ঢাকা, বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫
৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫
৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মহররম ১৪৪৭

এইচএসসির প্রস্তুতি : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি দ্বিতীয় পত্র

  • শিকদার মো. শহিদুল ইসলাম, প্রভাষক, ফজিলা রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজ, নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি), পিরোজপুর
শেয়ার
এইচএসসির প্রস্তুতি : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি দ্বিতীয় পত্র
সম্রাট বাবরের আত্মজীবনীমূলক ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘বাবারনামা’। ছবি : সংগৃহীত

তৃতীয় অধ্যায় : ভারত উপমহাদেশে মুঘল শাসন

অনুধাবনমূলক প্রশ্ন

[পূর্বপ্রকাশের পর]

৫।         দস্তুরুল আমল কী? ব্যাখ্যা করো।

  উত্তর : শাসনব্যবস্থায় অনাচার রোধ এবং শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা রক্ষায় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১২টি বিধি জারি করেন, যা দস্তুরুল আমল নামে পরিচিত।

  সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় (শাসনকাল : ১৬০৫-১৬২৭ খ্রি.) সাম্রাজ্যে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দিয়েছিল, যা জনমতে ভীতি সৃষ্টি করেছিল।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনি কিছু আইনি বিধান চালু করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেবিভিন্ন ধরনের শুল্ক রহিতকরণ, মাদকদ্রব্য তৈরি ও বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নির্ণয়, চুরি ও ডাকাতি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা, রবিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে পশুহত্যা নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি।

৬।         কবুলিয়ত ও পাট্টা বলতে কী বুঝ? ব্যাখ্যা করো।

  উত্তর : শেরশাহ প্রজাদের সঙ্গে সরকারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে জমিদারি প্রথা লোপ এবং রায়তওয়ারি প্রথা প্রবর্তন করেন। ভূমি ব্যবস্থাপনায় কবুলিয়তপাট্টা প্রথা প্রচলন তাঁর অনবদ্য উদ্ভাবন। পাট্টা ছিল জমির স্বত্ব দলিল। জমির ওপর কৃষকের অধিকার ও স্বত্ব স্বীকার করে সরকারের পক্ষ থেকে পাট্টা দেওয়া হতো।

অন্যদিকে প্রদেয় করসহ ভূমিতে তার দায় ও কর্তব্য বর্ণনা করে কৃষক রাষ্ট্রকে কবুলিয়ত নামক দলিল সম্পাদন করে দিতেন।

৭।         বাবরনামা কী? ব্যাখ্যা করো।

  উত্তর : বাবরনামা হচ্ছে সম্রাট বাবরের আত্মজীবনীমূলক ঐতিহাসিক একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।‌ তিনি গদ্য সাহিত্যে তুর্কি ভাষায় একটি রচনা করেন।

এ গ্রন্থে বাবর তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা, তাঁর জন্ম, শৈশব ও কৈশোরের কথা উল্লেখ করেছেন। এ গ্রন্থে বাবর তাঁর বোকামি ও ব্যর্থতাগুলো অকপটে তুলে ধরেছেন। এ আত্মজীবনীতে ভারতের আবহাওয়া, পরিবেশ, ফলমূল ও মানুষের বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করেছেন।

৮।‌         ময়ূর সিংহাসন কী? ব্যাখ্যা করো।

  উত্তর : পৃথিবীর বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন সম্রাট শাহজাহানের নির্মিত অনুপম শিল্পকীর্তির অন্যতম। শিল্পী বেবাদল খানের তত্ত্বাবধানে প্রায় আট কোটি টাকা ব্যয়ে সাত বছরে এ সিংহাসনটি নির্মিত হয়েছিল। সিংহাসনের স্বর্ণ নির্মিত চারটি স্তম্ভের ওপর একটি কারুকার্যমণ্ডিত চন্দ্রাতপ ছিল। প্রতিটি স্তম্ভ শীর্ষে মুখোমুখি বসানো একজোড়া ময়ূর স্থাপন করা হয়েছিল। এদের মাঝখানে ছিল বহু মূল্যবান মণিমুক্তাখচিত ফলবান বৃক্ষ। সিংহাসনে ওঠার জন্য মণিমুক্তাখচিত তিন ধাপ বিশিষ্ট একটি সিঁড়ি ছিল। এটি দৈর্ঘ্যে ৩.৫ গজ, প্রস্থে ২.৫ গজ এবং উচ্চতায় ছিল ৫ গজ। অনিন্দ্যসুন্দর ও মূল্যবান এই ময়ূর সিংহাসনটি সম্রাট শাহজাহানের সৌন্দর্যজ্ঞান ও ঐশ্বর্যের উজ্জ্বলতম নিদর্শন। ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমণকালে ময়ূর সিংহাসনটি নিয়ে যান।

