছে গতি
মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) স্থির মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪.৮৬ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৪.৪৮ শতাংশ।
তবে পুরো অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) প্রথম তিন প্রান্তিক মিলিয়ে গড় প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৮১ শতাংশ। এই ধীরগতির প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সতর্কবার্তা আগেই দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বিশ্বব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৩ শতাংশ, আর এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী এটি ৩.৯ শতাংশ।
প্রবৃদ্ধির খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাত কিছুটা উন্নতি করলেও গতি কমেছে শিল্প খাতে। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.৪২ শতাংশ, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৪ শতাংশ। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.৯১ শতাংশে, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৭.১০ শতাংশ। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক ভালো—৫.৮৮ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৪.৩১ শতাংশ। চলতি মূল্যে এই প্রান্তিকে জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি পরিসংখ্যান বলছে মূল্যস্ফীতি কমেছে, প্রবৃদ্ধিও কিছুটা বাড়ছে। তবে বাজারে এর প্রতিফলন নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী, মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে, ফলে মানুষের বাস্তব আয়ে ঘাটতি রয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
শেখ হাসিনা-কামালকে অব্যাহতির আরজি মামুনের বক্তব্য নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক উপাদান (প্রাইমা ফেসিয়া) পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্র নিযু্ক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। মামলার অভিযোগ থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানান তিনি।
এ সময় আদালতে উপস্থিত আরেক আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেননি এবং অভিযোগ থেকে তাঁর অব্যাহতিও চাওয়া হয়নি।
গতকাল সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ অভিযোগ গঠনের শুনানি চলাকালে আমির হোসেন ওই আরজি তুলে ধরেন।
শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল আগামী ১০ জুলাই আদেশের তারিখ ধার্য করেন। এর আগে গত ১ জুলাই মামলার ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের’ ওপর শুনানি শেষ করে প্রসিকিউশন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন : দাবি আইনজীবীর
অব্যাহতির আবেদনের শুনানিতে আমির হোসেন প্রসিকিউশনের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, গত বছর ১৪ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা রাজাকারের নাতি-পুতি বলে উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য দেননি। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। সেই জবাবেও তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা রাজাকারের নাতি-পুতি বলেননি।
আন্দোলনে নিহতদের মৃত্যু সনদে মৃত্যুর সঠিক কারণ লিখতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, মৃতদেহ হস্তান্তর না করে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গণদাফন, লাশ গুম করে ফেলার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মনগড়া বলে উল্লেখ করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী। তিনি বলেন, এসব অভিযোগের দালিলিক কোনো প্রমাণ নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানিতে প্রসিকিউশন বলেছিল, জুলাই গণ-আন্দোলন চলার সময় বিটিভি ভবন, মেট্রো রেলসহ কেপিআইভুক্ত (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়েছে। এই অভিযোগও অস্বীকার করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় গত বছর ১৬ জুলাই রংপুরে গুলিতে শহীদ হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এই হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধ প্ররোচনা, সহায়তা ও ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অস্বীকার করে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ আবু সাঈদের মা-বাবা, ভাই-বোনদের গণভবনে এনে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন। ফলে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।
গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এই আইনজীবী বলেন, আন্দোলনের সময় পুলিশ মানুষের জানমাল রক্ষার স্বার্থে দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আন্দোলনে বহু মানুষ হতাহত হওয়ার নজির আছে। কিন্তু এর জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে কোনো দেশ বিচার করেছে—এমন নজিরও নেই।
জুলাই গণ-আন্দোলনে আসামিদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটিকে মিথ্যা দাবি করে আমির হোসেন বলেন, গণ-আন্দোলনের সময় এবং সরকার পতনের পরে দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালানো হয়েছে, থানা লুট করা হয়েছে। এমনকি পুলিশ হত্যা করা হয়েছে। ফলে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মনগড়া। পরে তিনি অভিযোগ থেকে তাঁদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানান।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ১৪ আগস্ট সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়। তদন্ত শুরু হয় গত বছর ১৪ অক্টোবর। ছয় মাস ২৮ দিনে তদন্ত শেষে গত ১২ মে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ব্যপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। গত ১ জুন প্রসিকিউশন ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিল করলে তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

মানবতাবিরোধী অপরাধ
চলতি বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলার বিচার
মেহেদী হাসান পিয়াস

