<div> যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যা মামলায় ১২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে র‌্যাব। এজাহারভুক্ত ও পরে আটক ৯ আসামিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদনও করা হয়েছে। হত্যার পর থেকে আলোচনায় থাকা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও এজাহারভুক্ত কয়েকজন আসামি ‘রাজনৈতিক কারণে’ চার্জশিট থেকে বাদ পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মামলার বাদীসহ নিহত মিল্কীর স্বজনরা এ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে র‌্যাব দাবি করেছে, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে এজাহারনামীয়দের মধ্যে কয়েকজন চার্জশিটভুক্ত হননি। এর বাইরে কোনো কারণ নেই।</div> <div> অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত হননি মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও যুবলীগ দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহেদুল ইসলাম আরিফসহ ৯ জন। জাহিদুল ও ওয়াহেদুল মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন।</div> <div> গত বছরের ২৯ জুলাই যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে রাজধানীর গুলশানে একটি শপিং কমপ্লেক্সের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১ আগস্ট মিল্কী হত্যা মামলার তদন্তভার পায় র‌্যাব। প্রায় আট মাস তদন্ত শেষে গতকাল মঙ্গলবার র‌্যাব-১-এর সহকারী পুলিশ সুপার কাজেমুর রশিদ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তারেক মঈনুল ইসলাম ভুঁইয়া অভিযোগপত্রটি নথিতে অন্তর্ভুক্ত করার আদেশ দেন। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন এস এম জাহিদ সিদ্দিকী ওরফে তারেক ওরফে কিলার তারেক (ঘটনার পরদিন বন্দুকযুদ্ধে নিহত), শাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল, মিল্কীর ড্রাইভার মারুফ রেজা সাগরের স্ত্রী ফাহিমা ইসলাম লোপা, জাহাঙ্গীর মণ্ডল, শহিদুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম ওরফে হাবিব, সোহেল মাহমুদ, চুন্নু মিয়া, মো. আরিফ, ইব্রাহিম খলিলউল্লাহ, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ও শরিফ উদ্দিন চৌধুরী প্রকাশ পাপ্পু। আসামিদের মধ্যে মূল আসামি তারেক ঘটনার পরদিন র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। শাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল, মো. আরিফ, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী এবং শরিফ উদ্দিন চৌধুরী প্রকাশ পাপ্পু পলাতক রয়েছেন। লোপা জামিনে আছেন। অন্যরা কারাগারে।</div> <div> চার্জশিট নিয়ে সংক্ষুব্ধ বাদী : নিহত মিল্কীর  ভাই  ও মামলার বাদী মেজর রাশেদুল হক খান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘অভিযোগপত্র নিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আমিও সংক্ষুব্ধ। উদ্দেশ্যমূলকভাবে মূল পরিকল্পনাকারীদের বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। প্রভাবশালী একটি পক্ষ মামলা ধামাচাপা দিতে এ চেষ্টা করছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাহিদুল ও ওয়াহেদুলকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমার ভাই হত্যার পরিকল্পনায় ছিলেন জাহিদুল। আর ঘটনার সময় আশপাশে ছিলেন ওয়াহেদুল। অথচ তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হলো। আমরা এ চার্জশিট মানি না। আমরা অচিরেই এ অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেব।’ প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে মেজর রাশেদুল হক গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে মোবাইল ফোনে এ কথা বলেন।</div> <div> মামলার প্রধান তদারক কর্মকর্তা র‌্যাব-১-এর পরিচালক কিসমৎ হায়াৎ বলেন, ‘দীর্ঘ আট মাস তদন্তের পর সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া না যাওয়ায় এজাহারভুক্ত আসামি জাহিদুল ইসলাম টিপু ও ওয়াহেদুল ইসলামসহ ৯ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।’</div> <div> এতে নিহতের পরিবারের অসন্তুষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কিসমৎ হায়াৎ বলেন, ‘তদন্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে কেউ যদি নারাজি দিতে চায় সেটা তাদের ব্যাপার। এ নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া চার্জশিটে কারো নাম অন্তর্ভুক্ত করা হলে তাতে মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তদন্তকালে যাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে তাদেরকেই আসামি হিসেবে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। সেখানে যেমন এজাহারনামীয় আসামি বাদ পড়েছেন, তেমনি এজাহারের বাইরেও অনেকের নাম যুক্ত হয়েছে।’</div> <div> অভিযোগপত্র : অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মিল্কী ও আসামি তারেক (পরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত) একত্রে মতিঝিল এজিবি কলোনি এলাকায় রাজনীতি করতেন। মিল্কী ঢাকা মহানগরের (দক্ষিণ) সাংগঠনিক সম্পাদক ও তারেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সাংগঠনিক পদ, জমি দখল ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ ভাগ-বণ্টন বিষয়ে তাঁদের মধ্যে চাপা বিরোধ চলছিল। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মতিঝিল ১০ নম্বর ওয়ার্ডে মিল্কী কমিশনার পদপ্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। একপর্যায়ে তাঁদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। তখন থেকে এলাকায় যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মিল্কী ও তারেকের পক্ষে আলাদা আলাদা মিছিল-মিটিং হতো। অন্যদিকে তারেক ও আসামি চঞ্চলের মধ্যে ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন বিষয়ে অতি ঘনিষ্ঠতার দরুন চঞ্চল তারেকের পক্ষ নিয়ে মিল্কীকে ঘায়েল করার পরিকল্পনা করতে থাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারেক আগে থেকেই ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয়। ভিডিও ফুটেজ, জব্দকৃত আলামত, সাক্ষীর জবানবন্দি ও আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির আলোকে প্রমাণিত হয় তারেকের নেতৃত্বে একই উদ্দেশ্যে পরস্পর সহযোগিতায় আসামি তারেক (মৃত), আমিনুল ইসলাম, সোহেল মাহমুদ, আরিফ, চুনু ও চঞ্চল সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে পিস্তল ও রিভলবার দিয়ে গুলি করে মিল্কীকে হত্যা করে। এবং আসামি লোপা, শহিদুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর মণ্ডল, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, ইব্রাহিম খলিলউল্লাহ হত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। কিলার তারেককে পালাতে সহায়তা করে শরীফ পাপ্পু।</div> <div> ৯ আসামির অব্যাহতির আবেদন : তদন্তকালে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ও এজাহারভুক্ত ৯ আসামিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। তাঁরা হলেন তুহিনুর রহমান ফাহিম, সৈয়দ মোস্তফা আলী প্রকাশ রুমি, মো. রাশেদ মাহামুদ, সাইদুল ইসলাম ওরফে নুরুজ্জামান, মো. সুজন হাওলাদার, জাহিদুল ইসলাম টিপু, ওহিদুল আলম আরিফ ভুঁইয়া, ডা. দেওয়ান মো. ফরিউদ্দৌলা এবং মাহবুবুল হক হীরক।</div> <div> স্বীকারোক্তি : আসামিদের মধ্যে জাহাঙ্গির মণ্ডল, সোহেল মাহমুদ, লোপা, চুন্নু মিয়া, মাহবুবুল হক হীরক, আমিনুল ইসলাম ওরফে হাবিব গত ১১ ফেব্রুয়ারি দোষ স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এ ছাড়া মিল্কীর গাড়িচালক মারুফ রেজা সাগর সাক্ষী হিসেবে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। অভিযোগপত্রে ২৬ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। আলামত হিসেবে ১১ ধরনের জিনিসপত্র জব্দ দেখানো হয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ রাউন্ড গুলির খোসা, সিসি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক, পাঞ্জাবি, জিন্স প্যান্ট, আন্ডারওয়্যার, চারটি ব্যবহৃত গুলি, মোবাইল ফোন, শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পেশেন্ট রেজিস্ট্রার ও একটি সিলভার রঙের প্রাডো গাড়ি রয়েছে।</div> <div> প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র-সংক্রান্ত পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিধি অনুযায়ী ওই দিন অভিযোগপত্রভুক্ত পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হবে।</div> <div> গত ২৯ জুলাই রাতে গুলশান-১-এর শপার্স ওয়ার্ল্ড মার্কেটের সামনে ঘটা হত্যাকাণ্ডটির দৃশ্য ধরা পড়ে শপার্স ওয়ার্ল্ডের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায়। পরদিন গুলশান থানায় মিল্কীর ছোট ভাই হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে যুবলীগ নেতা তারেক, জাহিদুল ইসলাম টিপু, চঞ্চল ও আরিফসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।</div>