ঢাকা, রবিবার ২৭ জুলাই ২০২৫
১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ০১ সফর ১৪৪৭

ঢাকা, রবিবার ২৭ জুলাই ২০২৫
১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ০১ সফর ১৪৪৭

সেরা ভাবার লড়াই আর চাটুকারিতার দৌরাত্ম্য

  • গোলাম কবির
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
সেরা ভাবার লড়াই আর চাটুকারিতার দৌরাত্ম্য

১৭৫৭ সালের প্রাহসনিক যুদ্ধ জয় শেষে ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার পর স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হতে থাকে ভারতজুড়ে। তখন রাজধানী নির্ধারিত হয় কলকাতা। প্রশাসনিক আইন-কানুন প্রতিষ্ঠার জন্য অনেকের সঙ্গে লর্ড মেকলে ইউরোপ থেকে কলকাতা আসেন। তিনি বাংলার মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে বাঙালি চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন।

উদ্দেশ্য নিজেদের সেরা ভাবা এবং বাঙালি চরিত্রে নীচতার শিরোপা পরানো। মেকলে সাহেব বলতেন, বাঙালি ছিদ্রান্বেষী, পরশ্রীকাতর, মোসাহেব ইত্যাদি। তার পর্যবেক্ষণ শুধু বাঙালির নয়, মানব চরিত্রেরই বটে। এর তারতম্য বিচারে কেউ সেরা, কেউ সেরা নয়।
তবে আমাদের মোসাহেবিপনা যে চরমে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। আর এসব মোসাহেবি ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য। তাতে দেশ ও জাতি রসাতলে গেলেও কারো দ্বিধা থাকে না। এ তথ্যের সঙ্গে একটি সত্য নিহিত চাটুকারদের কাঁধে পা রেখে ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানিরা অনেকটা নির্বিঘ্নে সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে।
সুতরাং মোসাহেবরা বোধ করি তাদের লেখায় প্রশংসার্হ হওয়ার কথা ছিল। ইতিহাস নির্মম, তা হতে দেয় না। একটা সত্য সবার জানা, মোসাহেব যেমন অন্তঃসারশূন্য ব্যক্তিস্বার্থ অন্বেষী, তেমনি মোসাহেবের ইচ্ছা পূরণকারী নিজেকে ক্ষমতায় দেখতে পেলেই ডগমগ। দেশ ও জাতির কথা এদের মাথায় আসে না।

আমাদের ছেলেবেলায় শিক্ষকদের তেমন জুগুপ্সা-মত্ত হতে দেখিনি।

যেটুকু সমালোচনা না করলে দেশ রসাতলে যাবে—তা তাঁরা করতেন। অবশ্যই ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে নোয়াখালী সরকারি কলেজে আমি নিযুক্ত হই। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে আমার ঢাকা দেখাই হয়নি। নোয়াখালী দূর-অস্ত। সেখানে গিয়ে কিছু শিক্ষকের মাঝে সেরার বড়াই নিয়ে বচসা শুনতাম। দেশভাগের প্রায় দেড় যুগ পরে তখনকার সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত রাখার অভিপ্রায়ে পূর্ব পাকিস্তানের নামকরা কলেজগুলো সরকারের আওতায় নিয়ে আসে। যেসব কলেজে অনেক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন। তবে পরে ১৯৬৮ সালে মোনেম খান প্রতিটি জেলা সদরের কলেজকে সরকারি করে ফেলেন। তখন থেকে সরকারি কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কারণ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক বাছাই করা শিক্ষক, ডিপিআইয়ের আপৎকালীন বা নানা কিসিমের উমেদারদের নিয়োগ করা শিক্ষক এবং আত্তীকৃত শিক্ষক। সংক্ষেপে তাঁদের পরিচয় ছিল যথাক্রমে হক-অ্যাডহক-নাহক। এ বিভাজন ছিল কৌতুকের। শিক্ষকরা নিজেদের যা-ই বিচার করুক না কেন, কষ্টিপাথর হলো যথার্থ ছাত্র-ছাত্রীরা। শিক্ষক-অশিক্ষক তারাই যাচাই করতে পারে।

