ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগ আমলের দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের খবর বের হচ্ছে একে একে। শুধু মন্ত্রী আর এমপিই নন, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা আমলা, পুলিশ, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, ছাত্রনেতা, ব্যবসায়ীসহ কমবেশি সব শ্রেণি-পেশার মানুষই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিলেন। এই রকম বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২২ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির কর ফাঁকি এবং মুদ্রাপাচারের তদন্ত শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। সন্দেহে থাকা প্রভাবশালী ২২ জনের নামের তালিকা কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
প্রভাবশালী ২২ জন কর গোয়েন্দাজালে
মো. জাহিদুল ইসলাম

তালিকার ব্যক্তিরা হলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, শেখ পরিবারের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, দুই ভাই শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান, সিরাজগঞ্জের এমপি শফিকুল ইসলাম এবং কিশোরগঞ্জের এমপি ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।
তালিকায় আরো আছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র, পরিবহন শ্রমিক নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা, পরিবহন নেতা ও এনা পরিবহনের মালিক কাজী এনায়েত উল্লাহ, দুদকের দুই প্রসিকিউটর খুরশীদ আলম ও মোশারফ হোসেন কাজল এবং ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি লিয়াকত শিকদার।
সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ব্যবসায়ী জান্নাত আরা হেনরী, বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের দুই পুত্র আসাদুল আলম মাহির ও আশরাফুল আলম আছেন এই তালিকায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক দুই প্রধান প্রকৌশলীও আছেন এই তালিকায়। তাঁরা হলেন আশিকুর রহমান ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতিগ্রস্ত শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির অনিয়মের তদন্তে একযোগে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি, এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) এবং বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ মুহূর্তে সংস্থাগুলোর টেবিলে অন্তত ৫০০ ব্যক্তির ফাইল রয়েছে।
এনবিআর সূত্রে আরো জানা গেছে, এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিপুল কর ফাঁকি ও অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের নামে জমি, বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ স্থাবর সব সম্পত্তির আয়কর নথি এবং তাঁদের বাস্তব সম্পত্তির সরেজমিন তদন্ত করা হবে।
২০০৭ সালে ১/১১-এর সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের আমলে সিআইসির ব্যাপক তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। তখন আতঙ্কে দুর্নীতিবাজদের অনেকেই রাস্তায় গাড়ি ও টাকার ব্যাগ ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সে সময়েও সিআইসি সরেজমিনে কোনো তদন্ত করেনি। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়েছিল।
জানা গেছে, গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এনবিআরের কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগের পৃথক গোয়েন্দা ইউনিট থাকলেও আয়কর অনুবিভাগের কোনো গোয়েন্দা ইউনিট ছিল না। সর্বশেষ গোয়েন্দা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট চালু করে এনবিআর। এ ছাড়া এনবিআরের তিনটি অনুবিভাগের সমন্বিত গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে সিআইসি।
অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের অনুমোদন পাওয়ার পর এখন অনুসন্ধান চালাবেন আয়কর গোয়েন্দা। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সিআইসি ও আয়কর গোয়েন্দার কাছে এই মুহূর্তে প্রায় দেড় শ ব্যক্তির তালিকা রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে প্রতিনিয়তই তালিকা করা হচ্ছে। একটি তালিকা বা দুটি তালিকাই চূড়ান্ত নয়। তালিকায় দেখা গেছে এমন অনেকের নাম বাদ পড়তে পারে। এটা একটা নিয়মিত প্রক্রিয়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আয়কর গোয়েন্দার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যে নামের তালিকা এসেছে তাদের নিয়ে কাজ শুরু করা হবে। আয়কর গোয়েন্দার কাজের ধরন অনেকটা সিআইসির মতোই হবে। তারা তিনটি ইউনিট নিয়ে কাজ করে, আমরা শুধু আয়কর ফাঁকি নিয়ে কাজ করব।’
