'দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ' এ বাণীর মর্ম অনুধাবন করে স্বদেশপ্রীতির প্রেরণায় কত মানুষ যে যুগে যুগে কত স্বার্থ ত্যাগ করেছে, তার হিসেব নেই। প্রকৃত দেশপ্রেমিক দেশ ও জাতির জন্য প্রাণ দেওয়াকে অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে। প্রকৃত অর্থে দেশ ও জাতির সেবায় তথা মানবতার সেবায় আত্মোৎসর্গ করতে পারলে সত্যিকার দেশপ্রেমিক নিজেকে ধন্য বলে মনে করে থাকে। দেশের স্বাধীনতা যেখানে বিপন্ন, মানবতা যেখানে পর্যুদস্ত, সেখানে দেশ ও দেশবাসীর মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করা সবার জন্য একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আলেমসমাজের ভূমিকা
মুফতি জহীর ইবনে মুসলিম

১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল জালিম-মজলুমের যুদ্ধ।
মাওলানা ইমদাদুল হক আড়াইহাজারী, আড়াইহাজার থানা কমান্ডার শামছুল হক (সাবেক এমপি) এর অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি লালবাগ মাদ্রাসার ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। আমি হাফেজ্জী হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম, এ যুদ্ধে আমাদের ভূমিকা কী হবে? হুজুর বললেন, অবশ্যই জালেমদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। তাঁর এ কথায় আমি পাকিস্তানিদের জুলুমের প্রতিবাদের প্রেরণা পাই এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা, তারেক ওয়াহিদ বাট তার 'নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ডার ইসলাম আওর পাকিস্তান' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতি মাহমুদ সাহেবের বক্তব্য সব সময় বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ছিল। ফলে সে সময় জামায়াতে ইসলামী ও পিপলস পার্টি মিলে মুফতি মাহমুদের পেশওয়ারস্থ অফিসে আক্রমণ করে। লেখকের এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় সিলেটের জকিগঞ্জের মাওলানা আব্দুস সালামের কথায়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি করাচি ইউসুফ বিননুরী মাদ্রাসার ছাত্র। একদিন মুফতি মাহমুদ সাহেব মাদ্রাসায় এলে তাঁকে এক নেতা শেখ মুজিব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, 'গাদ্দারকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁকে কি এখনো হত্যা করা হয়নি? এ কথা শুনে মুফতি মাহমুদ সাহেব অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন, গাদ্দার কে? গাদ্দার কে? মুজিব গাদ্দার নয়, তিনি একজন সুন্নি মুসলমান। প্রত্যেক মুসলমানের জানমালের হেফাজত করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।
মুফতি মাহমুদ (রহ.) ১৩ মার্চ এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহইয়া-ভূট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানানো প্রেসিডেন্টের অবশ্যই কর্তব্য। (কাইদে জমিয়ত মুফতি মাহমুদ, আশফাক হাশেমী/সাপ্তাহিক কওমী ডাইজেস্ট, মুফতি মাহমুদ নাম্বার, পাকিস্তান)।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এবং এ দেশের মানুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে অনেক আলেম কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে শাহখুল হাদিস মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ (রহ.) প্রিন্সিপাল, মালিবাগ মাদ্রাসা, ঢাকা, শায়খুল হাদিস মরহুম তাজাম্মুল আলী সিলেট, মাওলানা আবুল হাসান যশোরী (রহ.), ময়মনসিংহের মরহুম মাওলানা আরিফ রাব্বানী, বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ, ঢাকা, মুফতি নুরুল্লাহ, বি-বাড়িয়া, মরহুম মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী, ঢাকাসহ প্রমুখ আলেমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মধ্যে শায়খুল হাদিস কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ্র ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহর ভূমিকায় খুশি হয়ে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রওশন আলী তাঁকে প্রশংসাপত্র ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ প্রদান করেছিলেন।
বিগত ৩০ ডিসেম্বর ২০০৫ তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে লেখক মুহাম্মদ ফায়জুল হক 'স্বাধীন বাংলা বেতারে আলেম মুক্তিযোদ্ধা' শিরোনামে লেখাতে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নিরীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা স্বাধীন বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধা আলেম মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদি, মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী ও মাওলানা ওবায়দুল্লাহ্ বিন সাঈদ জালালাবাদী ইসলামের দৃষ্টিতে অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং মানুষকে ইসলামের আলোকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতেন।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা, প্রখ্যাত আলেম আওলাদে রাসুল সাইয়্যেদ আসয়াদ মাদানি (রহ.)