প্রশাসনে সিএসএস, ইপিসিএসদের মধ্যে সেরার আভিজাত্যবোধ ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয় সিও এবং নানা ধরনের বিএসএসের সংযুক্তি। শিক্ষকদের মধ্যে সেরা সাজার সিনাজোরি আর মোসাহেবির জারিজুরি কম নেই, প্রশাসনেও ওপরে ওঠার জন্য যত নিচে নামতে হয় তার কসুর করেন না অনেকেই।

আমরা শিক্ষায় ফিরে আসি। মানুষ চিরকালই ওপরে ওঠার জন্য বিবেক বিসর্জন দিয়েছে। সুধীজন মনে করেন, শিক্ষক কেন সে পথে হাঁটবেন! শিক্ষক তো মানুষ ও মনুষ্যত্বের প্রতিনিধি। তাইতো স্রষ্টা জনক-জননীর পর শিক্ষকের স্থান নির্ধারণ করেছেন। কিছু অতিলোভী শিক্ষকের কর্মকাণ্ডে তা কলুষিত হচ্ছে। এমনটি বোধ করি চলতে দেওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, লোভ অনেক অনিষ্টের মূল। আমি অশীতিবর্ষ অতিক্রম করেছি চলার পথে। হুমায়ূন কবিরের ভাষায়, ‘অশীতিবর্ষ বয়স আমার দুর্বল অতিদীন, কুব্জ-পঙ্গু-গণিতদন্ত-বধির দৃষ্টিহীন।’ চলার পথে শিক্ষক-প্রিন্সিপাল-ভিসি কম দেখিনি। আমাদের বিশ্বাস, রাষ্ট্র যে খোলসে পরিচালিত হোক না কেন শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়মানুগ ও নিঃস্বার্থ থাকতে পারলে জাতির জ্ঞান তৃষ্ণা মরুপথে হারায় না।

নিকট-অতীতে দেখা গেছে কিছু ভিসি পদপ্রাপ্ত ব্যক্তি ডামাডোলের কালে চর দখলের মতো রাতের অন্ধকারে ভিসির পবিত্র আসন কলঙ্কিত করেছেন। কেউ কেউ স্বাধীনতার মূলধারায় অবস্থান করে ক্ষমতার হাতছানিতে প্রলুব্ধ হয়ে উল্টো পথে যাত্রা করেছেন। অনেককে দেখা গেছে মুখে বঙ্গবন্ধু জপমালা জপে অমোচনীয় অপরাধ করে গেছেন। এমনকি ঘাতকরা সত্য প্রতিষ্ঠার নামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে শিক্ষাকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।

আমার শিক্ষার্থী জীবনের একজন ভিসি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি এমন নিয়মানুগ এবং সজ্জন ছিলেন, ছাত্ররা অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে আগে সালাম দিতে পারেনি, প্রসংগত একটা কথা বলে রাখি, স্বর্ণপ্রসূ রাজশাহী কলেজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দিকে অনেক মেধাবী শিক্ষক জোগান দিয়েছে। এমনকি প্রথম দিককার কয়েকজন ভিসি রাজশাহী কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ড. ই এইচ জুবেরি, ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর মুহম্মদ শামসুল হক প্রমুখ। সবচেয়ে সজ্জন ভিসি ছিলেন মুহম্মদ শামসুল হক, অবশ্য আমার দৃষ্টিতে যাঁর কথা আগেই বলেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ধারায় উনসত্তরের আগুনঝরা দিনের প্রথম শহীদ শিক্ষক শামসুজ্জোহার দাফনের পর সমবেত শোকসভায় ভিসি শামসুল হক সাহেব যে মর্মছেঁড়া বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাতে কারো চোখ আর্দ্র না হয়ে পারেনি।

