বর্তমানে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সর্বশেষ কাউন্সিল হয়েছিল ২০১৭ সালে। সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে কাউন্সিল না হওয়ায় ওই কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। দলটির গঠনতন্ত্রে তিন বছর পর পর কাউন্সিল করার বিধান রয়েছে। তবে বর্তমানে কাউন্সিল না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কমিটিতে রদবদল আনা হলো। গতকাল ৪৫ জন নেতাকে পদায়নের মাধ্যমে নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। এতে স্পষ্ট, বিএনপি আপাতত দলের কাউন্সিল করছে না।
নতুন পদায়ন করা নেতাদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কমিটিতে এমন কিছু নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে আনকোরা। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করা নেতাকর্মীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আবার সাংগঠনিকভাবে দক্ষ কয়েকজন নেতাকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে পদায়ন করা হয়েছে। ওই নেতাদের প্রায় সবার প্রতি তারেক রহমানের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। কাউকে তিনি নিজের লোক মনে করেন না। একই সঙ্গে বিভিন্ন কারণে তারেক রহমান কিছু নেতার ওপর মনঃক্ষুণ্ন। ওই নেতাদের এমন পদ দেওয়া হয়েছে, যা অনেকটা শাস্তিমূলক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা জানান, কমিটি গঠনের মাধ্যমে তারেক রহমান মূলত দলে তাঁর শক্ত বলয় তৈরি করছেন। দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে নিজের পছন্দের নেতাদের নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এতে বিএনপিতে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হবে এবং ভবিষ্যতে তাঁর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো নেতা থাকবেন না।
গঠনতন্ত্রে যা আছে
বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের সাময়িক অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের সমুদয় দায়িত্ব পালন করবেন। আর চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বলা আছে, ‘চেয়ারম্যান প্রয়োজন মনে করলে জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিষয়ভিত্তিক উপকমিটিসমূহ এবং চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত অন্য কমিটিসমূহ বাতিল করতে এবং পরবর্তী কাউন্সিলের অনুমোদন সাপেক্ষে পুনর্গঠন করতে পারবেন।’ জাতীয় নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তারেক রহমান এ ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কমিটি পুনর্গঠনের আলোচনা বিভিন্ন সময়ে স্থায়ী কমিটিতে হয়েছে। তবে কখন ও কোন প্রক্রিয়ায় সেটি করা হবে, তা তাঁদের জানানো হয়নি। এমনকি কমিটি ঘোষণার আগে দলের মহাসচিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতামতও নেওয়া হয়নি।’
দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলের নির্বাহী কমিটিতে কিছু পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদেও কয়েকজন নেতাকে পদায়ন করা হয়েছে। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে এই পদায়ন করা হয়।’
গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, বরিশাল মহানগর কমিটি বিলুপ্ত করে বিএনপি। একই সঙ্গে সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও মুনায়েম মুন্নার নেতৃত্বাধীন যুবদলের কমিটিও ভেঙে দেওয়া হয়।
৪৫ জন নেতার পদায়ন
এই পদায়নের মাধ্যমে অনেক নেতার পদোন্নতি হয়েছে। বেশ কয়েকজন নেতাকে সম্পাদকীয় থেকে নির্বাহী কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। দলের বিশেষ সম্পাদক সাবেক ছাত্রদল সভাপতি আসাদুজ্জামান রিপনকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হারুন অর রশিদ, আসলাম চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাখাওয়াত হাসান জীবন, সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বেবী নাজনীন এবং সহ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক খালেদ হোসেন চৌধুরী ফাহিনকে দলের চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পদে পদায়ন করা হয়েছে।
তবে স্বপন, খোকন, সরোয়ার ও আলালের মতো সাংগঠনিকভাবে দক্ষ নেতাদের উপদেষ্টা পদে পদায়নের মাধ্যমে মূলত তাঁদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট বিরোধের কারণে মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং একটি টেলিভিশন টকশোতে দলের নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলায় তাঁর প্রতি আক্রোশ ঝেড়েছেন তারেক রহমান।
মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি আক্ষেপ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশ ভালো থাকুক, দল ভালো চলুক, এটাই আমার প্রত্যাশা।’
সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে যুগ্ম মহাসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন আবদুস সালাম আজাদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স এবং শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি।
সহসাংগঠনিক সম্পাদক থেকে পদোন্নতি পেয়ে সাংগঠনিক সস্পাদক হয়েছেন কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল (ঢাকা বিভাগ), সৈয়দ শাহীন শওকত খালেক (রাজশাহী বিভাগ) ও শরীফুল আলম (ময়মনসিংহ বিভাগ)। এ ছাড়া সমবায়বিষয়ক সম্পাদক জি কে গউছ (সিলেট বিভাগ) সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন।