-এর ভূমিকা অবিস্মরণীয়, পাকিস্তান বাহিনী এ দেশের নিরীহ মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা করলে তিনি তাৎক্ষণিক জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মিটিং আহ্বান করে তার তীব্র নিন্দা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর জোরালো বক্তব্য পেশ করেছিলেন। তারপর পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করলে তিনি তার প্রতিবাদে কয়েক লাখ লোক নিয়ে দিল্লিতে মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের দিল্লি অফিসে বিদ্যমান রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলিল পরবর্তী সময়ে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর হাতে বায়আত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে হাফেজ্জী হুজুরের মতো রাজাকারের শিষ্যত্বে এলেন কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, হাফেজ্জী হুজুর রাজাকার ছিলেন না। একাত্তরের যুদ্ধ আমরা জালেমদের বিরুদ্ধে করেছি, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। আমাদের বাম রাজনীতিকরা একটি বিশেষ ইসলামী দলের চরিত্রের ওপর বিচার করে আলেমদের রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তা না হলে একাত্তরে এ দেশের আলেমরা ব্যাপকহারে রাজাকার ছিলেন না। আলবদর, আল-শামসে কেবল জামায়াতে ইসলামীর বড় নেতারা ছিলেন। আলবদর, আল শামসে যারা ছিলেন, তাঁরা নিজেদের দল বড় করে দেখানোর জন্য অনেকের নাম ব্যবহার করেছেন। তা ছাড়া সে সময়ের প্রচার মাধ্যমগুলো ছিল হয়তো পাকিস্তান সরকারের সমর্থক। তা না হলে ছিল বামদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী আলেমদের কণ্ঠ সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছেনি। পাকিস্তান সরকারের সমর্থক পত্রিকাগুলো সর্বদা প্রচার করেছে, এ দেশের আলেমসমাজ ও সাধারণ মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে। মুক্তিবাহিনী নাম দিয়ে যারা যুদ্ধ করেছে, তারা মূলত হিন্দু এবং ভারতের দালাল। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও উলামায়ে কেরাম, সৈয়দ মবনু)।
আমরা এ ক্ষুদ্র পরিসরে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা আলেম, প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতায় যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে যৎসামান্য জানতে পারলাম। এ ধরনের বহু আলেম নিঃসন্দেহে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাঁদের সঠিক ইতিহাস জানি না এবং জানারও প্রয়োজন মনে করি না। কারণ আমাদের ধারণা, তাঁরা সবাই স্বাধীনতাবিরোধী। আলেমসমাজও এর প্রতি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না, দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করছেন না। কিন্তু এতে যে আলেমসমাজ সাধারণ জনগণ থেকে দূরে থেকে যাচ্ছে, এটা অবশ্য আলেমসমাজের বোঝা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এ দেশের আলেমসমাজকে স্বাধীনতাবিরোধী মনে করার বেশ কিছু কারণ রয়েছে, তার মধ্যে মৌলিক কিছু কারণ হলো প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনতাযুদ্ধে কিছু আলেমের বিতর্কিত ভূমিকা ছিল। দ্বিতীয়ত, এ দেশে যারা সেক্যুলারিজম রাজনীতি করেন, তাদের সঙ্গে আলেমসমাজের রাজনৈতিকভাবে আদর্শগত কিছুটা পার্থক্য রয়েছে আর এটা থাকতেই পারে; কিন্তু এ আদর্শগত পার্থক্য ক্রমান্বয়ে ব্যক্তি বৈরিতায় পরিণত হয়েছে। ফলে আলেমসমাজ তাদের থেকে দূরে থাকে এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে অনীহা প্রকাশ করে। অপরদিকে সেক্যুলার রাজনীতি যারা করে, তারা আলেমদের থেকে দূরে থাকার কারণে স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের অনেকের বিতর্কিত ভূমিকার দরুন তাদের স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে থাকে।
আলেমসমাজকে স্বাধীনতাবিরোধী মনে করার আরেকটি মৌলিক কারণ হলো, স্বাধীনতার পর এ দেশে বেশ কিছু জাতীয় দিবস, যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, মাতৃভাষা দিবস ইত্যাদি দিবস সরকারি ও বেসরকারিভাবে বেশ জাঁকজমকভাবে পালন করা হয়। কিন্তু এসব দিবসে সাধারণত আলেমসমাজ ও ইসলামী দলগুলোর কোনো ভূমিকা থাকে না, তারা এর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয় না। এতে স্বাভাবিকভাবেই আলেমদের প্রতি সাধারণ মানুষের সন্দেহ সৃষ্টি হয় এবং তারা আলেমদের থেকে দূরে সরতে থাকেন। অথচ বিষয়টা এমন না হয়ে যদি আলেমসমাজ এসব জাতীয় দিবসগুলো ইসলামী ভাবধারায় তাঁদের মতো করে পালন করতেন। সেসব দিবসে তাঁরা যদি আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, দোয়া মাহফিলের আয়োজন করতেন, তাহলে মনে হয় আলেমসমাজ অহেতুক সমালোচনার পাত্র হতেন না এবং সাধারণ মানুষ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীসহ সুশীলসমাজের সঙ্গে আলেমদের যে দূরত্ব অনেকাংশে কমে যেত এবং সাধারণের সঙ্গে তাদের সেতুবন্ধন তৈরি হতো। আলেমরা হতেন সমাজের সব শ্রেণীর শ্রদ্ধাভাজন। আমাদের মনে হয়, বিষয়টা আলেমসমাজের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধা আলেমদের সঠিক ইতিহাস রচিত হোক, সাধারণ ও আলেমদের মাঝে তৈরি হোক সেতুবন্ধন। আলেমরা হোন সবার শ্রদ্ধাভাজন, এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া দক্ষিণখান
উত্তরা, ঢাকা।
সম্পর্কিত খবর