৯।         দ্বীন-ই-ইলাহী বলতে কী বুঝ? ব্যাখ্যা করো।

  উত্তর : সম্রাট আকবর ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নতুন ধর্মমত দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রবর্তন করেন। এ ধর্মমতের কালেমা ছিল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আকবারু খলিফাতুল্লাহ। দ্বীন-ই-ইলাহীর ধর্মমতে দীক্ষিত হতে হলে একজনকে সম্রাটের নামে জীবন, ধর্ম, সম্মান ও সম্পত্তি উৎসর্গ করতে হতো এবং সম্রাটকে সেজদা করতে হতো। এ ছাড়া তাঁর প্রবর্তিত দ্বীন-ই-ইলাহীর সেজদা প্রথা, অগ্নিকে পবিত্র মনে করা, প্রাসাদে রাজপুত স্ত্রীদের পূজার অনুমতি প্রদান ইত্যাদি ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ ধর্মের অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো।

১০।        সম্রাট আওরঙ্গজেবকে জিন্দাপীর বলা হয় কেন? ব্যাখ্যা করো।

  উত্তর : ধর্মভীরুতার কারণে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে জিন্দাপীর বলা হয়। সম্রাট আওরঙ্গজেব একজন নিষ্ঠাবান সুন্নি মুসলিম শাসক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিনি তৎকালীন সমাজের সব অপরাধ থেকে মুক্ত ছিলেন। মদ সেবন থেকে দূরে থাকতেন। তিনি কোরআন শরীফ নকল করে আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের কাছে বিক্রি করতেন। তিনি নামাজ আদায়ে যত্নবান ছিলেন। এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও নামাজ আদায় করতেন। তাঁর এই ধর্মভীরুতার জন্যই তাঁকে জিন্দাপীর বলা হতো।

১১।        মুঘলদের পরিচয় ব্যাখ্যা করো।

  উত্তর : মোঙ্গ শব্দ থেকে মোঙ্গল এবং মোঙ্গল থেকে মুঘল নামের উৎপত্তি ঘটেছে। তাঁরা আদি বাসভূমি মঙ্গোলিয়া ছেড়ে মধ্য এশিয়ার পশ্চিম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে মুঘল নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘলরা ভারতের সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ভারতবর্ষের শাসক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত এর পর থেকেই মুঘলরা একটি বৃহৎ জাতি গঠনে অবদান রাখতে শুরু করেন।

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ছোট পাখি, ছোট পাখি... সর্বনাশ হয়ে গেছে

শেয়ার
ছোট পাখি, ছোট পাখি... সর্বনাশ হয়ে গেছে

শেখ হাসান, চিফ ফটো জার্নালিস্ট, কালের কণ্ঠ

দুপুর একটা দশ কিংবা পনেরো মিনিট হবে, হঠাৎ খবর এলো একটা জেট বিমান ক্র্যাশ করেছে। হ্যাঁ, ততক্ষণে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। আমাদের ছোট ছোট পাখিগুলো আগুনে ঝলসে ছটফট করছে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি বিল্ডিংয়ে আগুন ধরেছে।

