২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র অভ্যুত্থান দেশের মানুষের মধ্যে এক নতুন প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে—এমন আশা অনেকেই পোষণ করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি গণমাধ্যমে এমন কিছু খবর আসছে, যা আমাদের কিছুটা হলেও হতাশ করে। গতকাল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একজন নেতার বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে
- পাঠ্যবইয়ের কাগজ কেনায় বড় দুর্নীতি

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কাগজ কেনায় এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীর চক্র ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। প্রতিবেদনে অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। এ ঘটনায় খোদ এনসিপিও তাঁকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কাগজ আমদানিতে শুল্ক মওকুফ করিয়ে বাজারমূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি দামে প্রেস মালিকদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল দুর্নীতি। সেই সময়ে ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দুর্নীতির নতুন নতুন খাত তৈরি করে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
ছাত্র-তরুণদের উদ্যোগে গঠিত সরকার ও দলের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি।
আমরা আশা করি, নতুন বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউই ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের সম্পদ লুটপাট করার সাহস না পায়। একটি সহজ বিষয় আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে কোনো সংস্কারই শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না বা কাজে আসবে না।
সম্পর্কিত খবর

দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে
- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা

২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশি সব পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক বসবে। এটি খাতভিত্তিক শুল্কের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগ হবে। উচ্চ শুল্ক এড়াতে যদি কোনো পণ্য ঘুরপথে যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়, তাহলে সেই পণ্যের ওপরও উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হবে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এক চিঠিতে এমনটা জানানো হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নিয়ে গত ৪০ বছরে এমন সংকট দেখা যায়নি। বাণিজ্যসচিব জানান, ১৯৪৯ সালের পর সারা বিশ্বে এ ধরনের পাল্টা শুল্ক কখনো আসেনি। এত দিন উন্নত দেশগুলো শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত সুবিধা দিয়ে গরিব দেশগুলোকে সহায়তা করত, এবার যুক্তরাষ্ট্র সেখানে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। উদ্যোক্তাদের মতে, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা ও দর-কষাকষিতে বাংলাদেশ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৫ শতাংশের বেশি ছিল তৈরি পোশাক। পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।
মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রধান রপ্তানি খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৪০ লাখ শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই খাতের সহযোগী শিল্পগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান আলোচনায় আরো দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

পুনরাবৃত্তি যেন না হয়
- মর্মান্তিক এক বিমান দুর্ঘটনা

মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক, নির্মম। যে শিশুরা কিছুক্ষণ আগেও ছিল প্রাণোচ্ছল, প্রিয় প্রাঙ্গণে ছিল আনন্দমুখর, সেই হাসিখুশি কোমল মুখগুলোই মুহূর্তে পুড়ে নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পড়ে থাকল দগ্ধ মৃতদেহ। আশপাশের বাতাস ভারী হলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও তাদের স্বজনদের আর্তচিৎকারে।
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলটি দেশের মধ্যে নামকরা একটি স্কুল। প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি, কচি-কাঁচা মুখগুলোর কলকাকলিতে মুখর থাকত এই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। আজ সেখানে শুধুই সহপাঠী, পিতা-মাতা, শিক্ষক ও স্বজনদের বুকফাটা কান্না। সরকার মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে।
দুর্ঘটনার পর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এবং অন্যান্য হাসপাতালে পুড়ে যাওয়া সন্তানের পাশে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন পিতা-মাতা, ভাই-বোন, সহপাঠীরা। সেখানে মেয়েকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন ইয়াসমিন আক্তার। তাঁর ১১ বছরের মেয়ে নুরে জান্নাত ইউশার শরীর পুড়ে গেছে। ইউশা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তার কপাল পুড়ে গেছে, ঝলসে গেছে মুখমণ্ডল, মাথা ফেটেছে, পুড়ে গেছে পিঠও। এমন অবস্থা প্রায় সবারই।
গণমাধ্যমে উত্তরার এই দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। অনেক দাবিও উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যে মডেলের বিমান উৎপাদক দেশ চীনসহ অনেক দেশেই আর ব্যবহার করা হয় না, তেমন একটি যুদ্ধবিমান কেন ঢাকার আকাশে উড়ানো হলো? মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছে। তার মধ্যে আছে, নিহতদের নামসহ সঠিক তথ্য প্রকাশ, আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ, ক্ষতিপূরণ প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো বিমান প্রশিক্ষণে ব্যবহার না করা। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে দাবিগুলোর যৌক্তিকতা স্বীকার করেন।
আমরা চাই, ভবিষ্যতে যেন এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া হোক। হতাহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইল আমাদের গভীর সমবেদনা।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় উদ্যোগ নিন
- ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামার আশঙ্কা

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা এখন রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত। আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়টি কার্যকর হবে। কিন্তু শুল্ক কমানোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। গত রবিবার ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক : কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের অন্যতম রপ্তানিকারক ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে আজাদ বলেন, ৪০ বছরের ব্যাবসায়িক জীবনে তিনি রপ্তানি খাতে এমন সংকট কখনো দেখেননি।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। আর তার প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে আরোপিত শুল্কের আংশিক বহনের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু আমাদের লভ্যাংশ এত কম যে শুল্ক শেয়ার করার মতো সক্ষমতাই নেই।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত একটি সমাধানে আসতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।

গণতান্ত্রিক উত্তরণে ঐক্য জরুরি
- রাজনীতি অঙ্গনে বিভক্তি বাড়ছে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। সেই সরকারের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু যে গণতান্ত্রিক, দুর্নীতিমুক্ত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল, সেই স্বপ্ন এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা এবং রাজনীতিকে শুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু করে নানামুখী সংস্কার, কিন্তু সেখানেও রয়েছে বিস্তর মতপার্থক্য।
সার্বিক এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবাই একমত হবে—এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং এই সংস্কারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট করে তুলেছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, একটি ভ্রান্ত ধারণা থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং এই সংস্কারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট করে তুলেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ সরকার। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এনসিপি, জামায়াতকে নানাভাবে এই সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে অনেকে মনে করেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অর্জনকে ধরে রাখতে হবে। লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির ঐক্য অত্যন্ত জরুরি। আমরা মনে করি, জনপ্রত্যাশা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে এগিয়ে যাবে।