এর মধ্যে সাইয়েদুল আলম বাবুল কয়েক মাস আগে সহসাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন। শাহীন শওকতের বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগ। সাংগঠনিকভাবে দক্ষ নন তিনি। অনেকে বলছেন, এই দুই নেতাকে অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে।
দলের প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে।
এ ছাড়া সহপ্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক, সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীমকে গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক এবং যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিএনপির সভাপতি নাহিদ খানকে সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, ডা. শাহ মুহাম্মদ আমান উল্লাহ হককে সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক এবং এ এস এম সাইফ আলীকে সহ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে।
সহপ্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীমকে রাজশাহী বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদকে করা হয়েছে ঢাকা বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক।
জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক আমিনুল ইসলামকে রংপুর বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক, মীর হেলাল উদ্দিনকে চট্টগ্রাম বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক, আবু ওয়াহাব আকন্দকে ময়মনসিংহ বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক এবং মিফতাহ সিদ্দিকীকে সিলেট বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
পদ অনুযায়ী আমিরুল ইসলাম আলীম অবমূল্যায়িত হয়েছেন। ছাত্রদলের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক আরো গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করছেন অনেকে। নজরুল ইসলাম আজাদ ও মীর হেলাল রাজনৈতিকভাবে আনকোরা। বিএনপির রাজনীতিতে তাঁরা নবীন। ছাত্র কিংবা যুবরাজনীতির অভিজ্ঞতা নেই। সাংগঠনিকভাবে দক্ষ কোনো নেতাও নন তাঁরা।
জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের সহসাংগঠনিক সস্পাদক জালাল উদ্দিন মজুমদার, রংপুর বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, কুমিল্লা বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক সায়েদুল হক সাঈদ, সহ-কৃষিবিষয়ক সম্পাদক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল ফারুক, সহ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এস এম গালিবকে। তাঁদের ওপর তারেক রহমান অসন্তুষ্ট।
এ ছাড়া যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ, সুইডেন বিএনপির সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টু, ডেনমার্ক বিএনপির সদস্য গাজী মনির এবং ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবালকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলে ৫০২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া গঠন করা হয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলী। সর্বশেষ এ সংখ্যা ছিল ৮১ জন। তাঁদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন।
পুনর্গঠিত হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটি
বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটিও পুনর্গঠন করা হয়েছে। কমিটির নাম দেওয়া হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি এবং স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি।
চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটিতে তারেক রহমানের পদ হচ্ছে চেয়ার অব দ্য কমিটি। সদস্যরা হলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, আন্তর্জাতিক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম ও কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি তাজভিরুল ইসলাম।
স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্যরা হলেন শামা ওবায়েদ, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, নাসির উদ্দিন অসীম, নওশাদ জমির, কায়সার কামাল, আসাদুজ্জামান, আফরোজা খান রিতা, ফাহিমা নাসরিন মুন্নি, জিবা খান, নিপুন রায় চৌধুরী, খান রবিউল ইসলাম রবি, মীর হেলাল উদ্দিন, তাবিথ আউয়াল, ইশরাক হোসেন, ফারজানা শারমীন পুতুল, ইসরাফিল খসরু, আবু সালেহ মো. সায়েম এবং ইকবাল হোসেন বাবু।
ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠন
পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের সাড়ে তিন মাস পর ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
গত ১ মার্চ রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে সভাপতি ও নাসির উদ্দীন নাসিরকে সাধারণ সম্পাদক করে সাত সদস্যের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া ২৬০ সদস্যের নতুন কমিটিতে একজন সিনিয়র সহসসভাপতি, ৪১ জন সহসভাপতি, একজন সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ১১০ জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, একজন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সহসাধারণ সম্পাদক, সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্পাদকীয় বিভিন্ন পদে নেতাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।