খবর পেয়েই ছুটে গেলাম স্পটে। সেখানে পৌঁছাই দুপুর দুইটার পর। যখন হাউজ বিল্ডিং এলাকায় পৌঁছাই, তখন অনেকে বলছিল, ও দিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। কথা না শুনেই এগিয়ে গেলাম।
একটু সামনে যেতেই দেখলাম, ছাত্র, সাধারণ মানুষ সবাই মিলে রাস্তার দু’পাশ সরিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে। আরও প্রায় ৫০০ গজ যেতেই আর মোটরসাইকেল চালানো যাচ্ছিল না। বাইকটা রাস্তার পাশে রেখে হাঁটা শুরু করলাম। প্রথমে বোঝা গেল না বিমানটা কোথায় পড়েছে! একটা আন্ডারকনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ে উঠে গেলাম টপ শট নেব বলে, কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম বিমানটা কোথায় পড়েছে? তারা দূরের দোতলা বিল্ডিংয়ের দিকে ইশারা করলো। ওখান থেকে নেমে পাশের বিল্ডিংটির পেছন দিকে গিয়ে দেখি উদ্ধারকর্মীরা দেওয়াল ভেঙে হতাহতদের বের করার চেষ্টা করছে। দ্রুত সেসব ছবি তুলে নিলাম। বিমানটা সরাসরি ক্লাসরুমে ঢুকে পড়েছে। সামান্য অংশই কেবল বাইরে ছিল।
আমি পৌঁছানোর আগেই আগুন নেভানো হয়েছে। চারদিকে মানুষে ঠাসা। সবার মুখে আতঙ্ক আর কান্না।  বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত স্পটে ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে আহতদের সরাসরি চোখে দেখিনি, যাদের দেখেছি তারা উদ্ধারকর্মী, বা অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তারা কেউ ঠিকভাবে কথা বলার অবস্থায়ও ছিলেন না। বারবার অ্যাম্বুলেন্স আসা-যাওয়া করছিল, বোঝা যাচ্ছিল না, প্রতিটিতে কতজন করে নেওয়া হচ্ছে। কয়েকজনকে দেখেছি সন্তানকে খুঁজছে আর কাঁদছে, চারপাশ ভারী হয়ে উঠছিল। কয়েকজনের ছবি নিয়েছি, কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে তো আর তাদের সঙ্গে কথা বলা যায় না।

ফেরার পথে এক ছাত্র অনুরোধ করলো “ভাইয়া, আমাদের বাংলাদেশ মেডিকেলে নামিয়ে দিতে পারবেন?” রাজি হয়ে গেলাম। তখন আরেকটি ছেলেও সঙ্গে এলো। এমন পরিস্থিতিতে তাদের নিয়ে হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দিই।

 

অনুলিখন: অলকানন্দা রায়

 

 

 

মন্তব্য

কখন কী ঘটল

শেয়ার
কখন কী ঘটল

জুলাই ২১, ২০২৫

দুপুর ১টা ৬ মিনিট : বিমানবাহিনীর ঘাঁটি বীর উত্তম এ কে খন্দকার থেকে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম যুদ্ধবিমান এফ-৭ বিজিআই নিয়ে উড্ডয়ন করেন।

 

দুপুর ১টা ১২ মিনিট : মধ্যাকাশে বিমানটিতে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়। পাইলটের সর্বাত্মক চেষ্টার পরও বিমানটি উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে আছড়ে পরে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, বিমানটির সামনের অংশ সরাসরি দোতলা ভবনটির দ্বিতীয় তলায় আঘাত করে।

 

দুপুর ১টা ৪০ (আনুমানিক) : উত্তরা, টঙ্গী, পল্লবী, কুর্মিটোলা, মিরপুর, পূর্বাচল ফায়ার স্টেশনের ৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করে।

 

দুপুর ২টা ১৫ (আনুমানিক) : ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকার্যক্রম শুরু করে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি এবং পুলিশ।

 

বিকেল ৩টা ১০ (আনুমানিক) : পাইলটসহ মোট ৫ জনকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারযোগে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়।

 

বিকেল ৪টা : প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ২২ জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়।

 

বিকেল ৫টা : আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, পাইলট লে. মো. তৌকির ইসলাম মারা গেছেন। তখন পর্যন্ত ১৯জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়, ১৭১জন আহত ব্যক্তি ৮টি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

 

রাত ৯টা ১০ মিনিট : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধারকার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে।

 

জুলাই ২২, ২০২৫

রাত ২টা : মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করে।

 

সকাল ১০টা ৩০ মিনিট : মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে যান শিক্ষা ও আইন উপদেষ্টা । শিক্ষার্থীরা গাফিলতির অভিযোগ তুলে তাদের ঘিরে বিক্ষোভ করে।