পত্রিকায় প্রকাশ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ ও অন্যান্য বিষয়ে নানা অনিয়মের পর আগের ভিসি বিদায় হলে নতুন ভিসি নিয়োজিত হলেন ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার, সেপ্টেম্বর ২০২১। লক্ষণীয়, ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার শুধু রাজশাহী কলেজের ছাত্র ছিলেন তা-ই নয়, পুরুষানুক্রমে রাজশাহীর মাটির সন্তান। এ নিয়োগ রাজশাহীবাসীকে গর্বিত করেছে নিশ্চয়ই। রাজশাহীবাসী দেখতে চায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলে আসা হিরণ্ময় ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে অবশ্যই তাঁকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। কারণ তিনি ভিসি, সব মত ও পথের মানুষের। তবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে সর্বাগ্রে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের সব সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ন্যায়ানুগের প্রতীক। সে সত্য স্মরণে রেখে, সেরা সাজার প্রতিযোগিতা পরিহার এবং মোসাহেবদের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে এলে ফিরে আসবে হারানো দিন। মানুষ দেখতে চায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ জ্ঞানপীঠ। নিকট-অতীত কালে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, আব্বাসীয় খলিফা হারুন-মামুন মত-পথের দিকটি বড় করে না দেখে ধর্ম-নির্বিশেষে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাইতো একদা বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বসেরা সাধনাপীঠে পরিণত হয়েছিল।

স্বাধীনতার জন্য প্রথম রক্ত দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষাক্ষেত্রে অধোগামী বাংলাদেশকে সুবর্ণশিখরে উন্নীত করার নেতৃত্ব দিক এই বিশ্ববিদ্যালয় সেটাই আমাদের কামনা।

 

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর

    ড. কবিরুল বাশার
শেয়ার
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর

পৃথিবীর উষ্ণতম অঞ্চলের দেশগুলোতে মশাবাহিত রোগে প্রতিবছর লাখ লাখ লোক আক্রান্ত হয় এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুর বড় আঘাতের পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। প্রায় প্রতিবছরই দেখা যায় আগস্ট-সেপ্টেম্বরে রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সরকারি পরিসংখ্যানে রোগীর যে সংখ্যা দেখানো হয়, তা ঢাকার মাত্র ৭৭টি হাসপাতাল এবং অন্যান্য জেলার অল্পকিছু হাসপাতালের তথ্য।

ছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ গুণ। আবার অনেকে বাসায় থেকেও চিকিৎসা নেয়। 

পৃথিবীর ১২৯টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও এর ৭০ শতাংশই এশিয়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এবার ডেঙ্গুঝুঁকিতে থাকবে।

ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির স্ত্রী মশা দ্বারা সংক্রমিত হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে অল্প মাত্রায় এডিস অ্যালবোপিকটাসের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। এই প্রজাতির মশা চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার এবং জিকা ভাইরাসেরও বাহক।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন কতটা কার্যকরপৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে পাঁচ লাখ মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং এর মধ্যে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। পৃথিবীব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়।

তবে কোনোভাবেই যেন মশার সঙ্গে পেরে উঠছে না মানুষ। তাই পৃথিবীর বড় বড় গবেষণা সংস্থা নজর দিয়েছে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন তৈরিতে। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং এই কারণে যে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে এবং চারটি সেরোটাইপই ডেঙ্গু রোগ সৃষ্টি করতে পারে। অনেক বছর গবেষণা এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর বর্তমানে বিশ্বে দুটি ভ্যাকসিন বাজারজাত করা হয়েছে। ছাড়া আরো কয়েকটি ভ্যাকসিন উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
Dengvaxia (CYD-TDV) হলো সানোফি পাস্তুর কম্পানির উদ্ভাবিত বিশ্বের প্রথম ডেঙ্গু ভ্যাকসিন, যা ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ফিলিপিন্স ব্রাজিলে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পায়। এটি একটি লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড (live-attenuated) টেট্রাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন, যা চারটি ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV-1, 2, 3 I 4) টাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। Dengvaxia তিনটি ডোজে দেওয়া হয়, প্রতি ছয় মাস অন্তর করে একটি ডোজ। এটি মূলত ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল, যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল।

এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নির্ভর করে ব্যক্তির পূর্ববর্তী ডেঙ্গু সংক্রমণের ওপর। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি আগে ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে (seropositive), তাদের মধ্যে Dengvaxia প্রায় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। তবে যেসব ব্যক্তি আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি, তাদের মধ্যে ভ্যাকসিন গ্রহণের পর গুরুতর ডেঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ Dengvaxia শুধু আগে ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। জন্য এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের আগে সেরোলজিক্যাল পরীক্ষা করতে হয়, যা বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।Qdenga, যার বৈজ্ঞানিক নাম TAK-003, জাপানের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান Takeda Pharmaceutical Company-এর তৈরি একটি নতুন প্রজন্মের ডেঙ্গু ভ্যাকসিন। এটি Dengvaxia-এর তুলনায় অনেকটাই সহজ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য তুলনামূলকভাবে অধিক উপযোগী।

Qdenga- একটি লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড টেট্রাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন, তবে এটি দুই ডোজে দেওয়া হয় এবং আগে ডেঙ্গু হোক বা না হোক, সেই বিবেচনা না করেই ব্যবহার করা যায়। এটি হলো এর সবচেয়ে বড় সুবিধা।

Qdenga-এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মূলত লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার উচ্চঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে সম্পন্ন হয়। ফেজ-৩ ট্রায়ালে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি প্রথম দুই বছরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রায় ৮০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, হাসপাতালভিত্তিক গুরুতর ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা ছিল প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। ছাড়া এটি seronegative seropositive উভয় শ্রেণির মানুষের জন্যই নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। ফলে এটি বৃহৎ পরিসরে প্রয়োগের উপযোগী। বর্তমানে Qdenga ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত। ২০২৪ সালের মে মাসে WHO Qdenga-কে prequalified vaccine হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা এর ক্রয় এবং ব্যবহারের পথ সুগম করে।  Qdenga শিশু কিশোরদের (চার বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী) মধ্যে প্রয়োগযোগ্য। এর কোনো আগে serological পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই, যা বাংলাদেশের মতো দেশে এই ভ্যাকসিনকে বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে DENV-3 DENV-4 টাইপ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হতে পারে। তা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে আরো পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। ছাড়া ভ্যাকসিনের মূল্য এবং সরবরাহব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে; যেমনভ্যাকসিনগুলোর দাম, প্রাপ্যতা, সংরক্ষণ ও সরবরাহ চেইন, সঠিক বয়সভিত্তিক টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ ইত্যাদি। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও মশা নিয়ন্ত্রণ ও জনসচেতনতা না থাকলে সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ হবে না। বিশেষ করে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ অপরিকল্পিত নগরায়িত এলাকায় শুধু ভ্যাকসিন কার্যক্রম যথেষ্ট নয়, বরং এটি অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পরিপূরক হতে হবে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন আমদানি এবং প্রয়োগ করবে কি না, সেটি নানা মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। একজন পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য গবেষক হিসেবে আমি মনে করি, এটির আমদানি এবং প্রয়োগের আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন। ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, যারা এটি প্রয়োগ শুরু করেছে, তাদের কাছ থেকে এর ফলাফল এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা প্রয়োজন।

সর্বশেষে বলা যায়, ডেঙ্গু ভ্যাকসিন বাংলাদেশের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে, বিশেষ করে Qdenga যদি দ্রুত অনুমোদিত হয়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়। তবে এর সফল প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনা, লক্ষ্যভিত্তিক প্রয়োগ কৌশল, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি। একই সঙ্গে জোর দিতে হবে মশার বংশবিস্তার রোধ, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা এবং রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর। একমাত্র সম্মিলিত প্রয়াসই পারে ডেঙ্গুর মতো জটিল ও ক্রমবর্ধমান রোগকে টেকসইভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে।

লেখক : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ও পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

professorkabirul@gmail.com

 

মন্তব্য

তরুণদের পছন্দে কী বার্তা লুকানো

    ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির
শেয়ার
তরুণদের পছন্দে কী বার্তা লুকানো

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনে তরুণদের মতামত ও মনোভাব কেমন, তা বোঝার এক তাৎপর্যপূর্ণ জানালা খুলে দিয়েছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জরিপ। জরিপ অনুযায়ী, বিএনপি পেয়েছে ৩৯ শতাংশ তরুণের সমর্থন, জামায়াতে ইসলামী ২১ শতাংশ এবং নবগঠিত এনসিপি পেয়েছে ১৬ শতাংশ। এই সংখ্যা নিছক পরিসংখ্যান নয়, বরং একদিকে রাজনৈতিক বার্তা, অন্যদিকে সমাজের মনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তি। এটি আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তরুণদের আস্থার সংকট এবং বিকল্পের সন্ধানের দিকেও স্পষ্ট ইঙ্গিত করে।

