বাবার মৃতদেহ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন বড় মেয়ে তাহমিনা এনায়েত তনু। পাহারায় থাকা সেনা সদস্যরা তাতেই হুংকার ছেড়েছিল, ‘কাঁদলেই গুলি করে দেব।’ ভয়ে তনুকে সরিয়ে নিয়ে যান একজন আত্মীয়। এমন শোকের ক্ষণেও কারো শব্দ করে কাঁদার অনুমতি মেলেনি।
বাবার লাশ দেখার শর্ত ছিল, কাঁদা যাবে না
- বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছুটে গিয়ে প্রাণ হারান কর্নেল জামিল
তৈমুর ফারুক তুষার

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে এমন নির্মম ক্ষণ নেমে এসেছিল রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদায়ী সামরিক সচিব কর্নেল জামিল আহমেদের পরিবারে। সেদিন ভোরে জাতির জনকের বাসায় হামলা চালিয়েছিল একদল বিপথগামী সেনা সদস্য।
কর্তব্যে অবিচল, অসীম সাহসী কর্নেল জামিলকে সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পথভ্রষ্ট সেনা সদস্যরা। তারা জামিলের মরদেহের প্রতিও চরম নিষ্ঠুরতা দেখায়। কর্নেল জামিলকে দাফন করা হয় জানাজা ছাড়াই।
ইতিহাসের সেই নির্মম অধ্যায়ের এসব তথ্য কালের কণ্ঠকে জানান শহীদ কর্নেল জামিল আহমেদের দ্বিতীয় কন্যা আফরোজা জামিল কঙ্কা। সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কঙ্কার বয়স তখন ১২ বছর। তার থেকে তিন বছরের বড় ছিলেন তনু।
গত শনিবার রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায় কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের স্মৃতিচারণা করেন আফরোজা জামিল। তিনি বলেন, “গণভবনে মা-বাবার শয়নকক্ষের পাশেই ছিল আমাদের কক্ষ। ভোরের দিকে বাবা ও মায়ের উচ্চস্বরের কথাবার্তায় আমার এবং বড় বোনের ঘুম ভেঙে যায়। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম মা-বাবা বিচলিত। বাবা বিভিন্ন জায়গায় ফোন করছেন। পরে জেনেছি, বিচলিত হওয়ার কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর ফোন। লাল ফোনটা বেজে উঠতেই মা (আনজুমান আরা) এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরেছিলেন। ওপাশ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জামিল কই? জামিলকে দে।’ মা দ্রুত বাবাকে ডেকে দেন। ফোন রেখে উদ্বিগ্ন বাবা জানান, বঙ্গবন্ধুর বাসায় হামলা হয়েছে। এরপর সেনাপ্রধানসহ একাধিক পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন বাবা। সেনাপ্রধান (কে এম সফিউল্লাহ) ফোর্স পাঠাবেন বলে বাবাকে আশ্বস্ত করেন।”
আফরোজা জামিল বলেন, “এক মুহূর্ত দেরি না করে বাবা ৩২ নম্বরের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর গাড়ির চালক আইনউদ্দিন মোল্লাকে ডেকে গণভবনে অবস্থানরত পিজিআর সদস্যদের ৩২ নম্বরের দিকে এগোনোর খবর দিতে বলেন। এরপর দ্রুত তৈরি হয়ে সাধারণ পোশাকেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে রওনা হন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মাকে বলেন, ‘মেয়েদের দেখে রেখ।’ অজানা এক আশঙ্কায় মা বলেন, ‘যাবা?’ বাবা তখন খানিকটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেন, ‘কী বলছ তুমি? আমাকে যেতেই হবে।’”
আফরোজা জামিল বলেন, “আমার বড় বোন তাহমিনা এনায়েত তনু বাবাকে এক গ্লাস পানি দেন। বাবা পানি খেয়ে সিগারেট ধরালেন। উনি প্রচুর সিগারেট খেতেন। সিগারেটটা খানিকটা খেয়ে ফেলে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। এ সময় মা বললেন, ‘ফেরার সময় শ্বেতাকে নিয়ে এসো।’ এটাই ছিল বাবার সঙ্গে মায়ের শেষ কথা।” ফাহমিদা আহমেদ শ্বেতা কর্নেল জামিলের তৃতীয় কন্যা। তিনি ঘটনার দিন মোহাম্মদপুরে খালার বাসায় ছিলেন।
