<p>বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা, উগ্রবাদ ও সহিংস হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগার এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক হামলা বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের নজরে রয়েছে। গত শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হত্যার এক দিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মী জুলহাজ মান্নানকে তাঁর নিজ বাসায় বন্ধুসহ হত্যার ঘটনাকে মুক্তচিন্তা ও ভিন্নমত প্রকাশে উৎসাহ দেওয়া দেশগুলো অশনিসংকেত হিসেবে দেখছে। নিন্দা ও উদ্বেগের মিছিলে যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউস, পররাষ্ট্র দপ্তর, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) থেকে শুরু করে জাতিসংঘ, ২৮ দেশীয় ইউরোপীয় জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নরওয়ে, কানাডা, ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। অসহিষ্ণুতাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সহিংসতা বাড়ছে বলে সতর্ক করেছেন ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক। বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার ও বাক্স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাও। </p> <p>যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান সমকামী ও হিজড়া সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়েও সরব কর্মী ছিলেন। তিনি তাদের অধিকার বিষয়ে রূপবান নামের একটি সাময়িকী সম্পাদনা করতেন। উদ্বেগ জানানো দেশগুলোর প্রায় সবাই সমকামী ও হিজড়া সম্প্রদায়ের অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে। জুলহাজের ওই অধিকার আদায়ের উদ্যোগে পশ্চিমাদের আর্থিক সহায়তাও ছিল বলে জানা গেছে।</p> <p>জুলহাজ হত্যার পরপরই ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বিবৃতিতে এ ধরনের বর্বর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানান এবং অপরাধীদের ধরতে সর্বোচ্চ জোরালো ভাষায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বার্নিকাট আজ বুধবার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সে সময় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুর পাশাপাশি জুলহাজ হত্যার বিষয়েও আলোচনা হতে পারে।</p> <p>অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান হোয়াইট হাউসের : হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারির দপ্তর থেকে সোমবার রাতে বাংলাদেশ বিষয়ে জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঢাকায় বর্বর হামলায় জুলহাজ মান্নানের প্রাণহানির ঘটনার নিন্দা জানায়। কাণ্ডজ্ঞানহীন এই অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিচারের আওতায় আনা নিশ্চিত করতে আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানাই।’ হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি জন আরনেস্ট গতকাল রাতে সাংবাদিকদের জানান, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে এ ঘটনার তদন্তকে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) অগ্রাধিকার দিচ্ছে।</p> <p>জন কেরির বিবৃতি: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ঢাকায় আমাদের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের স্থানীয় কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধুকে বর্বরভাবে হত্যার নিন্দা জানাই। কাণ্ডজ্ঞানহীন এ ধরনের সহিংসতায় আমাদেরই একজনকে হারিয়ে আমরা অত্যন্ত মর্মাহত।’ তিনি আরো বলেন, ‘এসব হত্যার তদন্ত ও অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে আমরা বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতার প্রস্তাব দিচ্ছি।’</p> <p>ইউএসএআইডি প্রশাসক গেল্ স্মিথ বিবৃতিতে কাপুরুষোচিত এ হামলার নিন্দা জানান এবং হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানান।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ: বাংলাদেশ সময় গত সোমবার রাতে ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, ‘আমাদের দূতাবাস পরিবারের প্রিয় সদস্য, এলজিবিটিআই অধিকারের সাহসী প্রচারক জুলহাজ মান্নানের ওপর বর্বর হামলায় আমরা ক্ষুব্ধ। এটি অমার্জনীয় ও অসমর্থনযোগ্য।’ তিনি খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি সহযোগিতার অঙ্গীকার করেন।</p> <p>সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জন কিরবি বলেন, এ ধরনের হামলার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘হিউম্যানিটারিয়ান প্যারোলে’র আওতায় আশ্রয় দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এমন ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য দরজা বন্ধ করেনি। ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে আবেদন করতে পারেন এবং এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।</p> <p>সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। জবাবে জন কিরবি বলেন, দূতাবাস কর্মীদের নিরাপত্তা বিষয়ে তাঁরা প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেন না। তবে  বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের নজরে আছে। বাংলাদেশ যখন সামনে এগিয়ে চলছে তখন এ ধরনের ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র নির্দেশ করে।