আরো উদ্বেগজনক হলো, প্রায় ৮৩ শতাংশ তরুণ ভবিষ্যতে রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণে আগ্রহী নয়। এটি শুধু রাজনীতিবিমুখতার চিত্র নয়, বরং একটি প্রজন্মের হতাশা, নিরুৎসাহ এবং আত্মবিশ্বাসহীনতার প্রতিফলন, যা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য অশনিসংকেত।

জরিপটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য? প্রথমেই আসে জরিপের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন। জরিপটি কতটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, কতজনের ওপর, কত অঞ্চলে এবং কিভাবে পরিচালিত হয়েছেএসব প্রশ্নের স্বচ্ছ উত্তর প্রয়োজন।

তথ্য সংগ্রহে পক্ষপাত থাকলে ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। তথাপি পদ্ধতিগত ঘাটতি থাকলেও এটি তরুণসমাজের মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক অনুভূতির একটি রূপরেখা হিসেবে ধরা যায়।

তরুণদের আস্থা কোথায় হারাল? এই জরিপের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা হলো, তরুণরা রাষ্ট্রের মূলধারার শাসনব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছে। সরকারি দলের প্রতি প্রায় অনুপস্থিত সমর্থন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি হতাশা ও দূরত্বের ইঙ্গিত দেয়।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব তরুণদের কাছে রাজনীতিবিমুখ করে তুলেছে। তার পরও রাজনীতির প্রতি তরুণদের আস্থা হারানোর পেছনে কারণ কী, তা অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।

জামায়াতের প্রতি সমর্থনপ্রতিবাদ, নাকি আত্মসমর্পণ? জামায়াতে ইসলামীর প্রতি তরুণদের সমর্থন কিছুটা বেড়েছে বলেই মনে হয়। এটি কি কেবল ধর্মীয় অনুরাগ, নাকি রাজনৈতিক ভিন্নমাত্রার আকাঙ্ক্ষা? জামায়াত নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ধরনের সমর্থন আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর সীমাবদ্ধতা ও তরুণদের মধ্যে বিকল্প ভাবনার সন্ধানকেই ইঙ্গিত করে। জামায়াতের প্রতি এই সমর্থন কি বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি প্রতিবাদ?

এনসিপি : নতুন রাজনীতির বার্তা কী? নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির প্রতি ১৬ শতাংশ তরুণের সমর্থন একটি নতুন ধারার রাজনীতির ইঙ্গিত দেয়।

তরুণরা আধুনিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে। এই সমর্থন কেবলবিকল্পের খোঁজনয়, বরং গণমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। তবে এনসিপির উত্থান টেকসই নেতৃত্বের সূচনা হবে, নাকি শুধুই একটি ক্ষণস্থায়ী প্রতিবাদ, তা সময়ই বলে দেবে।

বিএনপি : বিএনপি তরুণদের সর্বোচ্চ সমর্থন পেয়েছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। অতীতে অনেকবার ক্ষমতায়ও গেছে। তার পরও প্রশ্ন থেকেই যায়, দলটি তরুণসমাজকে কতটা আকৃষ্ট করতে পারছে? দলটি কতটা সংগঠিত?

এই জরিপে তরুণদের যে পছন্দ উঠে এসেছে, তা কোনো চূড়ান্ত চিত্র নয়। তার পরও এটি রাজনীতির সামনে একটি আয়না, যেখানে নেতৃত্ব দেখতে পায় তরুণদের প্রত্যাশা, বিতৃষ্ণা এবং সংকেত। এটি পরিতাপের বিষয় যে তরুণরা ক্রমেই রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বা যেতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কার, তরুণবান্ধব নীতি, গবেষণা ও সংলাপ এবং সর্বোপরি নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক ও আধুনিক নির্বাচনী ব্যবস্থাই তরুণদের রাজনৈতিক আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।