আফরোজা জামিল বলেন, “বাবা তখন ডিজি-ডিএফআই পদে দায়িত্বরত। তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর মা আমাদের বড় চাচাকে ফোন করেন। খারাপ কিছু হতে পারে, তিনি বোধ হয় এমনটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। চাচা বলেন, ‘মিঠুকে (কর্নেল জামিলের ডাকনাম) আটকালে না কেন?’ মা উদ্বিগ্ন হয়ে বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তাকে ফোন করতে থাকলেন। এরই মধ্যে রেডিওতে ঘোষণা এলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। সকাল ৯টার দিকে বাবার গাড়ির চালক আইনউদ্দিন বাসায় ফিরে কোনো কথা না বলে শুধু কাঁদতে লাগল। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সাহেবকে কোথায় রেখে এসেছ?’ আইনউদ্দিন কিছু না বলে শুধু কাঁদতে থাকল। মা তখন গণভবনে সেনা কর্মকর্তাদের ফোন করতে থাকলেন। কিন্তু কেউই স্পষ্ট করে কিছু জানাচ্ছিল না। এভাবে দুপুর হয়ে গেল। জোহরের নামাজের সময় সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর ফোন এলো। তিনি ফোনে মাকে বললেন, ‘ভাবি, জামিল ভাই আর নেই।’ আমাদের মাথায় যেন তখন আকাশ ভেঙে পড়ল। দুপুরের দিকেই দুজন সেনা কর্মকর্তা আমাদের বাসায় এলেন। আমাদের তাঁরা লালমাটিয়ায় বড় চাচার বাসায় নিয়ে গেলেন। আমরা বাবার মরদেহের অপেক্ষায় রইলাম।”
যেভাবে নিহত হন কর্নেল জামিল
কর্নেল জামিলের গাড়িচালক আইনউদ্দিন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ২০ নম্বর সাক্ষী। তাঁর চোখের সামনেই নিহত হন কর্নেল জামিল। আইনউদ্দিনের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ভোর ৫টার দিকে তাঁর রুমের কলিং বেল বেজে ওঠে। তখন তিনি অজু করছিলেন। তাড়াতাড়ি বাসার সামনে গেলে কর্নেল জামিল ওপর থেকে দ্রুত গাড়ি তৈরি করতে এবং গণভবনে গিয়ে সব ফোর্সকে হাতিয়ার-গুলিসহ পাঁচ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ জানাতে বলেন। গণভবনে সৈনিকদের নির্দেশ জানিয়ে তিনি ফিরে এলে কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে রওনা হন। ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোডের মাথায় তাঁরা গণভবন থেকে আসা ফোর্সদের দেখেন। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছলে দক্ষিণ দিক থেকে শোঁ শোঁ করে গুলি আসতে থাকে। তখন ফোর্স অ্যাটাক করানোর কথা বললে কর্নেল জামিল বলেন, এটা ওয়ার-ফিল্ড নয়, ফোর্স অ্যাটাক করালে সিভিলিয়ানদের ক্ষতি হতে পারে।
তখন আইনউদ্দিনকে প্রতিপক্ষের অবস্থান জেনে আসতে নির্দেশ দিয়ে কর্নেল জামিল গাড়িতেই বসে থাকেন। আইনউদ্দিন যখন দেয়াল ঘেঁষে ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন পাঁচ-ছয়জন সেনা সদস্য দৌড়ে জামিলের গাড়ির দিকে যায়। তিনি (আইনউদ্দিন) হাতে ইশারা করে কর্নেল জামিলকে সরে যেতে বলেন। স্যার, স্যার বলে আওয়াজও করেন কয়েকবার। কিন্তু কর্নেল জামিল তাঁর দিকে তাকাননি।
কর্নেল জামিলকে হত্যার মুহূর্তের কথা জানিয়ে আইনউদ্দিন বলেন, ‘ওই সময় আর্মির অস্ত্রধারী লোকগুলো গাড়ির কাছে পৌঁছে যায়। কর্নেল জামিল দুই হাত উঠিয়ে তাদের কিছু বলার বা বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা দুই-তিনটি গুলি করলে কর্নেল জামিল মাটিতে পড়ে যান।’
রাইফেল তাক করে কান্না চাপাতে বাধ্য করা হয়
কর্নেল জামিলকে হত্যার পর তাঁর স্ত্রী, সন্তান, ভাইসহ ঘনিষ্ঠজনদের কান্নার অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছিল পথভ্রষ্ট সেনা সদস্যরা। সেদিন স্বজন হারানোর তাজা শোক বুকে নিয়েও মরদেহের সামনে শব্দ করে কাঁদতে পারেনি কর্নেল জামিলের পরিবার। উচ্চস্বরে কাঁদা বা হৈচৈ করা যাবে না—এ শর্তে রাজি হয়ে শহীদ জামিলের মরদেহ দেখতে পান স্বজনরা। লাশ দেখানোর সময় পাহারায় থাকা সেনা সদস্যরা রাইফেল তাক করে রেখে কান্না চাপাতে বাধ্য করে স্বজনদের।