এর আগে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের দুই ছেলেকে ৫০০ কোটি টাকার অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার সঙ্গে তৎকালীন কর কমিশনার সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদসহ ছয়জন কর কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন বলে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন আয়কর গোয়েন্দা। সংস্থাটির কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুর রকিবের তৈরি সেই প্রতিবেদনের আলোকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল তিনজন কর্মকর্তাকে।
কর ফাঁকির তদন্তে তোড়জোড় শুরু হলেও এই নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্ত আসলে ধরার জন্য করে নাকি সময় কাটানোর জন্য করে; উদ্দেশ্য কী? সেটা বোঝা মুশকিল। তদন্ত করে করে এ দেশে বহু সময় পার হয়ে গেল। খালেদা জিয়ার আমল গেল, মঈনের আমল গেল, হাসিনার এত বছর গেল; তদন্ত করে ধরতে না পারলে কী তদন্ত এগুলো? একসময় খালেদা জিয়া তাঁর সুবিধাজনকভাবে কাজ করাত। খালেদা জিয়া চলে গেল। হাসিনা তার সুবিধা অনুযায়ী হাসিনাগিরি করেছে। এখন প্রফেসর সাহেব (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) আসছেন, উনি তাঁর সুবিধা অনুযায়ী প্রফেসরগিরি করবেন। সময় বদলে গেলে তদন্ত ওভাবেই হবে।’
এনবিআরের সাবেক সদস্য ও সিআইসির সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আমিনুল করিম কলের কণ্ঠকে বলেন, ‘আয়কর গোয়েন্দা এখন যে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকি প্রমাণিত হলে কেস রিওপেন হবে। রিওপেন হয়ে আবার নতুন করে নোটিশ দিয়ে তার ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে নতুন করে কর আরোপ হবে, জরিমানা হবে। তথ্য গোপন ও আয় গোপনের জন্য জেলের বিধানও আছে। সে ব্যবস্থাও এনবিআর নিতে পারে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পটপরিবর্তনের আগে এনবিআরসহ অন্যান্য সংস্থা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যারা উচ্চ করদাতা তারা যে কর ফাঁকির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছে, অন্যায় করেছে, অপরাধ করেছে, সে জন্য তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ যারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে তাদের ফাইল পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে তারা কিসের বিনিময়ে এই বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে।’
তালিকায় থাকা সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে টাকা লুটপাট, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখলদারিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। দুই সিটির প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলদারি, সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন মার্কেট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল ছাড়াও নগর ভবনের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। দুদকের দুই প্রসিকিউটরের বিরুদ্ধেই রয়েছে দুর্নীতির তদন্তে হস্তক্ষেপ এবং অর্থের বিনিময়ে রফাদফা করার ভয়াবহ অভিযোগ। এস আলমের দুই ছেলে আসাদুল আলম মাহির ও আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, ব্যাংক দখল ও অর্থপাচারের অভিযোগ আছে।
সাদামাটা গৃহবধূ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদে সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ বাগিয়ে নিয়ে আলাদিনের প্রদীপের মতো ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় জান্নাত আরা হেনরীর। মাত্র তিন বছরেই অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যান। এরপর দলীয় পদ-পদবির পাশপাশি বাড়তে থাকে সম্পদের পরিধিও। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর নিজের স্বামীকেও বানান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। হলমার্কের চার হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম আসে সবার আগে।
পরিবহন নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা ও কাজী এনায়েত উল্লাহ ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবহন খাতের ভ্যানগার্ড। কারণে-অকারণে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাড়িয়েছেন বাসের ভাড়া। ঘাটে ঘাটে খুলে বসেছিলেন চাঁদাবাজির দোকান। গত ১৫ বছরে শুধু এনায়েতের পেটেই গেছে ১১ হাজার কোটি টাকা। সাংবাদিকতার আড়ালে সরকারের তোষামোদি করে বিভিন্ন সুবিধা ও পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন নাঈমুল ইসলাম খান, শ্যামল দত্ত ও মনজুরুল আহসান বুলবুল।
সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী ছিলেন পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। দুই দফা বাড়ানো হয় তাঁর চাকরির মেয়াদ। সম্পদের হিসাবে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন পুলিশের আরেক বিতর্কিত কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদকেও। সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অন্তহীন অভিযোগ।
