কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। গত এক যুগে দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে।
প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা নিন
- শাক-সবজির উৎপাদন ভালো
অন্যান্য

দেশের কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেলেও উৎপাদিত পণ্য নিয়ে কৃষক দুশ্চিন্তায় আছেন।
কৃষকদের বাজার ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় তাঁরা পণ্যের সঠিক মূল্য প্রাপ্তি থেকে বরাবরই বঞ্চিত হন। কৃষকের বাজারের মতো উদ্যোগ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে কৃষকরা লাভবান হবেন। একই সঙ্গে উৎপাদিত শাক-সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ কিংবা রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। বছর ছয়েক আগে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ফল এবং সবজি নষ্ট হয়ে যায় সঠিক প্রক্রিয়াজাত এবং সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে। সঠিক সংরক্ষণ সুবিধা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির সুযোগ থাকলে কৃষককে অল্প দামে বা লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে হবে না। সরকার দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষি এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়েছিল ২০১৬ সালে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের তদারকিতে দেশের প্রথম কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি গড়ে ওঠার কথা। আম, কলা, আনারস, লিচুসহ শীতকালীন সবজি টমেটো, ফুলকপি, শিমসহ অন্যান্য পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা থাকবে এখানে।
শীতকালীন শাক-সবজির উৎপাদন ভালো হয়েছে। এই ধারণাটি ধরে রাখতে হবে। লোকসানের কারণে কৃষির ওপর আস্থা হারিয়ে কৃষকরা যেন অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে না পড়েন, তা দেখতে হবে। ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
সম্পর্কিত খবর

নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন
- জুলাই ঘোষণাপত্র

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঐতিহাসিক ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন। একই প্রেক্ষাপটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণটিও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পাঠ করা ঘোষণাপত্রে ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, একদলীয় দুঃশাসনের পতন এবং নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের রূপরেখা উপস্থাপিত হয়েছে। ২৫ ধারায় প্রস্তাব করা হয়েছে যে এটি ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার কর্তৃক সংবিধানের তফসিলে সংযুক্ত হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে ‘স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে ছিল স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ আর ২০২৪ সালে ছিল স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ।’ এই বক্তব্য গণ-অভ্যুত্থানকে একটি ঐতিহাসিক মাত্রা দিয়েছে এবং বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলোর কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
তারেক রহমানের ভাষণ ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার, গুম, খুন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তিনি সাবেক সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, তারা বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
তবে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থাপিত জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের মতে, ঘোষণাপত্রে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি এবং এর বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।
সামগ্রিকভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র এবং তারেক রহমানের ভাষণ একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, যেখানে ফ্যাসিবাদ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ থাকবে। তবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ মসৃণ নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ভিন্নমত ও প্রত্যাশার পার্থক্য একটি সুসংহত এবং কার্যকর সরকার গঠনে বাধা দিতে পারে।

জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন
- রোজার আগেই নির্বাচন

জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ছিল। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করে আসছিল। কোনো কোনো দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করে আসছিল। মৌলিক সংস্কার ও বিচারের পরই হবে নির্বাচন—এমন কথাও বলা হচ্ছিল।
প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে তাৎক্ষণিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো। মঙ্গলবার রাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এখন আর কোনো রকমের অনিশ্চিত পরিবেশ থাকবে না।’ বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা এক ধাপ অগ্রগতি।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেন, ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা। নির্বাচন অনুষ্ঠান। আজ এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’ উল্লেখ্য, গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। জুলাই সনদ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে প্রতিনিয়ত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে এসেছে।’ এদিকে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা জানিয়েছে ঢাকায় অন্তত ছয়টি পশ্চিমা দূতাবাস।
গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান প্রত্যাশা পূরণের পথে যে অগ্রগতি সূচিত হয়েছে, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চা ও নির্বাচনের ইতিহাসে আগামী নির্বাচন হবে একটি অনন্য মাইলফলক।

রাষ্ট্রকে পাশে দাঁড়াতে হবে
- গভীর সংকটে আহত জুলাইযোদ্ধাদের জীবন

চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি পালিত হলো। ঠিক এক বছর আগে এই দিনটিতে জাতির ওপর গভীরভাবে গেড়ে বসা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে এই অভ্যুত্থান হাজার হাজার মানুষের রক্তের বিনিময়ে। অনন্য ও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা বছর পার করলাম। অথচ গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে আহত সহস্রাধিক মানুষের জীবনে নেমে এসেছে স্থায়ী দুর্দশা ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের বর্তমান জীবন এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার আহতদের চিকিৎসায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ৭৫ জনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে এবং দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়েছে। ১২ হাজার ৪২ জন গেজেটভুক্ত জুলাইযোদ্ধার মধ্যে সাত হাজার ৩৬৩ জনকে স্বাস্থ্যকার্ড বিতরণ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেক আহত ব্যক্তি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং আর্থিক সহায়তা তহবিলে অর্থসংকট দেখা দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে জুলাইযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা দেড় দশকের স্বৈরশাসনমুক্ত হলাম, তাঁদের জীবন ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব না? আমরা মনে করি, তাঁদের পুনর্বাসন ও আজীবন দেখভাল করা রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আহতদের পুনর্বাসন এবং তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এই আহত জুলাইযোদ্ধাদের যেন ভুলে না যাওয়া হয়, বরং তাঁদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হোক, যা তাঁদের জীবনকে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া জনগণের রক্ত ও ত্যাগ কোনোভাবেই অবমূল্যায়ন করা চলবে না।

দৃষ্টান্ত স্থাপিত হোক
- আসন্ন জাতীয় নির্বাচন

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুধু নয়, সাধারণ মানুষের আড্ডায়-আলোচনায়ও মুখ্য বিষয় এখন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের টক শো, গোলটেবিল, সভা-সেমিনার—সর্বত্রই নির্বাচনের নানা দিক আলোচিত হচ্ছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও কথা হচ্ছে। বিশেষ করে এই আলোচনা গতি পায় গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর।
অবশ্য নির্বাচন নিয়ে কিছু অস্পষ্টতাও যে ছিল না, তা নয়। অভিযোগ উঠছে, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী সংস্কার ও বিচারকে অজুহাত করে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র করছে। তারা বলছে, এসব দাবি পূরণ ছাড়া নির্বাচন নয়। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘দেশের এই পরিস্থিতিতে কিসের নির্বাচন? কী নির্বাচন হবে? সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অবশ্যই আগে পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে এনেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে আসার পর গত ৮ জুলাই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের জন্য ফুলগিয়ারে প্রস্তুতি চলছে।’ এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। তাঁর প্রদত্ত সময় অনুযায়ীও ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।
গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রত্যাশা ছিল মানুষের ভোটাধিকার বা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। সেই প্রত্যাশা পূরণের পথেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা চাই, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চা ও নির্বাচনের ইতিহাসে একটি অনন্য মাইলফলক হয়ে থাকুক।