আফরোজা জামিল বলেন, ‘আমরা লালমাটিয়ায় চাচার বাসায় বাবার লাশের অপেক্ষায় ছিলাম। বাবার লাশটিও ঘাতকরা আমাদের দেখতে দিতে চায়নি। একপর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর-উত্তমের মধ্যস্থতায় তারা আমাদের লাশটি দেখতে দিতে রাজি হয়। কিন্তু শর্ত বেঁধে দেয় লাশ দেখে কাঁদা যাবে না। শর্ত মেনে নিলে রাত সাড়ে ১১টায় একটি ল্যান্ডরোভার গাড়িতে করে বাবার লাশ লালমাটিয়ায় নিয়ে আসে। বাবাকে গাড়ির পেছনের সিটে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু গাড়িতে পুরো শরীর না ধরায় দুই পায়ের খানিকটা বেরিয়ে ছিল। অতি ফর্সা পা দেখেই আমরা বাবাকে চিনতে পারি। আমি বাবার পা ধরলাম। সেখান থেকে মরদেহ ঢাকা সেনানিবাসে খালেদ মোশাররফের বাসায় নেওয়া হয়। সেখানে স্বজনদের মরদেহ দেখতে দেওয়া হয়।’
শোক ও ভীতিকর সেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে আফরোজা জামিল বলেন, “আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে ছিল সেনা সদস্যরা। গভীর শোকে আচ্ছন্ন আমাদের কারো হাহাকার প্রকাশের অনুমতিও ছিল না। মার চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরতে থাকল। এমন সময় হুট করে আমার বড় বোন তনু হু হু করে কেঁদে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে এক সেনা সদস্য বলে উঠল, ‘কাঁদলেই শ্যুট করে দেব।’ ভয় পেয়ে কেউ একজন তনুকে ভেতরে নিয়ে যায়।”
জোটেনি কাফনের কাপড়, জানাজা
সেদিন পথভ্রষ্ট সেনা সদস্যরা শুধু বর্বর হত্যাকাণ্ড চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা নিহত ব্যক্তিদের লাশের প্রতিও নির্মমতা দেখিয়েছে। পদস্থ সেনা কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও সেদিন কর্নেল জামিলের জানাজা পড়ানো হয়নি, কাফনের কাপড়ের ব্যবস্থাও করা হয়নি। সেনা পাহারায় কোনো রকম গোসল করিয়ে, বিছানার চাদর দিয়ে মুড়িয়ে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাঁকে।
এ প্রসঙ্গে আফরোজা জামিল বলেন, ‘আমার চাচি আমেরিকা থেকে বিছানার একটা সাদা চাদর এনেছিলেন। তা দিয়েই বাবাকে সমাহিত করা হয়। বাবাকে ভালোমতো গোসলও করানো হয়নি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের স্ত্রী আজমির শরিফ থেকে আতর আর কিছু সুগন্ধি এনে বাসায় রেখেছিলেন। উনি সেগুলো দেন বাবাকে দাফনের আগে। দাফনের সময়ও রক্তে চাদর ভিজে যাচ্ছিল।’
বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র ছিলেন কর্নেল জামিল
১৯৭১ সালে পাকিস্তানে আটকা পড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র ছিলেন কর্নেল জামিল। আফরোজা জামিল বলেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময়ে বাবা আইএসআইয়ে কর্মরত ছিলেন। তখন বাবাসহ আরো দুজন কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যায়, এমন বেশ কিছু কাগজপত্র রমনা পার্কে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু দুজন অফিসারের মাধ্যমে জানতে পারেন। ১৯৭৩ সালে বাবা আমাদের নিয়ে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার সুযোগ পান। এয়ারপোর্টেই একজন সেনা কর্মকর্তা জানান, বাবাকে বঙ্গবন্ধু দেখা করতে বলেছেন। আমরা বাসায় চলে যাই আর বাবা সোজা চলে যান ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। সেখান থেকে বাসায় ফিরে বাবা জানান, বঙ্গবন্ধু বাবাকে তাঁর সঙ্গে থাকতে বলেছেন। তিনি বাবাকে সিকিউরিটি কমান্ড্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে বাবাকে সামরিক সচিব করেন। বঙ্গবন্ধু বাবাকে আস্থা-বিশ্বাসের যে জায়গায় স্থান দিয়েছিলেন, নিজের জীবন দিয়ে বাবা সেই আস্থার প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন।’
দুর্দিনেও রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব ফিরিয়েছেন আনজুমান আরা
