জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর এবং প্রয়োজনে এ নিয়ে আবারও আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তবে এই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আর বিএনপি দাবি করেছে, সংস্কার প্রস্তাবের আইনি ভিত্তি দেওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের আলোচনার শুরুতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলেন সংলাপের সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
আলোচনার একপর্যায়ে গণ-অধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুখ হাসান সনদের ভূমিকায় ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের বিষয়টি যুক্ত করার দাবি জানান। পরবর্তী সময়ে অন্যরা কথা বলতে চাইলে তাঁদের সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে সংলাপের বিরতিতে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন।
সংলাপে সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রধান এবং মৌলিক দায়িত্বটা রাজনৈতিক নেতাদের।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। আমরা বিশ্বাস করি, যেসব বিষয়ে আপনারা একমত হয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নের পথ আপনারা তৈরি করতে পারবেন। সেখানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে অনুঘটকের কাজ করবে। পরবর্তী সময়ে সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রয়োজনবোধে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন আলোচনায় বসবে। কমিশনের পক্ষ থেকে যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছিল, ছয়টি কমিশনের সুপারিশের সারাংশ আপনাদের কাছে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনায় অনেকগুলো বিষয়ে একমত হওয়া গেছে এবং তার একটি তালিকাও আপনাদের সরবরাহ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সনদের খসড়া নিয়ে এরই মধ্যে আপনাদের পরিবর্তন, সংশোধন বিষয়ক মতামতগুলো আমরা পেয়েছি এবং তা প্রতিফলনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করছি। সনদের দুটি দিক রয়েছে, একটি হচ্ছে পটভূমিসহ আমরা কী কী বিষয়ে একমত হয়েছি এবং অপরটি হচ্ছে ভবিষ্যতে আবার আলোচনায় বসার প্রতিশ্রুতি। আমরা আশা করছি, আজকের মধ্যে সব বিষয়ে নিষ্পত্তি করে আলোচনা শেষ করতে পারব।
যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো এবং যেসব বিষয়ে ভিন্নমত থাকবে সেগুলোর তালিকা আপনাদের জানানো হবে। সেই ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ দলিল তৈরি করা হবে এবং সব দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে এর চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে। চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে আপনাদের জানাব এবং আশা করি সবাই তাতে স্বাক্ষর করবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার পাশাপাশি সনদ বাস্তবায়নে দুই বছরের সময়সীমা নিয়েও আমরা একমত। যাঁরা বলছেন যে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তি দেওয়া যাবে না, তাঁরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এর আইনি ভিত্তি থাকতে হবে। আগামী সংসদে সেই ভিত্তি দিতে হবে। যদি তা না হয় তবে স্বাক্ষর করা, না করার কোনো পার্থক্য থাকে না। জাতির সঙ্গে তামাসা করার সুযোগ আমরা দেব না। তিনি বলেন, সংস্কারের প্রস্তাব হলো দীর্ঘ আলোচনায় ফলাফল। এই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন জরুরি। এ বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবে বিএনপির দ্বিমত নেই। বিএনপির বিষয়টি হলো আমরা ভালো মানুষ, ভালো দল, আমরা শপথ ভঙ্গ করব না। প্রস্তাব বাস্তবায়নে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।
বিএনপির বক্তব্যের প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, তাঁরা বলছেন সংসদে আইনের ভিত্তি দেবেন; তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য তার দৃষ্টান্ত আমরা এর আগে দেখেছি। গত ৫৪ বছরে কোনো সরকারই শপথের মর্যাদা রাখেনি। তাই আমরা বলব, এখনই যদি আইন না হয়, তাহলে আমাদের এত দিনের আসা-যাওয়া ও সময় ব্যয় হওয়া সবই জিরো। আমরা এত কষ্ট করলাম; কিন্তু বাস্তবায়ন না হলে এসবের কোনো মূল্য থাকবে না। বাস্তবায়ন না হলে শপথ করারও কোনো মূল্য থাকে না। তাই আমরা বলেছি প্রয়োজনে আরো আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হতে। তিনি জানান, আইনি ভিত্তি না দিলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না তার দল। কারণ নির্বাচিত সরকার এসে এটি আইনে রূপ দেবে তার নিশ্চয়তা নেই। তাই যা করার এখনই করতে হবে।
জামায়াত সনদে স্বাক্ষর না করলে সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো সংকট হবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, লিগ্যাল স্বীকৃতি না থাকলে স্বাক্ষর করলেই কী, আর না করলেই কী? সংকট হবেই। তিনি প্রশ্ন রাখেন, আইনি স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়? যাঁরা বলেন, এর কোনো সুযোগ নেই, তাঁরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। আমরা মনে করি, শুধু প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করলে হবে না। আইনি ভিত্তি না থাকলে এই চার্টার মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সে জন্য আমরা কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে কমপেনসেট মামলা করব। আইনি ভিত্তি ছাড়া এই চার্টার জিরো হবে। আমরা পরিষ্কার বলেছি, আইনগত ভিত্তি ছাড়া সই করব না। এই সরকারের মেয়াদেই এটি কার্যকর করতে হবে। কাল থেকেই এটা সম্ভব। আইনি ভিত্তি না দিয়ে যদি সরকার বাস্তবায়নের পথে না এগোয়, তাহলে আমরা এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে অসমাপ্ত মনে করব। সই করলেই যদি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে এটা এক ধরনের প্রহসন। সুতরাং আমরা সরকার ও কমিশনের প্রতি আহবান জানাচ্ছি, তারা যেন নিজেদের ওয়াদা বাস্তবায়নের জন্য এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখনো পর্যন্ত অস্পষ্ট। এটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আবারও বসতে হবে। দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হলে আমরা প্রত্যাখ্যান করব। দ্রুত এটি কার্যকর করতে হবে। আইনি ভিত্তি না দিলে, এই সনদ একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেই থাকবে। এমনটি হলে আমরা সই করব না। কারণ পরবর্তী সরকার এর স্বীকৃতি দেবে—এমন কথা ফাঁকিবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।