 

দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট : জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ২৭ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। চিকিৎসাগ্রহনকারী আহতদের সংখ্যা কমে ৭৮জনে নেমে এসেছে বলে জানান।  ৬জনের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি, ২০জনের মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

 

বিকেল ৩টা : প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিকটস্থ উত্তরা সেক্টর ১২তে অবস্থিত সিটি কর্পোরেশন কবরস্থানে দূর্ঘটনায় নিহতের দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

বিকেল ৪টা : দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ডে বাবা-মা বা অভিভাবকের ফোন নম্বর সংযুক্ত করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ব্লাড গ্রুপও সংযুক্ত করতে বলা হয়।

 

এস এম তাহমিদ

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

‘থাকব না আর এই দেশে’

শেয়ার
‘থাকব না আর এই দেশে’
এ এফ এম ইউসুফ, সায়ানের বাবা ও শিক্ষক

সহকারী অধ্যাপক এ এফ এম ইউসুফ ও শিক্ষক শামীমা শাম্মী—মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক দুজনই। বাবা-মায়ের স্কুলেরই ছাত্র তাঁদের দুই সন্তান। সপ্তম শ্রেণিতে পুত্র সায়ান ইউসুফ আর তৃতীয় শ্রেণিতে ছোট্ট ফারিসা। সোমবারের ট্রাজেডিতে নিজেদের ১৪ বছর বয়সী পুত্র সন্তানকে হারালো এই শিক্ষক দম্পতি।

ফারিসা হারালো তার বড় ভাইকে।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের বশিকপুর গ্রামের পাল বাড়ির বাসিন্দা তাঁরা। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে ভাড়া বাসায় থাকতেন শিক্ষক দম্পতি। সন্তান হারানোর শোকে হতবিহ্বল বাবা ইউসুফ তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় বারবার তিনি একটা কথাই বলছিলেন, ‘আমরা এই দেশে থাকব না।

’ বলেন, ‘পলিটিশিয়ানরা এ দেশটা পলিউটেড (দূষিত) করে ফেলেছে। আমরা এই দেশে আর থাকব না। আমি সহকারী প্রফেসর, আমার ওয়াইফও কেমিস্ট্রির লেকচারার। থাকব না আর এই দেশে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তাঁদের গ্রামের বাড়ি বশিকপুর পাল বাড়িতে গেলে সায়ানের দাদি কামরুন নাহারের আর্তনাদ শোনা যায়। তিনি আর্তনাদ করে বলতে থাকেন, ‘ও বাবু, আমার সোনামনি কই, ওরে মাগো, আমার সোনামনি কই?’ এর একটু পরেই [দুপুর পৌনে ১টার দিকে] গাড়িতে করে সায়ানের মরদেহ আসে বাড়ির সামনে। গাড়ির শব্দ শুনেই কামরুন কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসেন। এ সময় কয়েকজন প্রতিবেশি তাঁকে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। তাদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে যেতে যান গাড়ির কাছে।

কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ্য প্রতিবেশি তাকে বুঝিয়ে নিয়ে গেলেন ঘরের ভেতর, তবু থামেনি কামরুন নাহারের আর্তনাদ।

১০ মিনিট পর আরেকটি গাড়ি এসে থামে এই বাড়ির সামনে। সেই গাড়ি থেকে নেমে আসেন সায়ানের বাবা ইউসুফও। বন্ধু ও স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। তাঁদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি তো কারো ক্ষতি করি নাই। আমার ছেলে মেধাবী ছিল। ক্লাসে সে প্রথম হতো। এত সুন্দর, এত স্মার্ট ছিল। আমার ছেলেরে আমি সবসময় আইনস্টাইন বলে ডাকতাম। কখনো দুষ্টামি করেও মিথ্যা কথা বলি নাই। আমার সঙ্গে কেন এমন হলো!’