১৫ আগস্টের মাসখানেক পর কর্নেল জামিলের স্ত্রী আনজুমান আরা বুঝতে পারেন তিনি সন্তানসম্ভবা। স্বামীর মৃত্যুর আট মাস পর জন্ম নেয় তাদের কনিষ্ঠ কন্যা কারিশমা জামিল। চার মেয়েকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েন আনজুমান আরা। এ সময়ে তিনি সুইডেনসহ কয়েকটি দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব পান। কিন্তু যে মাটিতে কর্নেল জামিলকে সমাহিত করা হয়েছে তা ছেড়ে যেতে রাজি হননি তিনি।
আফরোজা জামিল বলেন, “সে সময় বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব পাই। কিন্তু মা দেশ ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তিনি বলতেন, ‘আমরা দেশ ছেড়ে গেলে কর্নেল জামিলকে কেউ মনে রাখবে না।’ বাবার মৃত্যুর পর আমাদের নিয়ে মায়ের নতুন যুদ্ধ শুরু হয়। আমাদের কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। একবার আমার নানি ও আমাদের সঙ্গে নিয়ে মা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায় যান। সেখানে জিয়াউর রহমান আমাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন।”
বাবার মৃত্যুর পর নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলার কথা জানিয়ে আফরোজা জামিল বলেন, ‘১৯৭৯ সালে আমরা মোহাম্মদপুরে হুমায়ুন রোডের একটি বাসায় থাকতাম। একদিন হঠাৎ আমাদের বাসায় ডাকাতি হলো। টাকা-পয়সা, গহনার সঙ্গে বাবার স্মৃতিজড়িত প্রায় সব কিছুই ডাকাতরা নিয়ে গেল।’
বাবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে জানিয়ে আফরোজা জামিল বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই ভালো ছবি আঁকতে পারতাম। চিত্রকলা নিয়ে পড়তে আমাকে বাবা প্যারিসে পাঠাতে চেয়েছিলেন। আমার বড় বোনকে ডাক্তারি পড়তে রাশিয়ায় পাঠানোর স্বপ্ন ছিল বাবার। তাঁর মৃত্যুর পর আমাদের আর এসব স্বপ্ন পূরণ হয়নি।’
আক্ষেপ নিয়েই চলে গেছেন আনজুমান আরা
খানিকটা আক্ষেপ নিয়েই ২০১২ সালের নভেম্বরে চিরবিদায় নেন আনজুমান আরা। আফরোজা জামিল বলেন, “বাবা সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বের প্রতি অবিচল থেকে প্রাণ দিয়ে সেনাবাহিনীর সম্মানকে বাড়িয়ে গেছেন। তাই মা চাইতেন সেনাবাহিনী শহীদ জামিলকে যথাযথ সম্মান দিক। ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য যে কলঙ্কজনক ইতিহাস সৃষ্টি করে তা নিজের জীবন দিয়ে কিছুটা লাঘব করে গেছেন কর্নেল জামিল। মা প্রায়ই দুঃখ করে বলতেন, ‘জামিলের মৃত্যুর পর কতজনই তো সেনাপ্রধান হলো; কিন্তু একজন সেনাপ্রধানও তো জামিলের সমাধিতে গেল না। সেনাবাহিনী তো তাকে সম্মান জানাতে কিছু করল না।’”
আফরোজা জামিল বলেন, “মহাখালী ডিওএইচএসে আমাদের যে বাড়ি তা আমার মা এক সেনা কর্মকর্তার কাছ থেকে কিনেছেন। ঢাকায় আমাদের একটি জায়গাও দেওয়া হয়নি। মা বলতেন, ‘কর্নেল জামিলের মতো কর্মকর্তাদের সম্মান দিলে তরুণ কর্মকর্তারা উৎসাহিত হতো। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার সাহস ও অনুপ্রেরণা পেত এখনকার সেনা কর্মকর্তারা।’”
কর্নেল জামিলকে স্বীকৃতি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ সময় কর্নেল জামিলের আত্মদানকে মূল্যায়ন করা হয়নি। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে কর্নেল জামিলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা শুরু হয়। ১৯৯৭ সালে জামিলের পরিবারের উদ্যোগে গঠন হয় কর্নেল জামিল ফাউন্ডেশন। জামিলের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০০৯ সালে তাঁকে বীর-উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। সেনাবাহিনীও তাদের এই বীর সেনাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছে।
সংস্কৃতিমনা ছিলেন কর্নেল জামিল