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, এর মধ্যে অন্তত চারটি মামলার বিচারকাজ চলতি বছর শেষ হতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। চারটি মামলার অভিযোগই আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। তবে মামলার তদন্ত ও বিচারে সময় নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে ভুক্তভোগী এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের।
চার মামলায়ই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। তিনিসহ এই চার মামলায় মোট আসামি ৫৭ জন। তাঁদের মধ্যে পলাতক ৪১ জন। গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে ১৬ জনকে।
এ ব্যাপারে প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চারটি মামলা আনুষ্ঠনিক অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। তার মধ্যে দুটি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করলে বিচার হবে। অভিযোগ থেকে আসামিদের অব্যাহতি দিলে মামলা ওইখানেই শেষ।
বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে আইনি বিধান তুলে ধরে এই প্রসিকিউটর বলেন, ‘আইনে আছে, অভিযোগ গঠনের পর বিচার শুরু হলে তা চলবে বিরতিহীনভাবে। কোনো পক্ষ মুলতবির আবেদন করতে পারবে না।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় বা তদন্ত সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দিতে হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে মামলা হিসেবে তা নথিভুক্ত করে তদন্ত সংস্থা। এরপর অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই, পর্যালোচনা করে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। পরে এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ করে তা আমলে নিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর। অভিযোগ আমলে নেওয়া হলে আসামিদের বিরুদ্ধে ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যে চার মামলার অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থান চলার সময় পরিকল্পিতভাবে ড্রোন, হেলিকপ্টার, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্মূলের অভিযোগ রয়েছে একটি মামলায়। মামলাটি ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দায় বা ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এই মামলার আসামি। তাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে রাখা হয়েছে। অন্য দুজন পলাতক। এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর উভয় পক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ১০ জুলাই আদেশের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ঘটনা ও অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় বাকি তিনটি মামলাও বেশ আলোচিত।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলাটিকে ‘আবু সাঈদ হত্যা মামলা’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। গত ৩০ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১০ জুলাই এ মামলায় পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। এ মামলার ৩০ জন আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার চারজন। বাকি ২৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলাটিকে বলা হচ্ছে ‘চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ড’ মামলা। সরকার পতনের আন্দোলন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন ছয় তরুণ। গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশ তাঁদের গুলি করে হত্যা করে। সেদিন শহীদ হন শাহরিয়ার খান আনাস, শহীদ শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, শহীদ মো. ইয়াকুব, শহীদ মো. রাকিব হাওলাদার, শহীদ মো. ইসমামুল হক ও শহীদ মানিক মিয়া। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ছয় মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে গত ২০ এপ্রিল প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এটিই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। গত ২৫ মে এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। গত ৩ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি শেষ হয়। আগামী ১৪ জুলাই এ বিষয়ে শুনানির তারিখ ধার্য করা রয়েছে। মামলার আট আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে চারজনকে।
আশুলিয়ায় মৃতপ্রায় একজন ও পাঁচজনের লাশ পোড়ানোর মামলাটি ‘লাশ পোড়ানোর’ মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গত ১৯ জুন চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় তদন্ত সংস্থা। গত ২ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেদিনই তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার ১৬ জন আসামির মধ্যে ট্রাইব্যুনালে ১১ জনের নাম প্রকাশ করে প্রসিকিউশন। এই ১১ জনের মধ্যে আটজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে।
প্রত্যাশার সঙ্গে আছে হতাশা
মামলার তদন্তকাজ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করলেও বিচার নিয়ে আশাবাদী শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা এই বিচারটা দেখতে পাব এবং ন্যায়বিচার পাব। কিন্তু তদন্তেই দীর্ঘ সময় লাগল। তার পরও বলতে চাই, যারা আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের সবার বিচার চাই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কাউকে যেন এ মামলায় যুক্ত না করা হয়।’
শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় দেশ পলিটেকনিক কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হাসান আলভীর। পরে ১৯ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন শহীদ আলভীর বাবা মো. আবুল হাসান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘অভিযোগটি কী পর্যায়ে আছে, জানি না। গত সপ্তাহেও আমি প্রসিকিউশনে গিয়েছিলাম। গেলে শুধু একটা কথাই বলে, কাজ করছি, বিচার হবে। কিন্তু আদৌ বিচার হবে কি না—জানি না। আসামিরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে আমরা হতাশায় ভুগছি।’
মামলার বাদী এবং শহীদ পরিবারগুলোর জন্যও বিশেষ নিরাপত্তার দাবি জানান আবুল হাসান।
প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, এই অভ্যুত্থানের সময় দেশজুড়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে ২৭টি পর্যন্ত মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার এসএসসির ফল প্রকাশের প্রস্তাব
নিজস্ব প্রতিবেদক

আগামী ১০ জুলাই বৃহস্পতিবার এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রস্তাব করেছে আন্ত শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি। এরই মধ্যে এই প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে সম্মতি পেলে ফল প্রকাশ করা হবে।
আন্ত শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহবায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী ১০ জুলাই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাধারণত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা হয়ে থাকে। গত ১০ এপ্রিল সারা দেশে একযোগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়।
জানা গেছে, এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন। এর মধ্যে সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার ১৪২ জন। অন্যদিকে মাদরাসা বোর্ডের অধীন দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে দুই লাখ ৯৪ হাজার ৭২৬ জন। আর কারিগরি বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৩১৩ জন।