সায়ানের চাচা মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঝলসানো শরীর ও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে নিজেই বের হয়ে আসে সায়ান। পরে তার বাবা-মা তাকে শনাক্ত করে। সেই প্রথম বের হয়ে এসেছে ভিডিওতে দেখেছি।’

জানা যায়, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সায়ান। মাইলস্টোনে ইউসুফের সহকর্মী রায়হানা আক্তার। তিনি রসায়নের শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘ইউসুফ স্যারের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে আমেরিকায় পাঠাবে পড়াশোনার জন্য। আমেরিকায় সায়ানের এক মামা থাকেন। সেখানেই ছেলেকে পাঠানোর কথা। কিন্তু সব শেষ! সহকর্মী হিসেবে আমরা তাঁর শোকে মর্মাহত।’

জানা গেছে, ঈদুল আজহার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে ঈদ করতে এসেছিল সায়ান। আবারও কোনো এক ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে আসার কথা ছিল। তার আগেই সায়ান এসেছে লাশ হয়ে।

সোমবারের ট্রাজেডিতে প্রাণ হারায় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার আরেক শিক্ষার্থী—পার্বতীনগর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের রহিমবক্স হাজী বাড়ির আব্দুস সামাদের ছেলে আফনান ফায়াজ। মাইলস্টোনে সায়ানেরই ক্লাসমেট ছিল ফায়াজ। গতকাল সকালে ঢাকায় দাফন করা হয় ফায়াজের মরদেহ।

ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল

মন্তব্য

‘আম্মু, রাত্রে তুমি থাকবা না আমার কাছে?’

শেয়ার
‘আম্মু, রাত্রে তুমি থাকবা না আমার কাছে?’
আব্দুল্লাহ ছামীম

জুলেখা বেগম, নিহত আব্দুল্লাহ ছামীমের মা

দুপুরে কেউ একজন ফোন করছিল, ‘আপনার ছেলে বিমান দুর্ঘটনায় আহত হইছে। তাড়াতাড়ি আসেন।’ আমি গেছি। দৌড়াইয়া গেছি।

ওরে দেইখ্যা... পরে দেখি অ্যাম্বুলেন্স নাই। অনেক কষ্টে কোনোরকমে একটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক কইরছি। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে এসি নাই। এ কেমন বাংলাদেশ।
আমার বাবায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। ঢাকা মেডিকেলে নিলাম। হেই ঢাকা মেডিকেল নিতে নিতে আমার বাবায় চিল্লাইছে আর কইছে, ‘আম্মু কতক্ষণ লাগব, ভাইয়া (অ্যাম্বুলেন্স চালককে) কতক্ষণ লাগব আর? ভাইয়া, এতদূরে হাসপাতাল কেন, ভাইয়া? এতদূরে হাসপাতাল অইলে তো মানুষ মারা যাইব নিতে নিতে। এতদূরে কেন হাসপাতাল।
কাছাকাছি বানাইতে পারল না? এতদূরে কেন? আমারে বিদেশে নিয়া যাও চিকিৎসা করতে।’

পরে হাসপাতালে নিলাম। ভর্তি করাইল। বাবায় কইছে ‘আমারে একটু পানি দাও আম্মু। আমারে পানি দিলে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি।

’ আর ডাক্তার দেয় না দিতে। ডাক্তারে বলে কী, পানি খাইলে সমস্যা অইবো। আমার বাবায় নাস্তা চাইছে। দিতে পারি নাই। আমার বাবায় কয়, ‘আম্মু, আম্মু গো, রাত্রে তুমি থাকবা না আমার কাছে? হাসপাতালে আমি থাকব না।’ আমি বলছি, হ, বাবা আমি থাকব। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হোক, আমি তোমার কাছে থাকব। আমারে বলে কী, ‘আমার আপু আর তুমি থাকবা।’ আমি কইছি তুমি টেনশন কইরো না। কিন্তু এখন আমি আছি, বাবাটা নাই।

[মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত আব্দুল্লাহ ছামীম। বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ডিএম খালি মাঝিকান্দি গ্রামে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ জুলাই রাত ১১টার দিকে মারা যায় সে।  দুই ভাই এক বোনের মধ্যে ছামীম ছোট। বাবাহারা তিন সন্তানকে নিয়ে রাজধানী উত্তরা দিয়াবাড়ি খালপাড় এলাকায় থাকেন মা জুলেখা বেগম।]

পিন্টু রঞ্জন অর্ক

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