আফরোজা জামিল বলেন, “বাবা ছিলেন সংস্কৃতিমনা। রবীন্দ্রসংগীত তাঁর ভীষণ পছন্দের ছিল। নিজেও রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ গানটি প্রায়ই গাইতেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে প্রায়ই গাইতেন ‘মায়াবন বিহারিনী’ গানটি। ফটোগ্রাফিরও শখ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণে গিয়ে কিনে এনেছিলেন ইয়াশিকা ম্যাট ক্যামেরা। তা দিয়েই ছবি তুলতেন।”
যেমন আছেন পরিবারের সদস্যরা
১৯৯৬ সালে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কর্নেল জামিল আহমেদের সহধর্মিণী আনজুমান আরা। ২০১২ সালের নভেম্বরে তিনি মারা যান। চার মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে তাহমিনা এনায়েত তনু ঢাকায় থাকেন। গ্যালারি কসমস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি। মেজ মেয়ে আফরোজা জামিল পেশায় চিত্রশিল্পী। তিনি তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজ, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। সেজ মেয়ে ফাহমিদা আহমেদ শ্বেতা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। আর সবার ছোট কারিশমা জামিল মেকআপ আর্টিস্ট। মহাখালী ডিওএইচএসে তাঁর ব্রাইডাল মেকআপের একটি প্রতিষ্ঠান আছে।
সম্পর্কিত খবর

স্থায়ী কমিটির বৈঠক
ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক নয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায় বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে নয় বিএনপি। এটিকে রাজনৈতিক দলিল হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়ে মত দিয়েছে দলটি। গত বুধবার রাতে দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। এরই আলোকে ঘোষণাপত্রের ওপর বিএনপির মতামতে এই দলিলকে আর্কাইভে (সংরক্ষণ) রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে বিএনপির কাছে পাঠানো জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে দলীয় মতামত চূড়ান্ত করতে বুধবার রাতে স্থায়ী কমিটির এ বৈঠক হয়। ওই রাতেই খসড়ায় প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন এনে তাতে চূড়ান্ত মতামত দিয়েছে বিএনপি। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান সংবিধানে স্থান দেওয়া হলে তাতে ভবিষ্যতে জটিলতা বাড়তে পারে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই ঘোষণাপত্র সংবিধানে যুক্ত করার দাবি তোলে।
স্থায়ী কমিটি বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নেতা বলেন, খসড়া ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলা হলেও বিএনপি তাতে দ্বিমত জানিয়েছে।
দলটির নেতারা বলেছেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই স্বাধীনতাযুদ্ধকেই প্রধান অর্জন হিসেবে উল্লেখ করে ঘোষণাপত্র শুরু হওয়া উচিত।
খসড়া ঘোষণাপত্রে আছে, ‘যেহেতু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শাসনামলের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনির্মাণের ব্যর্থতা ও অপর্যাপ্ত ছিল এবং এ কারণে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি’—বিএনপি এ ক্ষেত্রে ‘বিভিন্ন শাসনামলের জায়গায়’ ‘আওয়ামী শাসনামলের’ কথা উল্লেখ করেছে।