সম্পর্কিত খবর

মার্কিন দূতকে প্রধান উপদেষ্টা
বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার। সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের মাটি থেকে সন্ত্রাসীদের উচ্ছেদ করব।
৪০ মিনিটব্যাপী ওই বৈঠকে তাঁরা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন, যার মধ্যে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান শুল্ক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স জ্যাকবসন বাংলাদেশের সংস্কার প্রচেষ্টা ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রতি তাঁর সরকারের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন, যা আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া কমিশনের অগ্রগতির কথাও তুলে ধরেন, যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মূল সংস্কারগুলোর বিষয়ে ঐক্য গঠনে সচেষ্ট।
তিনি আরো বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কমিশন খুবই ভালো কাজ করছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সদস্যরা কঠোর পরিশ্রম করছেন।’

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি
আরো এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু, বার্নে ভর্তি ৩৩
নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আরেক শিশু শিক্ষার্থী মারা গেছে। এতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪ হলো।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সর্বশেষ মারা যাওয়া শিক্ষার্থী সাহিল ফারাবি আয়ান (১৪)। ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির এই ছাত্র গত রবিবার রাত পৌনে ২টার দিকে মারা যায়।
এদিকে গতকাল চলমান ছুটি আরো তিন দিন বাড়িয়েছে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে তৃতীয় দফায় ছুটি বৃদ্ধি করা হলো।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন আয়ানের শরীরের ৪০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। দুর্ঘটনায় দগ্ধ ৩৩ জন এখনো বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে ২৭ জনই শিশু। তাদের অনেকের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক।
বার্ন ইনস্টিটিউটে সংকটাপন্ন তিনজন : দগ্ধ তিনজন বর্তমানে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছে। এর মধ্যে একজন লাইফ সাপোর্টে। তুলনামূলকভাবে একটু কম গুরুতর, অর্থাৎ সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে রয়েছে ৯ জন। গতকাল বিকেল ৩টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন।
ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, আজ আরো তিনজনকে ছুটি দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। তবে আবহাওয়া খারাপ থাকায় এবং তাদের আরেকটি ড্রেসিং দরকার মনে করায় ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। তবে চলতি সপ্তাহে আরো বেশ কয়েকজনকে ছাড়পত্র দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, চীন ও ভারত থেকে আসা চিকিৎসকরা পর্যায়ক্রমে নিজ নিজ দেশে চলে গেছেন এবং অন্যরা চলে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৪৫ : দগ্ধদের মধ্যে ৪৫ জন বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ৩৩ জন, ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১১ জন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে একজন রয়েছে।
সকাল থেকে সেবাপ্রার্থীদের আনাগোনা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল ফটকে টানানো হয়েছে অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পের ব্যানার। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর চিকিৎসকরা সেখানে বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছেন। গতকাল সকাল ৯টা থেকে চালু করা হয়েছে অস্থায়ী এই সেবামূলক কার্যক্রম। মেডিক্যাল টিম সূত্রে জানা যায়, তাদের এই সেবা কার্যক্রম চলবে সপ্তাহজুড়ে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত আগতদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। ১৫ সদস্যের এই মেডিক্যাল ক্যাম্পে দুজন চিকিৎসক আছেন। মূলত দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক ও শারীরিক সহায়তা দেওয়া এই ক্যাম্পের প্রধান লক্ষ্য। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনে চালু করা হয়েছে এই চিকিৎসাসেবা।
মেডিক্যাল ক্যাম্পের চিকিৎসক শিহাব আলী বলেন, ‘সকাল থেকে অনেক রোগী আসছে। তাদের ড্রেসিং করার পাশাপাশি বিনামূল্যে ওষুধ দিচ্ছি। আবার অনেকে মানসিক ট্রমা নিয়ে আসছে। তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’
তৃতীয় দফা ছুটি বাড়াল মাইলস্টোন
স্কুল ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বন্ধ রয়েছে রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। চলমান ছুটি আরো তিন দিন বাড়িয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে তৃতীয় দফায় প্রতিষ্ঠানটির ছুটি বৃদ্ধি করা হলো।
