তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, সাবজেক্ট ম্যাটারে স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাসকো) আদেশের মানে হলো ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছিল, সেই পরিপত্রের ওপর স্থিতাবস্থা। অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ের আগে পরিপত্রটি যেভাবে ছিল, সেভাবেই থাকবে।
তাঁরা বলছেন, হাইকোর্ট কোন যুক্তিতে কোটা বাতিলের পরিপত্রটি অবৈধ বা বাতিল ঘোষণা করেছেন, গোটা পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করেছেন, নাকি মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে শুধু পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করেছেন, তা হাইকোর্টের রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি না পাওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না। যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতের সামনে হাইকোর্টের রায়টি না থাকায় সাবজেক্ট ম্যাটারে স্ট্যাটাসকো (বিষয়বস্তুর ওপর স্থিতাবস্থা) দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি ছিল।
২০১৮ সালে সেটা বাতিল করে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এটা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি মামলা করা হয়। সেই মামলায় শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট কোটা পদ্ধতি বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেন। অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ে কোটা পদ্ধতি যেটা আগে ছিল, সেটা আবার বহাল হয়। পরবর্তী সময়ে এ রায়টি চ্যালেঞ্জ করে আমরা (রাষ্ট্রপক্ষ) আপিল বিভাগে একটি আবেদন করি। যেহেতু রায়ের অনুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই আমরা সিএমপি (রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন) ফাইল করেছিলাম। সেই সিএমপির আজ শুনানি হলো। আমরা কোর্টকে বললাম, এখনো রায়ের অনুলিপি পাইনি। রায় না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু করতে পারছি না। ফলে হাইকোর্টের রায়ের ওপর আমরা স্থগিতাদেশ চেয়েছিলাম। শুনানির পর আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। অর্থাৎ যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায়ই থাকবে। এই স্থিতাবস্থার কারণে হাইকোর্টের রায়টি এখন আর কার্যকর হবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘স্থিতাবস্থা দেওয়া হয়েছে সাবজেক্ট ম্যাটারে। সাবজেক্ট ম্যাটারে এটা (কোটা পদ্ধতি) বাতিল করা হয়েছিল। এখন যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো আছে, সেগুলোতে কোটা পদ্ধতি থাকবে না।’
এ আদেশের পর চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনের আর যৌক্তিকতা থাকছে না বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছেন রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেননি। তাই অন্তত চার সপ্তাহের জন্য কোটা পদ্ধতি নিয়ে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই।
আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল বিভাগের স্ট্যাটাসকো আদেশ নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই। এই আদেশের অর্থ হচ্ছে, হাইকোর্টের যে রায় (কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা) আছে, সেই রায়ের কার্যকারিতা থাকবে না এবং ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল, সেই পরিপত্র অনুযায়ী সব অফিস-আদালতের নিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হবে।’
আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থীর পক্ষে এসেছি (আবেদন করা হয়েছে)। তারা কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নেই। তারা বিষয়টির একটি ন্যায্য সমাধান চাচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা এই আবেদন করেছে। আমরা আপাতত হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ চাচ্ছি।’
এরপর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, সেটি এখন আমাদের সামনে নেই। সে রায় আসুক, তখন আমরা দেখব।’
হাইকোর্টের রায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “সেটি (রায়) ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা দেখার অধিকারটা কার? তা দেখার একমাত্র অধিকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের। আপিল বিভাগ ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই কথা এই বাচ্চাদের (আন্দোলনকারীদের) কেউ বলছে না কেন? যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাঁরা বড় বড় জায়গায় আছেন, তাঁরা কেন বলছেন না, ‘বাবা, এটা তো (আন্দোলন) পথ না। তোমরা কোর্টে যাও। কোর্টে কারো না কারো মাধ্যমে যাও, কোর্ট দেখবে।’”
আদেশে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘সব প্রতিবাদী কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীকে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে নিজ নিজ কাজে, অর্থাৎ পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে বলা হলো।’
শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরতে অনুরোধ জানাচ্ছি : কাদের
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মানুষের দুর্ভোগ হয়, এমন কর্মসূচি পরিহার করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
গতকাল দুপুরে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন সর্বোচ্চ আদালত। জানা গেছে, আগস্ট মাসে চূড়ান্ত শুনানিতে শিক্ষার্থীদের দাবি সুবিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত। আদালত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যেতে বলেছেন। আমরা শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করব ফিরে যেতে।’
তিনি বলেন, ‘তারা আদালতের নির্দেশ মেনে ফিরে গেল কি না, তা পর্যবেক্ষণ করে দেখি। না ফিরে গেলে কী করা হবে, এখনই এসব বলা সমীচীন হবে না, ভাবছি না।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তারা যে বিষয় নিয়ে আন্দোলন করছে, আমরা তো সেই কোটামুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরছি না। আদালতের সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত। আশা করি, বাস্তবসম্মত রায় দিয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যাপারটা আমাদের যোগাযোগে আছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। অচিরেই সমস্যা সমাধান হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর দেশে আসা নিয়ে কাদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সব কর্মসূচি সম্পন্ন হয়েছে। বেইজিংয়ে তাঁর রাতযাপনের কথা ছিল। কিন্তু তিনি সেখানে না থেকে রাতেই দেশে ফিরে আসবেন। সায়মা ওয়াজেদ দেশে আছেন। তিনি কিছুটা অসুস্থ। তাই রাতেই দেশে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে অনেকেই মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিচ্ছে।’
এ সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, এস এম কামাল হোসেন, আফজাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কার্যনির্বাহী সদস্য সাহাবউদ্দিন ফরাজী উপস্থিত ছিলেন।
কোটা আন্দোলনের পূর্বাপর
২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করার আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষণ করা হতো। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ছিল ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ কোটা।
এই কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ছয় বছর আগে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। সে সময় এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন নুরুল হক নুরসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ২ জুন একটি কমিটি করে সরকার। সব কাজ শেষে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোনো কোটা না রেখে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করতে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ জমা দেয় কমিটি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর ৩ অক্টোবর তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হলে সেখানে কোটা বাতিলের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। পরদিন ৪ অক্টোবর কোটা পদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করেন জনপ্রশাসনসচিব।