এ ছাড়া দলটি ১৯৭২ সালের ‘সংবিধান পুনর্লিখন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায়’ বাদ দিয়ে ‘সংবিধানের বিদ্যমান সংস্কার উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় সংশোধন’ করার পক্ষে মত দিয়েছে। জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের খসড়া থেকে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রসঙ্গটি বাদ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত জানুয়ারি মাসে প্রস্তুত করা ঘোষণাপত্রের খসড়ার শেষ অংশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ কথাটি উল্লেখ ছিল। জানা গেছে, এর বাইরেও খসড়ায় আরো কিছু শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন করেছে বিএনপি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। এ ঘোষণাপত্র নিয়ে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি কেন সামনে আনা হলো, এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং তখন এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে উল্লেখ করেছিল। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো তখন ওই খসড়ার ওপর তাদের মতামত দেয়। পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের দেওয়া সময়সীমা শেষ হওয়ার পরদিন গত ১৬ জানুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ইস্যুতে সরকারের কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকে। এনসিপি সম্প্রতি সরকারকে আগামী ৩ আগস্টের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় তাদের পক্ষ থেকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়।
সরকার ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। আর এটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকার যে প্রস্তাব দিয়েছিল, আমরা তার ওপর মতামত গতকাল (বুধবার) দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকার একটা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সব কার্যক্রম চালিয়েছে। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ’২৪-এর মহত্ত্ব ও গুরুত্বের প্রতি বিএনপি যথাযথ মর্যাদা দেয়। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ও বর্তমান সরকারকে বৈধতা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস স্থাপনের খসড়া অনুমোদন
বিশেষ প্রতিনিধি

ঢাকায় তিন বছরের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের একটি মিশন স্থাপনের বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের ৩৩তম বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। জানা গেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়’-এর মিশন স্থাপনসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ২৯ জুন ওই খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে তোলা হলে তাতে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
বৈঠকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মুসাপুর রেগুলেটর ও বামনি ক্লোজারের নকশা চূড়ান্তকরণ, ফেনীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চূড়ান্তকরণ এবং নোয়াখালীর খাল ও ড্রেনেজ অবমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও মহেশখালী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পাস হয়।
বৈঠকে ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হয়, যা লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিংয়ের পর কার্যকর হবে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘অপশনাল প্রোটোকল টু দ্য কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চারে (ওপি-ক্যাট)’ পক্ষভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মালয়েশিয়ার জোহর বাহরুতে বাংলাদেশের একটি নতুন কনস্যুলেট জেনারেল স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
বৈঠকে মহেশখালীকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের আওতায় আনতে ‘মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

মির্জা ফখরুল
দেশের মানুষ নির্বাচন চায়, তাহলে কেন হবে না?