গতকাল সোমবার বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির ভাইস-প্রিন্সিপাল (প্রশাসন) মো. মাসুদুল আলম ছুটি বৃদ্ধির বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, তৃতীয় দফায় আরো তিন দিন মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার (২৯, ৩০ ও ৩১ জুলাই) ছুটি ঘোষণা করেছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ী স্থায়ী ক্যাম্পাস। আগামী রবিবার (৩ আগস্ট) খুলবে প্রতিষ্ঠানটি।
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর প্রথম দফায় ২২, ২৩ ও ২৪ জুলাই তিন দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরে দ্বিতীয় দফায় ২৭ ও ২৮ জুলাই (রবি ও সোমবার) ছুটি ঘোষণা করা হয়।

জুলাই সনদে ৭ দফা অঙ্গীকার, দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন
- এই সনদ ভবিষ্যতের পথরেখা তৈরি করবে : আলী রীয়াজ
নিজস্ব প্রতিবেদক

সনদে উল্লিখিত প্রস্তাব বা সুপারিশ দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাসহ সাত দফা অঙ্গীকার করে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ স্বাক্ষর করবে রাজনৈতিক দলগুলো। চলতি মাসেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হবে বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আশা করছে। দ্বিতীয় দফা সংলাপের পরও যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা যায়নি, সেসব বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত জানাবে। ওইসব বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) দিয়ে সনদে স্বাক্ষর করতে পারবে রাজনৈতিক দলগুলো।
এদিকে, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় সনদের খসড়ার বিষয়ে ৩০ জুলাই বুধবারের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে মতামত দিতে আহবান জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ। এই সনদ ভবিষ্যতের পথরেখা তৈরি করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
কমিশন সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত খসড়ায় জাতীয় সনদের শিরোনাম রাখা হয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’।
সনদের অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে—“(১) হাজারো মানুষের জীবন ও রক্ত এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তেপ্রক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব। (২) সনদে দেশের শাসনব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ এই সনদে লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
সনদের প্রথম দফায় পটভূমিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের নীতিকে ধারণ করে সংগঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, দীর্ঘ ৫৩ বছরেও তা অর্জন করা যায়নি। কারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সংস্কৃতি বিকাশের ধারা বারবার হোঁচট খেয়েছে। বস্তুতপক্ষে বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একদিকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নামে মাত্র থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বলভাবে কাজ করেছে। বস্তুত রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দলীয় প্রভাবের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে পরিচালনা করা হয়েছে।
২০০৯ সালে একটি দলীয় সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করতে থাকে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের মানবাধিকার হরণ, গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা ও হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট করে। এই পটভূমিকায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিপুল ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব সফল গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু, নারীসহ এক হাজার চার শর বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এ অবস্থায় জনগণের মননে রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের একটি প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার, বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুশীলন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসিত জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার সদ্ব্যবহার করা আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব।