এই জরিপ কেবল একটি পরিসংখ্যানগত নথি নয়, এটি এক ধরনের রাজনৈতিক থার্মোমিটার। তরুণদের মন বুঝতে না পারলে রাজনীতি শুধু দুর্বল হবে না, বরং অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

 

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

akmhumayun@cvasu.ac.bd

 

মন্তব্য

এ দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের শেষ কোথায়

    গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
এ দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের শেষ কোথায়

আর কত বুকভাঙা ঘটনা ঘটলে দেশের হতভাগা মানুষের দুঃখ-বেদনার অবসান ঘটবে? আর কত ভাগ্যবিড়ম্বনা হলে দেশের মানুষের দুঃসময় দূর হবে? প্রশ্ন যেন আজ শোকাহত প্রত্যেক সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। কাদের অপরাধে সর্বত্র আজ এই ধারাবাহিক বিপর্যয়ের ঘনঘটা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানবসৃষ্ট নৈরাজ্য, সব যেন পালা করে চেপে বসছে জাতির জীবনে। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর, তারপর আরো ৫৩ বছর কেটে গেল, জাতির ভাগ্য বদল হলো না।

অপশাসন ও শোষণমুক্ত একটি শান্তি-স্বস্তির স্বদেশ তো এখনো পেলাম না আমরা। অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন তো হাতের নাগালে পাওয়া দূরের কথা, রাজনীতির নামে অনেকেই আবির্ভূত হলেন নিকৃষ্ট শাসক, শোষক, প্রবঞ্চক, ধিক্কৃত নরহত্যাকারীর ভূমিকায়।

বিগত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছে দেড় সহস্রাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। এতে তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটলেও অবসান ঘটেনি তাদের অনুসারীদের তাণ্ডবের।

গোপালগঞ্জে সংঘটিত আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপর্যুপরি হামলা আবার দেশের গণতান্ত্রিক আবহকে বিনষ্ট করে স্বেচ্ছাচারের ধারাবাহিকতাকেই যেন উসকে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা কিংবা চক্রান্তের মধ্য দিয়ে মানবসৃষ্ট ধারাবাহিক দুর্যোগের মধ্যে যোগ হয়েছে আরেক অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ। আর সেটি হচ্ছে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ স্থাপনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা। হৃদয়বিদারক সে দুর্ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত জ্বলে-পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছে ৩৪ জন ছাত্র শিক্ষক।
হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরো অনেকে। এই অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ ও ধারাবাহিক বিপর্যয়ে এখন প্রায় হতবিহ্বল দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। অবস্থায় তাদের শুধু একটি জিজ্ঞাস্য দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের শেষ কোথায়?

এ দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের শেষ কোথায় দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক বিপর্যয়ের পরও দেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধে রয়েছে কোনো এক সুসময়ের অপেক্ষায়, যা তাদের অন্তত মানবসৃষ্ট দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা করবে। সীমাহীন সমস্যা ও সম্ভাবনার দেশবাংলাদেশ। দেশের বহুমুখী সম্ভাবনা চাপা পড়ে রয়েছে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার কারণে।

৫৩ বছরে আমরা আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের অনেক সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অদক্ষতা, ব্যর্থতা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতার অভাবে বেশির ভাগ সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। তদুপরি আমাদের রাজনৈতিক মহলে রয়েছে দুর্নীতি, স্বার্থপরতা এবং কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার নির্লজ্জ প্রয়াস, যার প্রমাণ আমরা বারবার পেয়েছি।

স্বৈরাচার, দুর্নীতি ও অপশাসন অবসানের লক্ষ্যে বহু সার্থক বা সফল গণ-আন্দোলন এবং অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এতে বহু প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, কিন্তু বারবার কোনো না কোনো কায়েমি স্বার্থ কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থপরতার কাছে আমরা শেষ পর্যন্ত হেরে গেছি। আবার নতুন করে শুরু করতে হয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন। আমাদের সংবিধান, সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, এমনকি সাম্প্রতিক সংসদ নির্বাচনগুলোও জাতীয় প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। তথাকথিত উন্নয়নের স্লোগানের আড়ালে গণতন্ত্রের কবর রচনা করে এক দানবীয় ফ্যাসিবাদের জন্ম দেওয়া হয়েছিল। বিগত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছেসেটি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দাবি করেছে রাষ্ট্রের যথাযথ মেরামতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের ব্যাপারে। বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রশাসন একটি অরাজনৈতিক সরকার হতে পারে, কিন্তু এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এই সরকারের প্রধান প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রশ্নে একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি। প্রয়োজনীয় কিংবা জরুরি সংস্কার এবং সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারপ্রধান তাঁর বিভিন্ন ভাষণে পরিষ্কার করে অনেক কিছুই বলেছেন, প্রতিদিন নতুন করে যার আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। অবস্থায়ও দেশের বিভিন্ন দায়িত্বশীল দল বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারে না। অথচ তাদের অনেকে এখনই দেশে নির্বাচন চায়। ধরনের নির্বাচন তারা অতীতে বহুবার করেছে, কিন্তু তাতে দেশ ও জাতি তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে দেশব্যাপী অনেক দলের শক্তি প্রদর্শন কিংবা শোডাউন শুরু হয়ে গেছে। এতে রাজধানী ঢাকা মাঝেমধ্যে অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে একটি বিষয় রাজনীতিসচেতন মানুষের দৃষ্টি এড়াচ্ছে না আর তা হলো, নির্বাচন সামনে রেখে বড় বড় দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোনো সাংগঠনিক সংস্কার নেই। অবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের নিয়ে কত দিন দেশ চালাতে পারবে তারা? যারা দেশের সবকিছু সংস্কারের বেলায় সোচ্চার, তারা নিজ নিজ দলের সংস্কার কিংবা প্রয়োজনীয় শুদ্ধি অভিযানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি কথা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে দেশের ভবিষ্যৎ কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য এখন চাই তরুণ, সৎ ও শিক্ষিত নেতৃত্ব। অতীতের চাঁদাবাজ, ধান্দাবাজ, সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের দিয়ে এখন আর দলকে ধরে রাখা যাবে না।

বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য এখন চাই শিক্ষিত, সৎ ও তরুণ মেধাবী নেতৃত্ব। নতুবা ঘাটে ঘাটে ধরা খেয়ে যাবে ভবিষ্যৎ সরকারগুলো। আন্দোলনের তোড়ে ভেসে যাবে বানের পানির মতো। বাবার পরিচয়ে বখে যাওয়া ছেলে কিংবা আত্মীয়-স্বজন দুর্নীতির পাহাড় গড়তে অথবা ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে সক্ষম হবে না। সে কারণেই এখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষিত, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এবং বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ সমর্থক ও জনবল তৈরি করতে হবে। এবং সে অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে নতুবা সংসদ, সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্যান্য মন্ত্রীর বাসভবন রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন থেকে সেভাবে তাদের দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া বর্তমানে চলমান প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নতুবা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বাধার মুখে পদে পদে আটকে যাবে ক্ষমতাসীন দল। জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন এক নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে দিকে দিকে। সে অবস্থায় কথায় কথায় রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়লে দেশ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্থবির বা অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উপপ্রধান ড. আলী রীয়াজ সংস্কারের প্রশ্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গত সপ্তাহে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের সঙ্গে বসেছিলেন। পরে আরো ১৩টি দলের নেতাদের সঙ্গে কমিশন বৈঠক করে। আলোচনা শেষে জানা যায়, কমিশন বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন জরুরি সংস্কার ও সামনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সে ঐকমত্যে পৌঁছার বিষয়টি একটি অত্যন্ত অর্থবহ অগ্রগতি বলে কমিশন জানায়। এতে আশা করা যাচ্ছে যে প্রস্তাবিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সবকিছু ঠিকমতো এগোলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে সম্পন্ন করা সম্ভব হতেও পারে।