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশে কেন নির্বাচন হবে না? দেশের মানুষ নির্বাচন চায়। নির্বাচিত প্রতিনিধি চায়। এ জন্য তারা জীবন দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পরিবর্তন হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনাসভায় তিনি এসব কথা বলেন। ‘ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সাংবাদিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনাসভাটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
অনুষ্ঠানে গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধীসহ জুলাই আন্দোলনে শহীদ ৬৪ জন সাংবাদিকের ওপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন ডিইউজের সহসভাপতি রাশেদুল হক। বিএফইউজের প্রয়াত সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর পরিবার এবং জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ছয় সাংবাদিকের পরিবারের হাতে সম্মাননা তুলে দেন বিএনপি মহাসচিব।
তাঁর এই বক্তব্যের জবাবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি খুব আশাবাদী মানুষ। অনেকে বলেছেন যে, হবে না। কেন হবে না? নির্বাচন তো এ দেশের মানুষ চায়, নির্বাচনের জন্য তো এ দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব কাজ গুছিয়ে ফেলতে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) নির্দেশ দিয়েছেন। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন এই কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গে শেষ করে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবেন। আমরা দাবি করছি, যেন এই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আপনাদের কি মনে হয় দেশে নির্বাচন হবে? অনেক মানুষ জিজ্ঞেস করে, নির্বাচন কি হবে? গতকাল প্রেস সেক্রেটারি যে বক্তব্য রাখলেন, তাতে কি মনে হয় নির্বাচন হবে? বেশির ভাগ মানুষ মনে করে নির্বাচন হবে না। তাহলে কী হবে? আমাদের ভাবনার দরকার আছে।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো নেই, দুঃশাসন কি বিদায় নিয়েছে? না। আমাদের আত্মতৃপ্তির কিছু নেই। আমাদের সামনে এখনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো বিরাজমান। রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা, দিল্লির আধিপত্যের কালো থাবা চতুর্দিকে ছেয়ে বসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতি-আন্তর্জাতিক নীতি-কূটনীতি ইভেন সামনের নির্বাচনে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে কিভাবে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া যায় তার চক্রান্ত এখনো বিদ্যমান।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘স্বৈরাচার পালিয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারী মানসিকতা বিরাজমান। আজকেও যদি দেখেন, এটা যদি না হতে পারে, ওটা হতে পারবে না। এ রকম বক্তব্য দিচ্ছেন আমাদের তরুণ নেতৃত্বের কতিপয় নেতা। আপনি আপনার চাহিদা বলতেই পারেন, এটা আপনার স্বাধীনতা। কিন্তু আপনি এটা বলতে পারেন না যে, এটা না হলে, ওইটাও হবে না। এই অধিকার আপনার নেই। এই মানসিকতা আর স্বৈরাচারের মানসিকতা একই।’
তিনি বলেন, ‘৬৪ জন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। মাহমুদুর রহমান, শফিক রেহমানের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা নিগৃহীত হয়েছেন। সংগ্রামের সম্পাদক আসাদ ভাই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধু লেখনীর কারণে। এখনো তো আপনাদের কণ্ঠে একই ধরনের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এটি কি ঠিক?’
বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘গত ১৭ বছরে সাংবাদিকদের ভূমিকা বর্তমান সরকার স্বীকার করতে চায় না। এই সরকারের যারা সুবিধাভোগী, তারা এক-দেড় মাস লড়াই করেছেন। আমরা সাংবাদিকরা ১৭টি বছর ঢাকার রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, অনেকে খুন হয়েছেন। তারপর স্বৈরাচারী সরকারের চূড়ান্ত পতনের জুলাই বিপ্লব এসেছে। সেখানে শুধু পেশাজীবী নয়, সাংবাদিকদেরও অবদান রয়েছে। আজকে মাঝে মাঝে কিছু শিশুকে দেখি সাংবাদিকদের হুমকি দিতে। তোমরা দেড় মাসের নেতা। আমরা ১৭ বছর লড়াই করে ফ্যাসিবাদের তক্ততাউস কাঁপিয়ে তুলেছিলাম। দেড় মাস নেতৃত্ব দিয়ে, ১৭ বছরের সংগ্রামকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তোমরা সাংবাদিকদের হুমকি দাও, এটা মেনে নেব না।’
অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠ সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ বলেন, ‘একটা ফ্যাসিবাদের ভাষা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটার নিন্দা করছি। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ, হুমকি দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করছি, সেটা খুবই অমঙ্গলসূচক। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। কোনোভাবে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, হুমকি দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা যায় না।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলমের সঞ্চালনায় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ইলিয়াস খান, এ কে এম মহসিন, ইরফানুল হক জাহিদ, সাঈদ খান, দিদারুল আলম, খন্দকার আলমগীর হোসেন ও প্রবাসী সাংবাদিক ইমরান আনসারী প্রমুখ।

‘ক্ষমা’ পেতে পারেন সাবেক আইজিপি
মেহেদী হাসান পিয়াস

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিচার শুরু হয়েছে। এ মামলায় অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হতে আবেদন করেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
গতকাল বৃহস্পতিবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আবেদনটি মঞ্জুর করে তাঁকে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করে সাক্ষ্য উপস্থাপনের অনুমতি দেন। এর পরই প্রশ্ন উঠেছে, মামুন কি রাজসাক্ষী হয়েছেন? হয়ে থাকলে তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে কী প্রতিকার পাবেন বা পেতে পারেন?
