রাজধানীতে গত চার মাসে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৫৮৩টি মামলা করা হয়েছে। এই সময়ে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন পাঁচজন। আহত হয়েছেন পুলিশসহ অন্তত ১৫ জন। এই সংখ্যা গত দুই বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি।
চার মাসে ছিনতাই চুরির ৫৮৩ মামলা
রেজোয়ান বিশ্বাস ও মোবারক আজাদ

চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় থানা-পুলিশ পর্যন্ত যান না ভুক্তভোগীরা। অনেক সময় থানা ছিনতাইয়ের ঘটনায় অন্য মামলা নেয়। অনেক সময় মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) গ্রহণ করে। ফলে থানার এই তথ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে না।
রাজধানীতে চুরি, ছিনতাই বৃদ্ধির এই প্রবণতায় রাশ টানতে পুলিশের সব বিভাগকে ১৯টি লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে পেশাদার ছিনতাইকারীদের সঙ্গে নতুন করে কারা অপরাধে জড়াচ্ছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে বলা হয়েছে। চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের ওপর নজরদারি বাড়াতেও নির্দেশনায় বলা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) থেকে গত মাসে এই নির্দেশনা জারি করা হয়।
ডিএমপির থানাগুলোর তুলনামূলক অপরাধচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চুরি ও ছিনতাইয়ের অপরাধে গত জানুয়ারি মাসে ডিএমপির ৫০ থানায় মামলা করা হয়েছিল ১২২টি। ফেব্রুয়ারিতে ১৫১টি, মার্চে ১৫১টি এবং এপ্রিলে ১৫৯টি মামলা করা হয়। গড়ে প্রতি মাসে মামলা করা হয়েছে ১৪৬টি। ২০২১ সালের হিসাবে দেখা যায়, সে বছর গড়ে প্রতি মাসে এমন মামলা করা হয়েছিল ১২৪টি। ২০২০ সালে করা হয়েছিল গড়ে ১১৬টি মামলা।
থানায় হওয়া এসংক্রান্ত মামলার নথি থেকে জানা যায়, পুরনো পেশাদার ছিনতাইকারীদের সঙ্গে নতুন কিছু ছিনতাইকারী যুক্ত হয়েছে। সংখ্যায় এরা ৫০০-এর বেশি। ৫০ থানা এলাকার ৫৭৫টি জায়গায় এদের তৎপরতা আছে। এরা পথচারী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বাসযাত্রীদের টার্গেট করে টাকা, মোবাইল ফোনসহ গুরুত্বপূর্ণ মালপত্র ছিনিয়ে নেয়। ডিএমপি সদর দপ্তরের এক প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গত চার মাসে ডিএমপি ও র্যাবের একাধিক অভিযানে ছিনতাই ও চুরির অভিযোগে অন্তত ৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন আগে চাকরিজীবী ছিলেন। চাকরি হারিয়ে তাঁরা এই পথে নেমেছেন। গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে চাকরিহারা প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষকও আছেন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুরি, ছিনতাইয়ে যুক্ত হওয়ার একটা বড় কারণ মাদকাসক্তি। মাদকের টাকা জোগাড় করতে বিশেষত ছিন্নমূল তরুণরা ছিনতাইয়ে জড়ায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন করোনার কারণে চাকরিহারা কিছু লোক। তার মানে বেকারত্ব একটা কারণ। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে।
ডিএমপি কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে ছিনতাই, চুরি ও টানা পার্টি প্রতিরোধে ডিএমপির সব বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় বাসাবাড়ি ও মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী ও কমিউনিটি পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে থানা পুলিশ সমন্বয় করে কাজ করছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সড়কে পুলিশের টহল বা চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে।
ছিনতাইকারীর হাতে নিহত ৫
গত ১৪ মে রাজধানীর রায়েরবাজার মেকাপ খান রোডে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে হোসেন (১৯) নামের এক জুয়েলারি দোকানের কর্মচারীর মৃত্যু হয়। ছিনতাইকারীরা তাঁর মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়।
২৭ মার্চ মিরপুরের কাজীপাড়ায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে ডা. বুলবুল হোসেন নামের এক দন্ত চিকিৎসক নিহত হন। ২২ মার্চ উত্তরা আব্দুল্লাহপুরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে ডালিম শেখ (৩৫) নামের এক পোশাক শ্রমিক নিহত হন।
২০ ফেব্রুয়ারি ভোরে সায়েদাবাদে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মোশাররফ হোসেন (৪৫) নামের এক কাঁচামাল বিক্রেতা খুন হন। পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি পল্লবী থানার লালমাটিয়া ট্রাকস্ট্যান্ডে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে রায়হান (২৬) নামের এক পোশাক শ্রমিক নিহত হন। গত চার মাসে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন পুলিশসহ অন্তত ১৫ জন।
এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয়েছে। ডা. বুলবুল হত্যার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ফলে ওই মামলায় দ্রুত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি খুনের ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
