’
মোদি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিই। আমি একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভারতের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে।’
মোদি আরো বলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘সোনার বাংলা’ গড়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অভিনন্দন জানাই। আমরা একসঙ্গে ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’-এর লক্ষ্যগুলো বাস্তবে পরিণত করব বলে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা নতুন খাতে সহযোগিতার জন্য একটি ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছি। ‘গ্রিন পার্টনারশিপ’, ‘ডিজিটাল পার্টনারশিপ’, সুনীল অর্থনীতি, স্পেসের মতো অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের তরুণরা উপকৃত হবে। ভারত-বাংলাদেশ ‘মৈত্রী স্যাটেলাইট’ আমাদের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতা দেবে।”
মোদি বলেন, ‘আমরা আমাদের দৃষ্টিতে রেখেছি সংযোগ, বাণিজ্য ও সহযোগিতা। গত ১০ বছরে আমরা ১৯৬৫ সালের আগে বিদ্যমান সংযোগ পুনরুদ্ধার করেছি। এখন আমরা ডিজিটাল ও জ্বালানি সংযোগের ওপর আরো জোর দেব। এতে উভয় দেশের অর্থনীতিতে গতি আসবে। আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে উভয় পক্ষ সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি (সেপা) নিয়ে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে একটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো নির্মাণে সহায়তা করবে।’
অভিন্ন নদ-নদী প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৫৪টি নদী ভারত ও বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে। আমরা বন্যা ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা, পানীয় জল প্রকল্পে সহযোগিতা করে আসছি। আমরা ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়নের জন্য কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশে তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করতে একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।’
প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন থেকে শুরু করে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন খাতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরো জোরদার করার বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমরা সন্ত্রাস দমন, মৌলবাদমুক্তকরণ এবং সীমান্তে শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সহযোগিতা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মোদি বলেন, ‘ভারত মহাসাগর অঞ্চলের জন্য আমাদের একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক ওশান ইনিশিয়েটিভে যোগদানের বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা বিমসটেকসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখব।’
বিশ্বকাপ ক্রিকেট ম্যাচের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দলকেই শুভেচ্ছা জানান মোদি। তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিন্ন সংস্কৃতি এবং প্রাণবন্ত মানুষে মানুষে আদান-প্রদান আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি। আমরা বৃত্তি, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মোদি ঘোষণা দেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের জন্য ভারত ই-মেডিক্যাল ভিসা সুবিধা চালু করবে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের সুবিধার্থে ভারত রংপুরে একটি নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সম্পর্কের সব বিষয়, বিশেষ করে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের বিষয়টি উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচনায় এসেছে। দুই প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের স্বার্থে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ডিজিটাল এবং সবুজ অংশীদারির জন্য যৌথ দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্মত হয়েছেন।
ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত বন্ধু ও আঞ্চলিক অংশীদার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট সম্পর্ককে বাংলাদেশ সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দেয়।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমে বিকশিত এবং দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের দুই দেশের এবং জনগণের কল্যাণের জন্য আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করার বিষয়ে সম্মত হয়েছি।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে তাঁর শেষ দ্বিপক্ষীয় সফর করেছিলেন এবং পরে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আমন্ত্রিত ‘অতিথি দেশ’ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে নয়াদিল্লিতে ভারতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন।
তিনি বলেন, “এখন আমি এই একই ‘জুন’ মাসে অভূতপূর্ব দ্বিতীয়বারের মতো নয়াদিল্লি সফর করছি।”
এর আগে শেখ হাসিনা গত ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং নবগঠিত মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আরো কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে নয়াদিল্লি সফর করেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ সবই আমাদের এই দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে একে অন্যের সঙ্গে কাজ করার প্রমাণ বহন করে।’
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের পর এটিই কোনো দেশে তাঁর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাকে এবং আমার প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ আতিথেয়তা প্রদান করার জন্য আমি ভারত সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারত সরকার ও সে দেশের জনগণের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের সেই সব বীরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি যাঁরা ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান এবং মোদিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা
বাসস জানায়, সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আনুষ্ঠানিক উষ্ণ সংবর্ধনা প্রদান করেছেন। রাষ্ট্রপতি ভবনে লাল গালিচা বিছিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদি আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা জানান। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।
রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের একটি অশ্বারোহী দল রাষ্ট্রপতি ভবনের গেট থেকে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরকে বেষ্টন করে সংবর্ধনাস্থল পর্যন্ত নিয়ে যায়। ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। প্রধানমন্ত্রী গার্ড পরিদর্শন এবং অভিবাদন গ্রহণ করেন।
এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রেজেন্টেশন লাইনে শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের পরিচয় করিয়ে দেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও তাঁর সফরসঙ্গীদের মোদির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বিকেলে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে তাঁর সচিবালয়ে এবং এরপর রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে দেখা করেন। সফর শেষে গত রাতে তিনি ঢাকায় ফেরেন।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ। দুই দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যকার বৈঠকের পর সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরো বৃদ্ধি পাবে।