মামুনের দোষ স্বীকার
রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদে থেকে অপরাধ করায় শেখ হাসিনাকে এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে।
রাজসাক্ষী নিয়ে যা বলা আছে ট্রাইব্যুনাল আইনে?
এই মামলায় তিন আসামির বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ হত্যা, হত্যা চেষ্টা, ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এসব অপরাধের বিচার হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে। আইনটির ১৫ ধারায় ‘একজন রাজসাক্ষীর ক্ষমা’ বিষয়ে বলা আছে। ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘বিচারের যেকোনো পর্যায়ে, ধারা ৩-এ উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা গোপনে জড়িত বলে মনে করা হয় এমন যেকোনো ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণের উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল, অপরাধের সাথে সম্পর্কিত তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সকল ব্যক্তির কাছে, প্রধান বা সহায়তাকারী হিসেবে সম্পূর্ণ এবং সত্য প্রকাশ করার শর্তে, এই ক্ষমা প্রদান করতে পারে।’
২ উপধারায় বলা আছে, ‘এই ধারার অধীনে অভিযোগ গ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারে সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ আর ৩ উপধারায় ‘বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ব্যক্তিকে হেফাজতে আটক রাখা হবে’ বলা আছে।
রাজসাক্ষী হলে আইনের শর্ত পূরণ করতে হবে : রাজসাক্ষী হতে চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মামলায় আদালত তাঁকে সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সাক্ষ্য-জেরার পর আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে তিনি সব সত্যি বলেছেন, কোনো কিছু গোপন করেননি বা তাঁর সাক্ষ্যের পর প্রকৃত সত্য উদঘাটন হয়েছে, তখন আদালত তাঁকে রাজসাক্ষী হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারায় যেসব শর্তের কথা বলা আছে, সেই সব শর্ত তাঁকে পূরণ করতে হবে। শর্ত পূরণ করতে পারলে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করবেন। রাজসাক্ষী হতে পারলে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার আছে তাঁর অপরাধ ক্ষমা করার।’
প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ‘আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দোষ স্বীকার করেছেন ট্রাইব্যুনালের কাছে। তিনি বলেছেন, এই মামলার সম্পূর্ণ সত্যি এবং সব পরিস্থিতি তুলে ধরতে চান। এই মর্মে একটি আবেদনও দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল তাঁর আবেদনটি মঞ্জুর করেছেন এবং মামলার সাক্ষী হিসেবে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন।’
ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হওয়ার এটিই প্রথম নজির : প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ফৌজদারি অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে আর কোনো আসামি রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেননি। মামুনকে কারাগারে আলাদা সেলে রাখা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনি অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে রাজসাক্ষী হতে চেয়েছেন এবং যেসব আসামির বিরুদ্ধে তিনি বলতে পারেন বা তাঁর বক্তব্যে যেসব আসামির সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, সেসব আসামি তাঁকে বায়াস (পক্ষে আনার) করার চেষ্টা করতে পারেন, তাঁর নিরাপত্তার ঘাটতি হতে পারে, এই জন্য কারাগারে তিনি যেন আইসোলেটেড (বিচ্ছিন্ন) থাকেন অর্থাৎ আলাদা সেলে রাখা হয়, সেই আবেদন করেছেন। আবেদনটি মঞ্জুর করা হয়েছে।’ কারাগারে আলাদা সেলে থাকলেও সাবেক আইজিপি হিসেবে মামুন যে ডিভিশন সুবিধা পেয়ে আসছিলেন, তার বাইরে বাড়তি কোনো সুবিধা তিনি পাবেন না বলেও জানান প্রসিকিউটর তামিম।