তবে সম্প্রতি মগবাজার ও মোহাম্মদপুর পশ্চিম কাটাসুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এ সময় ৩৪ লাখ টাকা, চার হাজার পিস ইয়াবা, দুটি দামি মোটরসাইকেলসহ ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। পুলিশ বলছে, এই ছিনতাইকারীচক্রের সদস্যদের মধ্যে শিক্ষক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলী রয়েছেন। তাঁদের একজন মাসুদ রানা হাওলাদার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষক স্কুলে পাঠদানের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারে ইংরেজি পড়াতেন। হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক এই শিক্ষক করোনার সময় চাকরি হারান। এরপর অভাব-অনটনের কারণে একটি ছিনতাইকারীচক্রে যোগ দেন।
শুধু মাসুদ নন, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার ও মাদরাসা শিক্ষকের ছিনতাইকারী হওয়ার তথ্যও জানিয়েছে ডিবি। কাজী রায়হান নামের এমনই এক চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে ডিবি জানতে পেরেছে, তিনি দেশের নামকরা একটি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করেছেন। তাঁর কিডনির সমস্যা দেখা দেয়। প্রতি মাসে ডায়ালিসিসের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে থাকেন তিনি। পরে ছিনতাইয়ে নেমে পড়েন।
আশরাফুল ইসলামের গল্পটা ভিন্ন। পেশায় তিনি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবি জানায়, ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে একটি টেক্সটাইল কম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। করোনার সময়ে চাকরি চলে গেলে একই কম্পানির ট্রাকচালক লেলিনের সঙ্গে ছিনতাই শুরু করেন তিনি। দিনে দিনে বাড়তে থাকে অবৈধ আয়ের নেশা। ছিনতাইয়ের টাকায় তিনি শ্বশুরের সঙ্গে জমির ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর সহযোগী ছিল মগবাজার এলাকার একটি হাসপাতালের দুই অ্যাম্বুল্যান্সচালক জিল্লুর রহমান খান ও সাইফুল ইসলাম শাওন।
সম্প্রতি আজিজ মোহাম্মদ নামে আরো একজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি জানতে পারে, মাদরাসার শিক্ষকতার চাকরি চলে গেলে তিনি ছিনতাই, চুরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, শিক্ষিত যুবকরা আর্থিক সংকটকে অজুহাত বানিয়ে অপরাধে জড়াচ্ছেন। যদিও চাকরি চলে যাওয়ার পর তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী নতুন চাকরিতে যোগদানের সুযোগ ছিল। তবে সহজে বেশি টাকা আয়ের লোভে তাঁরা ছিনতাইকারীচক্রে জড়িয়েছেন।
ডিএমপির হিসাবে ছিনতাইয়ের স্থান
তদন্তে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ডিবি জানায়, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটার অন্যতম স্থানগুলো হলো সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, মতিঝিলের ব্যাংকপাড়া, মগবাজার-মৌচাক, হাতিরঝিল, কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, শেওড়াপাড়া, তালতলা, কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর-১০, বিমানবন্দর, আজমপুর বাসস্ট্যান্ড, পূর্বাচল ৩০০ ফুট অন্যতম। এ ছাড়া সব কটি উড়ালসেতুর ওপরে-নিচে মোটরসাইকেল আটকে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
ডিবি কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনায় দেখা যায়, ছিনতাই করা জিনিস উদ্ধার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা আর মামলা করতে চান না। এতে অপরাধীরাও ছাড়া পেয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘আমাদের মধ্যে সামাজিক নজরদারি ও অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার প্রবণতা কম। এই সুযোগে অনেক সময় অপরাধীরা চুরি-ছিনতাই করে পার পেয়ে যায়। তাই এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরো চৌকস হতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক নজরদারিও বাড়ানো প্রয়োজন।
সম্পর্কিত খবর

ব্যর্থ মেহেদী হাসান মিরাজ


বেশি দামে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক
নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনেছে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। প্রয়োজন হলে ডলার কিনব, আবার প্রয়োজন হলে বিক্রিও করব।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাজারে ‘আপওয়ার্ড সিগন্যাল’ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। এতে করে ডলারের রেট একদিকে পুরোপুরি বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকছে, অন্যদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত উপস্থিতিও বজায় থাকছে। এই কৌশল মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ এবং আইএমএফের শর্ত পূরণ উভয় উদ্দেশেই সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন বা এক কোটি ডলার কিনেছে। গত ২৩ জুলাই এই নিলামে কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয় ১২১.৯৫ টাকা, যা আগের তুলনায় ০.৪৫ টাকা বেশি। এর মাধ্যমে মাত্র আট দিনের ব্যবধানে নিলামে ডলারের রেট উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যাংকের দর দেখে ১২১ টাকা ৯৫ পয়সায় এক কোটি ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত পদক্ষেপ। এই নিলামে ডলারের কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১২১.৯৫ টাকা।
ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ও বাজারে প্রতিক্রিয়া : শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। তবে এবার আগের মতো অনেক ব্যাংক আগ্রহ দেখায়নি। কারণ অনেক ব্যাংক ধারণা করছে, সামনে ডলারের দাম আরো বাড়বে। তাই তারা অপেক্ষা করছে। চড়া দর সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বাজারে প্রত্যাশা কিভাবে গড়ে উঠছে।’
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মোহাম্মদ মারুফ মনে করেন, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো চাচ্ছে, যে ডলার রয়েছে সামনে সেটা দিয়েই দায় পরিশোধ করবে। তা ছাড়া চলতি মাসেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। যে কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে তেমন আগ্রহী ছিল না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মারুফ বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে যা উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে। এটা দিয়ে বোঝায় যে ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে গেছে এবং যে পরিমাণ তারল্য রয়েছে, আসলে এত দরকার নেই।’
বাজার পরিস্থিতি ও এলসির চাপ : পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সম্প্রতি ডলারের বাজার কিছুটা টাইট। কারণ ব্যাংকগুলো আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ বাড়াচ্ছে। তবে আগামী সপ্তাহে ডলারের প্রবাহ বাড়লে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের বাজার স্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। আগের অস্থিরতা অনেকটাই কেটে গেছে, তবে আরো কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা দরকার।’
স্পট ও আন্ত ব্যাংক বিনিময় হার : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ জুলাই স্পট বিনিময় হার ছিল ১২১.৯৪ টাকা। আন্ত ব্যাংক বাজারে ডলার লেনদেন হয় ১২১.৬০ থেকে ১২২.০২ টাকার মধ্যে। শীর্ষস্থানীয় আরেক ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, ‘বুধবার আন্ত ব্যাংক বাজারেই ডলারের দাম ১২২ টাকা ছাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপওয়ার্ড সিগন্যালের ফলে আগামীকাল এটি আরো বাড়তে পারে।’
আইএমএফের শর্তে বাজারভিত্তিক নীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের ঋণচুক্তির আওতায় এখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি হস্তক্ষেপ করে নির্দিষ্ট রেটে ডলার কেনে না। মে মাস থেকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হওয়ায় এখন নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা হয়। এতে করে ডলারের মূল্য নির্ধারণে বাজার প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, ‘আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেরা রেট নির্ধারণ করত। এখন মার্কেট রেটেই লেনদেন হচ্ছে। এই পদ্ধতিই দীর্ঘ মেয়াদে বাজারকে আরো স্বচ্ছ করবে।’

ফিরে দেখা ২৫ জুলাই ’২৪
মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব জাতিসংঘের
নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ। ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে এই প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে এক ব্রিফিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশে শিগগিরই শান্তি ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছে বিএনপিও।
এদিকে এদিনই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে প্রবাসী ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে বিক্ষোভ করে তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চায় সরকার। বিশ্বের নানা দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস, হাইকমিশন এবং অনাবাসিক মিশনগুলোর মাধ্যমে হোস্ট গভর্নমেন্টের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এদিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা খোলা ছিল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস। রাজধানীতে দূরপাল্লার গণপরিবহনে যাত্রীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। কারফিউ বলবৎ থাকায় রাজধানীতে ছিল কঠোর সেনা টহল।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তথ্য অনুযায়ী, এদিন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর কেবল কোটা সংস্কারের ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই।’ তিনি বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গেই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটবে না।
অন্যদিকে ২৩ জুলাই (২০২৪) প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আংশিক বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’। বিবৃতিতে ৯১ জন শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আটটি বার্তা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি, হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের সহযোগিতা, রংপুরের আবু সাঈদসহ নিহত সবার কবর জিয়ারত, রুহের মাগফিরাত কামনা এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো।