সনদের দ্বিতীয় দফায় সংস্কার কমিশন গঠন, তৃতীয় দফায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন এবং চতুর্থ দফায় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাস মেয়াদে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। এরপর পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এ বিষয়ে ৩৫টি দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে পাঠায়। প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ৪৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মোট ২০টি বিষয় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় মিলিত হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ রচিত হয়।
সনদের পঞ্চম দফায় ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আলোচনা চলমান থাকায় এখনো খসড়ায় তা উল্লেখ করা হয়নি। তবে এ পর্যন্ত ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর, নির্বাচন কমিশন গঠনে বাছাই কমিটি গঠন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, স্বাধীন পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার, প্রধান বিচারপতির নিয়োগপ্রক্রিয়া নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের জন্য আইন প্রণয়ন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণে কমিটি গঠন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন এবং উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত গঠন।
এই সনদে নাম ও পদবি উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করবেন। এরপর ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা এবং সর্বশেষ ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করবেন। এই জুলাই সনদ আমাদের আগামীর পথরেখা তৈরি করবে বলে আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, জুলাই সনদকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে তৈরি করতে চায় কমিশন। এর মাধ্যমে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হবে। মৌলিক সংস্কারের ২০টি বিষয়ের মধ্যে এরই মধ্যে ১২টিতে একমত হয়েছে দলগুলো। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে এ নিয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হবে।

‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজি
মহেশপুরে রানার জীবন বদলে গেছে, ‘ছোটদের’ কাছে জিম্মি হবিগঞ্জবাসী
অরিত্র কুণ্ডু, ঝিনাইদহ ও রায়হান আহমেদ, হবিগঞ্জ

‘সমন্বয়ক’ হওয়ার পর ঝিনাইদহের মহেশপুরের হামিদুর রহমান রানার পকেট প্রায় প্রতিদিনই ভারী থাকছে। বিভিন্ন স্থানে কাজের ভাগ নিতে, চাঁদাবাজিতে তাঁর নেতৃত্বে অপতৎপরতা চলছে ঝিনাইদহের বিভিন্ন স্থানে। এলাকাবাসী বলছে, সমন্বয়ক হয়েই বদলে গেছে রানার জীবন। অন্যদিকে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজদের তৎপরতায় অতিষ্ঠ হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ।
সমন্বয়ক রানার জীবন পাল্টে যাচ্ছে : সংসার চলত টেনেটুনে। লেগেই থাকত অভাব-অনটন। এই অনটনের পরিবারের সদস্য গ্রামের মসজিদে মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে ইমামতির চাকরি নিয়েছিলেন।
জেলা জুলাই যোদ্ধা সংসদের মুখ্য সংগঠক মেহেদী হাসান বাপ্পী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের লড়াই-সংগ্রামের সময় আমি মাঠে কখনো রানাকে দেখিনি। হঠাৎ একদিন জানতে পারি, সে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা হয়েছে। এর পর থেকে মহেশপুরের বিভিন্ন স্থানে সমন্বয়ক পরিচয়ে বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে সে। এ নিয়ে আমরা একাধিক দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছি, কিন্তু কোনো ফল পাইনি। তার অপকর্ম নিয়ে প্রতিবাদ করলে উল্টো আমাদের হামলা-মামলার ভয় দেখায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘রানা আগে টাকার অভাবে চলতে পারত না। এখন সে লাখ লাখ টাকার মালিক বনে গেছে। দামি মোটরসাইকেলে চড়ে। এলাকায় বেশ কয়েক বিঘা জমি কিনেছে বলেও শোনা যাচ্ছে। সে মূলত চাঁদাবাজিসহ সীমান্তে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে অল্প দিনে অনেক টাকার মালিক হয়ে গেছে।’
মহেশপুর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, ‘সমন্বয়ক রানা আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে পৌরসভার ঠিকাদারির কাজ বাগিয়ে নিতে চায়। গত ২২ জুলাই একটি দরপত্রের কাজের ভাগ নেওয়ার জন্য তার সংগঠনের জেলা নেতাদের আমাদের এখানে নিয়ে এসেছিল। পরে আরেকটি গ্রুপের হস্তক্ষেপে তারা পালিয়ে যায়।’ মহেশপুরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খাদিজা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। তবে লোকমুখে সমন্বয়ক রানার অপকর্মের কথা শুনেছি। কেউ তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত হামিদুর রহমান রানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে আমার অবস্থান তুলে ধরেছি। আমাদের সঙ্গে এখন বিভিন্ন মানুষ শত্রুতা করছে।’
‘ছোড’ চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি হবিগঞ্জবাসী : এদিকে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন হবিগঞ্জবাসী। শহরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই চাঁদাবাজদের ভয়ে তটস্থ। বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে দিতে হচ্ছে চাঁদা। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, শিল্প-কারখানার মালিকরাও এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। জেলা শহরে এক সমন্বয়কের চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় ছুরিকাঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, এই চাঁদাবাজরা হঠাৎ করেই চাঁদাবাজিতে নেমেছে। সংগঠনের জন্য, অনুষ্ঠানের জন্য অর্থ দরকার—বলে তারা চাঁদা তুলতে তৎপর রয়েছে। এদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এলাকার লোকজন এখন কৌতুক করে তাই বলেন, অকন শুরু হইছে ছোড ছোড চাঁন্দাবাজদের যন্ত্রণা।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলা শাখার সমন্বয়ক এনামুল হক সাকিব শহরের উমেদনগরে চাঁদাবাজি করে আসছিলেন গত বছরের জুলাই থেকেই। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তাঁকে চাঁদাবাজি থেকে থামাতে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবু তাঁকে দমানো যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে সংগঠনের আরেক সমন্বয়ক সোহাগ গাজী রুখে দাঁড়ান। তিনি সাকিবের চাঁদাবাজি বন্ধে জনমতও গঠন করছিলেন। এক পর্যায়ে তাতে সংক্ষুব্ধ হয়ে সাকিব গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রাত ১টার দিকে দলবলসহ শহরের সিনেমা হল রোডে সোহাগ গাজীকে ছুরিকাঘাত করেন। ছুরিকাঘাতে আহত সোহাগকে পরে আধুনিক জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করান আশপাশের লোকজন। ওই অপরাধের জেরে চলতি বছরের গত ৬ মে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয় সাকিবকে। এরপর আরো কিছু অপরাধের তথ্য পেয়ে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে সাকিবকে শহরের চৌধুরী বাজার এলাকা থেকে গত ৬ জুলাই রাতে গ্রেপ্তার করে। সাকিব এখন হবিগঞ্জ কারাগারে রয়েছেন। সাকিব কারাগারে থাকলেও তাঁর অনুসারীরা চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে বলে ভুক্তভোগী অনেকে অভিযোগ করেছেন। তবে তাঁরা ভয়ে থানায় মামলা করতে পারছেন না।
হবিগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর মিয়া জানান, কিছুদিন আগে চার-পাঁচজন যুবক তাঁর দোকানে এসে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে অনুষ্ঠান করার জন্য অর্থ দরকার বলে চাঁদা দাবি করে। জাহাঙ্গীর চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়।
সমন্বয়ক পরিচয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছ থেকেও বিভিন্ন উপায়ে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে।
জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা নিবাসী মো. রিমন সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বারবার চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠলে রিমনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলা শাখার কোনো সম্পর্ক নেই বলে গত ৯ মে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে। গত ৪ মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অলিপুর প্রাণ কম্পানির কাছ থেকে চাঁদাবাজিসংক্রান্ত একটি চিঠি ছড়িয়ে পড়ে। তাতে লেখা ছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলা কমিটির শীর্ষ নেতারা।
জেলার চুনারুঘাটে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সমন্বয়ক পরিচয়ে এক যুবক লক্ষাধিক টাকা নেন এক ব্যক্তির কাছ থেকে। অর্থ নেওয়ার পর আট মাস পেরোলেও চাকরি জুটিয়ে দিতে পারেননি সেই ‘সমন্বয়ক’।
চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদের এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ছয় মাস ধরে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে প্রায় দিনই তাঁর কাছে কিছু যুবক তদবির করে থাকে।
সদ্য লুপ্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক আরিফ তালুকদার বলেন, ‘সমন্বয়ক পরিচয়ে যারা সেখানে চাঁদাবাজি করতে যাবে, তাদের আটকে রেখে পুলিশে দেওয়ার জন্য আমরা সবাইকে বলেছি। আমরা চাঁদাবাজিকে সমর্থন করি না।’ তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ‘কেউ যদি চাঁদাবাজি করতে আসে আপনারা সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করবেন। প্রয়োজনে আমাদের ডাকবেন, আমরা শক্ত হাতে বিষয়টি দেখব।’
চাঁদাবাজি পরিস্থিতির বিষয়ে হবিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম শাহাবুদ্দিন শাহীন বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। পরিস্থিতি আমাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে।’