’
তালিকায় অন্তর্ভুক্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার কোনো সম্মানী বা ভাতা পাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ রকম কিছু এখনো আমাদের চিন্তায় নেই।’
যাচাই-বাছাই কমিটি : শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে।
কমিটিতে গবেষক সদস্য হিসেবে ছিলেন ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ এবং গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের। বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্য হিসেবে ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক)। কমিটিতে সভাপতি হিসেবে আছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব।
এ ছাড়া সদস্যসচিব হিসেবে গেজেট অধিশাখার উপসচিব ও সদস্য হিসেবে আরেকজন সচিব আছেন কমিটিতে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি মাসে কমিটিতে আরো যুক্ত হন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী।
কমিটির একজন সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিন গত বছর মারা যান।
তালিকার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব : শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব বিশ্লেষণ করে চিকিৎসক ও শিক্ষকদের প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে। প্রথম পর্বের ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে এককভাবে চিকিৎসক পরিচয়ে আছেন ৫০ জন। চিকিৎসক ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন দুজন। শিক্ষক আছেন ৩৩ জন এবং শিক্ষক ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন ১৪ জন। সরকারি কর্মচারী ১৯ জন এবং বেসরকারি দুজন। প্রকৌশলী আছেন ১৮ জন।
আইনজীবী আছেন চারজন এবং আইনজীবী ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন ১০ জন। এককভাবে সাংবাদিক হিসেবে আটজন এবং সাংবাদিক ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন পাঁচজন। সাহিত্যিক ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন আটজন। রাজনীতিবিদ, গণপরিষদের সদস্য ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন সাতজন। নাট্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী, সুরকার ও সংগীতজ্ঞসহ সংস্কৃতিকর্মী আছেন পাঁচজন। বিজ্ঞানী ও গবেষক দুজন। গবেষক ও সাহিত্যিক একজন। সমাজকর্মী ও সমাজসেবক তিনজন।
দ্বিতীয় পর্বে এককভাবে চিকিৎসক পরিচয়ে আছেন ৩৭ জন। চিকিৎসক ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন চারজন। শিক্ষক আছেন ২২ জন এবং শিক্ষক ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন পাঁচজন। আইনজীবী ২২ জন এনং আইনজীবী ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন ছয়জন। প্রকৌশলী আছেন ১৬ জন।
সমাজকর্মী, সমাজসেবক ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন পাঁচজন। লেখক, সাহিত্যিক ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন ছয়জন। অভিনেতা, নাট্যশিল্পী, ভাস্কর, খেলোয়াড়সহ সংস্কৃতিকর্মী ১০ জন। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা চারজন। সাংবাদিক ও অন্যান্য পরিচয়ে আছেন চারজন। শিক্ষাবিদ আছেন একজন ও কৃষি কর্মকর্তা একজন।
এই পর্বের ১৪৩ জনের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে রাজনীতিক পরিচয় আছেন ১০ জনের।
কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথম পর্বের তালিকা মূলত ১৯৭২ সালের বঙ্গবন্ধুর সরকারের করা এক হাজার ৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা এবং ডাক বিভাগ থেকে প্রকাশিত ১৫২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর ডাকটিকিট অবলম্বনে করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের নামগুলো প্রধানত বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, আইনজীবী সমিতি, সাংবাদিক ইউনিয়নের মতো বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের কাছে সংরক্ষিত তালিকা থেকে যাচাই-বাছাই করে তৈরি করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের আবেদন থেকে এখনো কাউকে বাছাই করা হয়নি।
তৃতীয় পর্বের কাজ : শহীদ বুদ্ধিজীবী যাচাই-বাছাই কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃতীয় পর্বের কাজ এখনো খুব প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তালিকার মানদণ্ড কী হবে, এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। এবারের তালিকায় কারা অন্তর্ভুক্ত হবেন বা মাঠ পর্যায়ের আবেদনগুলো যাচাই করা হবে কি না, বিষয়টি কমিটির সঙ্গে সভা করে মন্ত্রণালয় ঠিক করবে।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (গেজেট) মুহাম্মদ রেহান উদ্দিন গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে জানান, এ মাসের ২৭ তারিখে কমিটির সভা হবে। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কমিটিতে আহ্বায়কের দায়িত্বে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক) কালের কণ্ঠকে বলেন, দুই পর্ব হওয়ার পর নানা জায়গা থেকে আবেদন আসছে। সেগুলো এখন এক করা হচ্ছে। আবেদনগুলোর ভিত্তিতে একটা সভা করে খসড়া তৈরি করা হবে। সেই খসড়া যাচাই-বাছাই করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আবেদনের পরিমাণ নির্দিষ্টভাবে বলতে না পারলেও কাগজে-কলমে সংখ্যাটা ‘খুব একটা বেশি না’ বলে জানান তিনি। যেসব আবেদন আসে, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোতে প্রমাণের অভাব থেকে যায় বলে জানান তিনি। তবে আবেদন ছাড়াও কমিটির সদস্যরা নিজেরা বিভিন্ন নথিপত্র, বই, পত্রিকা ও অন্যান্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন।
তালিকা তৈরির কাজ কিছুটা ধীরগতিতে হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নে কমিটির গবেষক নিপসম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ বলেন, ‘করোনার কারণে প্রথম তালিকার পর দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশ করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। দেরি হওয়ার আরেকটা কারণ, আমরা অনেক বেশি সতর্ক ছিলাম। আমরা চেয়েছি, অতীতে অন্যান্য তালিকা নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে, এ তালিকা নিয়ে যাতে সে রকম কিছু না হয়। এ কারণে আমরা সময় নিয়েছি। তাড়াহুড়া না করে বরং এটাকে আমরা নির্ভুল করার দিকে মনোযোগ দিয়েছি। ভুল তথ্য দিয়ে আমরা জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চাই না।’
শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা : তালিকা তৈরি করতে গিয়ে কমিটি প্রথমেই শহীদ বুদ্ধিজীবীর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে। নানা আলোচনার পর গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে যাচাই-বাছাই কমিটির এক বৈঠকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা চূড়ান্ত করা হয়। একই বছরের ২৯ এপ্রিল সেই সংজ্ঞাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
সংজ্ঞা অনুযায়ী, যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীত ও শিল্পকলার বিভিন্ন শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁরা শহীদ বুদ্ধিজীবী।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সারা দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার সময়কাল ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর হলেও ঢাকা জেলার ক্ষেত্রে এ সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত।