তৃতীয় অধ্যায় : ভারত উপমহাদেশে মুঘল শাসন
অনুধাবনমূলক প্রশ্ন
[পূর্বপ্রকাশের পর]
৫। দস্তুরুল আমল কী? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : শাসনব্যবস্থায় অনাচার রোধ এবং শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা রক্ষায় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১২টি বিধি জারি করেন, যা ‘দস্তুরুল আমল’ নামে পরিচিত।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় (শাসনকাল : ১৬০৫-১৬২৭ খ্রি.) সাম্রাজ্যে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দিয়েছিল, যা জনমতে ভীতি সৃষ্টি করেছিল।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনি কিছু আইনি বিধান চালু করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—বিভিন্ন ধরনের শুল্ক রহিতকরণ, মাদকদ্রব্য তৈরি ও বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নির্ণয়, চুরি ও ডাকাতি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা, রবিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে পশুহত্যা নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি।
৬। কবুলিয়ত ও পাট্টা বলতে কী বুঝ? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : শেরশাহ প্রজাদের সঙ্গে সরকারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে জমিদারি প্রথা লোপ এবং রায়তওয়ারি প্রথা প্রবর্তন করেন। ভূমি ব্যবস্থাপনায় ‘কবুলিয়ত’ ও ‘পাট্টা’ প্রথা প্রচলন তাঁর অনবদ্য উদ্ভাবন। পাট্টা ছিল জমির স্বত্ব দলিল। জমির ওপর কৃষকের অধিকার ও স্বত্ব স্বীকার করে সরকারের পক্ষ থেকে পাট্টা দেওয়া হতো।
অন্যদিকে প্রদেয় করসহ ভূমিতে তার দায় ও কর্তব্য বর্ণনা করে কৃষক রাষ্ট্রকে কবুলিয়ত নামক দলিল সম্পাদন করে দিতেন।
৭। বাবরনামা কী? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : ‘বাবরনামা’ হচ্ছে সম্রাট বাবরের আত্মজীবনীমূলক ঐতিহাসিক একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। তিনি গদ্য সাহিত্যে তুর্কি ভাষায় একটি রচনা করেন।
এ গ্রন্থে বাবর তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা, তাঁর জন্ম, শৈশব ও কৈশোরের কথা উল্লেখ করেছেন। এ গ্রন্থে বাবর তাঁর বোকামি ও ব্যর্থতাগুলো অকপটে তুলে ধরেছেন। এ আত্মজীবনীতে ভারতের আবহাওয়া, পরিবেশ, ফলমূল ও মানুষের বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করেছেন।
৮। ‘ময়ূর সিংহাসন’ কী? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : পৃথিবীর বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন সম্রাট শাহজাহানের নির্মিত অনুপম শিল্পকীর্তির অন্যতম। শিল্পী বেবাদল খানের তত্ত্বাবধানে প্রায় আট কোটি টাকা ব্যয়ে সাত বছরে এ সিংহাসনটি নির্মিত হয়েছিল। সিংহাসনের স্বর্ণ নির্মিত চারটি স্তম্ভের ওপর একটি কারুকার্যমণ্ডিত চন্দ্রাতপ ছিল। প্রতিটি স্তম্ভ শীর্ষে মুখোমুখি বসানো একজোড়া ময়ূর স্থাপন করা হয়েছিল। এদের মাঝখানে ছিল বহু মূল্যবান মণিমুক্তাখচিত ফলবান বৃক্ষ। সিংহাসনে ওঠার জন্য মণিমুক্তাখচিত তিন ধাপ বিশিষ্ট একটি সিঁড়ি ছিল। এটি দৈর্ঘ্যে ৩.৫ গজ, প্রস্থে ২.৫ গজ এবং উচ্চতায় ছিল ৫ গজ। অনিন্দ্যসুন্দর ও মূল্যবান এই ময়ূর সিংহাসনটি সম্রাট শাহজাহানের সৌন্দর্যজ্ঞান ও ঐশ্বর্যের উজ্জ্বলতম নিদর্শন। ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমণকালে ময়ূর সিংহাসনটি নিয়ে যান।
৯। ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ বলতে কী বুঝ? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : সম্রাট আকবর ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নতুন ধর্মমত দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রবর্তন করেন। এ ধর্মমতের কালেমা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আকবারু খলিফাতুল্লাহ।’ দ্বীন-ই-ইলাহীর ধর্মমতে দীক্ষিত হতে হলে একজনকে সম্রাটের নামে জীবন, ধর্ম, সম্মান ও সম্পত্তি উৎসর্গ করতে হতো এবং সম্রাটকে সেজদা করতে হতো। এ ছাড়া তাঁর প্রবর্তিত দ্বীন-ই-ইলাহীর সেজদা প্রথা, অগ্নিকে পবিত্র মনে করা, প্রাসাদে রাজপুত স্ত্রীদের পূজার অনুমতি প্রদান ইত্যাদি ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ ধর্মের অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো।
১০। সম্রাট আওরঙ্গজেবকে ‘জিন্দাপীর’ বলা হয় কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : ধর্মভীরুতার কারণে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে ‘জিন্দাপীর’ বলা হয়। সম্রাট আওরঙ্গজেব একজন নিষ্ঠাবান সুন্নি মুসলিম শাসক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিনি তৎকালীন সমাজের সব অপরাধ থেকে মুক্ত ছিলেন। মদ সেবন থেকে দূরে থাকতেন। তিনি কোরআন শরীফ নকল করে আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের কাছে বিক্রি করতেন। তিনি নামাজ আদায়ে যত্নবান ছিলেন। এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও নামাজ আদায় করতেন। তাঁর এই ধর্মভীরুতার জন্যই তাঁকে ‘জিন্দাপীর’ বলা হতো।
১১। মুঘলদের পরিচয় ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : ‘মোঙ্গ’ শব্দ থেকে মোঙ্গল এবং মোঙ্গল থেকে মুঘল নামের উৎপত্তি ঘটেছে। তাঁরা আদি বাসভূমি মঙ্গোলিয়া ছেড়ে মধ্য এশিয়ার পশ্চিম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে মুঘল নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘলরা ভারতের সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ভারতবর্ষের শাসক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত এর পর থেকেই মুঘলরা একটি বৃহৎ জাতি গঠনে অবদান রাখতে শুরু করেন।