বাংলাদেশে প্রথমবার প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আমাদের। আয়ভিত্তিক পরিসংখ্যানের আড়ালে থাকা দারিদ্র্যের জটিল ও বহুমুখী চিত্র এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে চার কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের বৃত্তে আটকে আছে। আয়ভিত্তিক দারিদ্র্য যতটা না দেখায়, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য তার চেয়েও গভীর ও জটিল : শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছায় না, নিরাপদ পানি ও শৌচাগার নেই, বাসস্থানের যোগ্যতা অনুপস্থিত।
এই সব সম্মিলিতভাবে মানুষকে উন্নয়নের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (Multidimensional Poverty Index) অনুযায়ী, দেশের অন্তত চার কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার, যারা আসলে আয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের প্রচলিত ধারণার বাইরে অবস্থান করছেন। এটি শুধু অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিফলন নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবনমানের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার এক বিস্তৃত চিত্র। শুধু অর্থনৈতিক মানদণ্ডে দারিদ্র্য পরিমাপ করা হলে প্রকৃত চিত্র অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
একজন মানুষের সামান্য আয় থাকতে পারে, কিন্তু তার সন্তান স্কুলে না গেলে, রোগ হলে চিকিৎসার সুযোগ না পেলে কিংবা বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগার না থাকলে তাকে দারিদ্র্যমুক্ত বলা যায় না।
প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশ, যা প্রাপ্তবয়স্কদের (২১ শতাংশ) চেয়ে অনেক বেশি। যদিও বিগত বছরগুলোতে শিশুদের দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, তবু এই উচ্চ হার শিশুদের ভবিষ্যৎ বিকাশের জন্য একটি বড় হুমকি। এ ছাড়া গ্রাম ও শহরের মধ্যে দারিদ্র্যের বৈষম্য চোখে পড়ার মতো।
গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্যের হার ২৭ শতাংশ, যা শহরের ১৩ শতাংশের দ্বিগুণেরও বেশি। আঞ্চলিক বৈষম্যও প্রকট; সিলেটে ৩৮ শতাংশ এবং বান্দরবানে ৬৫ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার, যেখানে ঝিনাইদহে এই হার মাত্র ৯ শতাংশ। এই তথ্যগুলো সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
আমরা মনে করি, দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রচলিত কৌশলগুলো থেকে বেরিয়ে এখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এবং অন্যান্য মৌলিক সেবার অপ্রতুলতা দূর করতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এই সূচক প্রকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এই সূচক শুধু অসাম্যই তুলে ধরছে না, বরং উদ্দেশ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপের পথ প্রদর্শন করছে। এটি সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগীদের জন্য দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রচেষ্টাগুলোকে আরো লক্ষ্যভিত্তিক ও ফলপ্রসূ করতে সাহায্য করবে।
বহুমাত্রিক দারিদ্র্য শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি সামাজিক বৈষম্য ও মানবিক বঞ্চনার এক জটিল রূপ। চার কোটি মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে একটি সমন্বিত এবং সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এখন সরকারের প্রধান দায়িত্ব। তবেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন সম্ভব হবে।