</p> <p>জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সামান্থা পাওয়ার গতকাল টুইট বার্তায় বলেন, জুলহাজ বাংলাদেশের একমাত্র এলজিবিটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস পরিবারের অংশ ছিলেন। সরকারকে অবশ্যই তাঁর নির্মম হত্যার জন্য দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।</p> <p>বিস্মিত জাতিসংঘ : ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ডি ওয়াটকিন্স গতকাল মঙ্গলবার বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে ভিন্নমত পোষণকারীদের ধারাবাহিক হত্যার আরেকটি ঘটনায় জাতিসংঘ বিস্মিত। বিস্তৃত পরিসরের এই সামাজিক কর্মীদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত এসব হামলা শেষ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতাকেন্দ্রিক সহিংসতা এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের লক্ষ্য করে হামলা বাড়ছেই।  তিনি আরো বলেন, ‘গত কয়েক দিনে আমরা যে ধরনের সহিংসতা ও বর্বর হামলা দেখেছি, তা সব দলীয় ও ধর্মীয় নেতাদের নিন্দা জানানো প্রয়োজন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অবশ্যই দ্রুত ও কার্যকর তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমে এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। দায়মুক্তি অসহিষ্ণু পরিবেশের জন্য কেবল সহায়কই হবে এবং এ ধরনের আরো ঘটনার জন্ম দেবে।’</p> <p>নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান ইইউয়ের : ব্রাসেলস থেকে গত রাতে প্রকাশিত বিবৃতিতে ইইউ বাংলাদেশ সরকারকে তার নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে। বিবৃতিতে ইইউ মুখপাত্র বলেন, ঢাকায় গত সোমবার দুজন বাংলাদেশি এলজিবিটিআই কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এটি ছিল তৃতীয় হামলা।</p> <p>ইইউ মনে করে, এসব হত্যার পূর্ণ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা নিশ্চিত করা উচিত। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইইউ আশা করে, বাংলাদেশ সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে দেখবে এবং একে সম্মান জানানো নিশ্চিত করবে।’</p> <p>খুনিদের বিচারের আওতায় আনার তাগিদ যুক্তরাজ্যের : ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দপ্তরের মন্ত্রী হুগো সোয়্যার গতকাল টুইটার বার্তায় বলেন, ‘জুলহাজ মান্নান, তনয় ও অধ্যাপক করিমের নির্মম হত্যার ঘটনায় আমরা গভীর মর্মাহত। হত্যাকারীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।’</p> <p>বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের সাবেক হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন গত সোমবার রাতে টুইটার বার্তায় বলেন, ‘আমার বন্ধু ও মানবাধিকারকর্মী জুলহাজকে নিমর্মভাবে হত্যার নিন্দা জানাই। অপরাধীকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।’</p> <p>দ্রুত ও পূর্ণ তদন্তের আহ্বান জার্মানির : জুলহাজ ও তনয় হত্যার বিষয়ে ঢাকায় জার্মানির রাষ্ট্রদূত ড. থমাস প্রিঞ্জ গতকাল বিবৃতিতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এটি দুই সাহসী ব্যক্তির ওপর হামলাই নয়, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপরও হামলা। এ ঘটনায় দ্রুত ও পূর্ণ তদন্ত নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমি বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানাই। বিগত মাসগুলোতে আমরা এ ধরনের অনেক ঘটনা দেখেছি। তাই পুরো সমাজেরই এখন জেগে ওঠার এবং মত প্রকাশের মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার সময় এসেছে।’</p> <p>সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান ডেনমার্কের : ঢাকায় ড্যানিশ চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জ্যাকব হগার্ড গতকাল বিবৃতিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ব্যক্তি বিশেষের ওপর ক্রমবর্ধমান হামলা ও সাম্প্রতিক হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। তিনি জোরালো ভাষায় এসব বর্বরতার নিন্দা জানান এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারকে কঠোর অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। </p> <p>নিরাপত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ মনে করছে অ্যামনেস্টি : বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষকে যথাযথ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক চম্পা প্যাটেল। গত সোমবার সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জুলহাজ, তাঁর বন্ধু তনয় এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশে নিরাপত্তার কতটুকু অভাব রয়েছে।</p> <p>দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধ চায় এইচআরডাব্লিউ : মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত রাতে বিবৃতিতে বাংলাদেশে দুই এলজিবিটি মানবাধিকারকর্মী হত্যার দ্রুত তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, কর্মীদের সুরক্ষা করতে এবং এ ধরনের হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি বন্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।</p> <p>সিপিজের নিন্দা : সাংবাদিকদের সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী কাজ করা সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস জুলহাজ হত্যার নিন্দা জানিয়েছে এবং দ্রুত অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।</p>