২৫ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট চালু, কারফিউ তুলে দেওয়াসহ ‘জরুরি’ চার দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হয়। তবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে না পারায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি তারা। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে আরেক অংশের একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এর সমন্বয়ক হান্নান মাসুদের বরাত দিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, পরদিন ২৬ জুলাই বাদ জুমা সারা দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা ও শোক মিছিল করা হবে।
নিহত ১৭০ জনের বেশি, আহত হাজারের বেশি— জাতিসংঘ : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হালনাগাদ তথ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ১৭০ জনেরও বেশি লোক নিহত এবং হাজারের বেশি আহত হয়েছে। তাদের অনেকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ও তরুণদের প্রতিবাদ কর্মসূচির পর অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। অন্তত দুজন সাংবাদিক নিহত এবং আরো অনেকের আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কয়েক শ লোকের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিনই এক যৌথ বিবৃতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্ণ জবাবদিহির আহবান জানান জাতিসংঘের ১৩ জন স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। তাঁরা বাংলাদেশে সহিংস দমন-পীড়নের অভিযোগ এনে তা বন্ধ করার আহবান জানান।
ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, বিচার চাইলেন জনগণের কাছে : এদিন সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন ঘুরে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এ সময় তাঁকে চোখের পানি মুছতেও দেখা যায়। পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের জনগণকে তাদের (দেশব্যাপী তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের) বিচার করতে হবে। আমি জনগণের কাছে ন্যায়বিচার চাইছি। ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়ার মতো আমার আর কোনো ভাষা নেই।’
মামলা ও গ্রেপ্তার : ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র দিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নাশকতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে এদিনও অভিযান অব্যাহত ছিল। এদিন বিকেলে রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোড থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য আন্দালিব রহমান পার্থকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রসঙ্গ শুল্ক
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২৯ জুলাই চূড়ান্ত আলোচনা
নিজস্ব প্রতিবেদক

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রধান বাণিজ্য আলোচনাকারী সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) বাংলাদেশকে আগামী ২৯ জুলাই তৃতীয় ও চূড়ান্ত শুল্ক আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সংবাদ সংস্থা বাসসকে এই তথ্য জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি জানান, এর আগে বাংলাদেশ ২২ জুলাই ইউএসটিআরের কাছে নিজেদের অবস্থানপত্র পাঠায় এবং ২৬ জুলাই চূড়ান্ত দফার আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দেয়।
বাণিজ্যসচিব জানান, ইউএসটিআর ২৯ জুলাই দিন ধার্য করেছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ শুল্ক হার হ্রাস করবে। কারণ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের জন্য ১৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার জন্য ১৯ শতাংশ, ভিয়েতনামের জন্য ২০ শতাংশ এবং ফিলিপাইনের জন্য ১৯ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে মার্কিন পণ্য, যেমন—তুলা, গম, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), বিমান ও অন্যান্য কৃষিপণ্য শুল্কমুক্ত আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ ২০ জুলাই মার্কিন গম সরবরাহকারীদের সঙ্গে সাত লাখ টন গম আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে সাংবাদিকরা শুল্ক আলোচনার সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চান। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে, এমন কোনো কাজ করা হবে না।
শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রচারণা নাকচ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে আমরা কেন এমন কাজ করব? তাহলে তো আন্ত মন্ত্রণালয় মিটিংয়ের দরকার হয় না। কিছু জিনিস মেনে নিয়ে কাজটা করে ফেললেই তো হয়ে যায়। সম্পূরক শুল্কের মতো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোতে লবিইস্ট নিয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায় না।’