এখন এই অপরাধের জন্য অনধিক ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, জরিমানা না দিলে তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া যাবে। কিন্তু অপরাধের মূল শাস্তি হলো জরিমানা।
বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তি কমানো হয়েছে বলেও জানান আইনমন্ত্রী। উদাহরণ হিসেবে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা-২১-এর কথা উল্লেখ করেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডের বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। আইনমন্ত্রী বলেন, এই সাজা কমিয়ে এখন করা হয়েছে সাত বছর। এ ছাড়া অনেক ধারায় দ্বিতীয়বার অপরাধের জন্য সাজা দ্বিগুণ বা সাজা বাড়ানো ছিল। প্রস্তাবিত আইনে প্রত্যেকটি ধারায় যেখানে দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে বাড়তি সাজার কথা আছে, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাতসংক্রান্ত ২৮ ধারা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। অজামিনযোগ্য এই ধারার অপরাধে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে এটি পরিবর্তন করে জামিনযোগ্য করা হয়েছে এবং সাজা কমানো হয়েছে। এখন এই অপরাধে সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান পরিবর্তন করে কমিয়ে পাঁচ বছর কারাদণ্ড করা হয়েছে।
বিদ্যমান আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এটি কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত আইনে হ্যাকিংয়ের জন্য অনধিক ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে একটি ধারায়।
এক প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনে গণমাধ্যমের জন্য আলাদা কোনো বিধান রাখা হয়নি।’
সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হবে সেপ্টেম্বরে
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে, সেই অধিবেশনে বিলটি সংসদে পেশ করা হবে। সেই অধিবেশনে আইনটি পাস হবে বলে আশা করছি। তখন চলমান মামলাগুলো স্বাভাবিকভাবে সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে যাবে।’
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদসচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, সারা বিশ্বে আইসিটিসংক্রান্ত বিষয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেসব কিছু বিবেচনায় রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই আইন কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত হয়ে যাবে। প্রস্তাবিত আইনের আওতায় জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি গঠন করা হবে।
বর্তমান মামলা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই চলবে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চলমান মামলার তদন্ত ও বিচার চলবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়ে কথা বলেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করা হলে এই আইনে তদন্তাধীন ও বিচারাধীন মামলা চলবে কি না তা অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চান সাংবাদিকরা। জবাবে এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘কোনো আইন বাতিল, পরিবর্তন বা পরিমার্জন, যা-ই করা হোক না কেন সেখানে একটি সেভিং ক্লজ (আইনের সংশোধন ও হেফাজত) থাকবে। সব সময় এই ক্লজটি রাখা হয়। আইনটা (প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন) আগে আসুক, তখন দেখা যাবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের) যে মামলাগুলো চলমান সে মামলাগুলোর ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, এই আইনটা (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) বিলুপ্ত হয়নি। এখন পর্যন্ত যত আইন পরিবর্তন হয়েছে অথবা বাতিল করে নতুন আইন করা হয়েছে, সব সময় একটি সেভিং বা হেফাজতকরণ নামে একটি ক্লজ রাখা হয়। সেখানে বলা থাকে, এই (বাতিল বা পরিবর্তন করা আইন) আইনের অধীনে যে মামলা হয়েছে, সেই মামলাগুলো সেই আইন অনুযায়ীই চলবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যত মামলা
গত ৫ জুন জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এই আইনে সাত হাজার একটি মামলা হয়েছে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে মামলা হয়েছে প্রায় সাড়ে চারটি।
গত ১৪ জানুয়ারি সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক ওয়েবিনারের সংগঠনটির গবেষণার তথ্য হিসেবে বলা হয়, এ আইনের মামলায় সবচেয়ে বেশি আসামি রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিকরা।
স্বাগত জানাল অ্যামনেস্টি
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থাটি বলেছে, ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগীরা কঠোর ওই আইনকে ভিন্নমত দমন এবং অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছিল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক দপ্তর গতকাল এক টুইট বার্তায় জানায়, বাংলাদেশ সরকারকে এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে যে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে যেন ওই আইনের দমনমূলক বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরিয়ে আনা না হয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আরো বলেছে, নতুন আইনটি পাস হওয়ার আগে সব অংশীদারকে যেন প্রস্তাবিত এই আইন খুঁটিয়ে দেখার এবং এটা নিয়ে মতামত প্রদানের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়। এর বিধানগুলো যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
কেবল মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারচর্চার কারণে যাঁদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আনা হয়েছে, তাঁদের অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে মুক্তি প্রদান এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
টিআইবির সতর্ক সাধুবাদ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তবে এর পরিবর্তে যে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, তা যেন কোনোভাবেই স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিতের আহবান জানিয়েছে সংস্থাটি।
গতকাল টিআইবির পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি ডিএসএর অনেক ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনে যুক্ত হবে। আমাদের আশঙ্কার জায়গা ঠিক সেখানেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারা মূলত ভিন্নমত দমন ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে অপব্যবহার হয়েছে, সেগুলো নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত না করার আহবান জানাই।’
বিএনপির আশঙ্কা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চেয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন আরো ভয়ংকর ও বিপজ্জনক হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবীর রিজভী। গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘তাদের (বর্তমান সরকার) হাত দিয়ে ভালো কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। দেশি-বিদেশি চাপে তারা আইওয়াশ হিসেবে এটি করেছে।