উল্লেখ্য যে অতীতে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজে হাত দেয়নি। সে ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এর পাশাপাশি সম্প্রতি গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের পতিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের আক্রমণের মুখে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সুরক্ষিত যানে করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে কেউ কেউ তাঁদের প্রতি সরকারি আনুকূল্য হিসেবে সমালোচনা করেছেন। তা ছাড়া ছাত্রদের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে দেওয়ার পেছনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মদদ বা পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগেও একটি মহল কঠোর সমালোচনা করেছে। সেটিকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে যথেষ্ট পাল্টা সমালোচনাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়েছে। ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অংশটির মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের আন্দোলনের ফলেই মূলত আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি, একাত্তরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করতে পেরেছি। তা ছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ছাত্রদের নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন গণ-অভ্যুত্থান, যাতে স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে। কোনো প্রথাগত রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব হয়নি দেড় দশক ধরে তথাকথিত আন্দোলন করে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার পতন ঘটানো। সেটি মূলত সম্ভব হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে। অতীতে কোনো সফল ছাত্র আন্দোলনের ফসল জনগণ ঘরে তুলতে সক্ষম হয়নি। এর ফলাফল ভোগ করেছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। সে বিবেচনায় দেশের উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা যদি কোনো দল গঠন করে, তাতে আইনগতভাবে আপত্তির কী আছে? আর যা-ই হোক, দেশবাসীর অনেকেই এখন চায় যে শিক্ষিত যুবকরা রাজনীতিতে আসুক, অশিক্ষিত, মাস্তান, চাঁদাবাজ ও ধান্দাবাজরা নয়।

 

লেখক : বাংলাদেশ সংসাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

 

মন্তব্য

নেটফ্লিক্স স্রেব্রেনিচা ও গাজা

    জিয়াউদ্দিন সাইমুম
শেয়ার
নেটফ্লিক্স স্রেব্রেনিচা ও গাজা

মুসলিম গণহত্যা যদি স্রেফ রসিকতার ব্যাপার হয়ে থাকে, তাহলে পশ্চিমা মূল্যবোধের আলোকে গড়ে ওঠা নেটফ্লিক্স বসনিয়ার স্রেব্রেনিচা আর ফিলিস্তিনের গাজার গণহত্যা নিয়ে নির্দয় রসিকতা করে মোটেও ভুল করেনি। কারণ পশ্চিমারা সভ্যতার ডেফিনেশন নিয়ে পাঁয়তারা করে বেড়ালেও মুসলিম ইস্যুতে নাক সিঁটকাতে মোটেও ভুল করে না। নেটফ্লিক্স তো পশ্চিমা মূল্যবোধের বাইরে যেতে পারে না।

গণহত্যা অথবা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে একসময় পশ্চিম বিশ্বে আর কখনো নয় উচ্চারিত হতো কাঁপতে থাকা নিপাট আন্তরিকতার সঙ্গে।

এই মন্ত্রটি ছিল অজাত প্রজন্মের কাছে পশ্চিমা প্রতিশ্রুতি : গণহত্যার ভয়াবহতার আর কখনো পুনরাবৃত্তি হবে না। কিন্তু আজ ডিজিটাল প্রদর্শনী এবং রাজনৈতিক দায়মুক্তির যুগে আর কখনো নয় মাঝে মাঝে আবার কখনো হয়ে উঠেছে। এবং এই গ্রহবাসী স্মৃতির এক ভয়াবহ বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করছে।

ওয়ারশ ঘেটো আর স্রেব্রেনিচা থেকে গাজা পর্যন্ত গণহত্যার চিত্র, বিশেষ করে শিশুদের দুর্ভোগকেবল তার পবিত্রতাই হারায়নি, এটি উপহাস, কৌতুক এবং বিনোদনের সবচেয়ে নিন্দনীয় রূপে পরিণত হয়েছে।

এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং অমীমাংসিত ইতিহাস এবং অমীমাংসিত মূল কারণগুলো কিভাবে সহিংসতার প্রতি সংবেদনশীল এবং প্রদর্শনের জন্য ক্ষুধার্ত একটি সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তারই প্রতিফলন।

অসংবেদনশীলতার এক মর্মান্তিক প্রদর্শনীতে, ডাচ নেটফ্লিক্স কমেডি ফুটবল প্যারেন্টসে এমন একটি দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যেখানে স্রেব্রেনিচা গণহত্যার শিকারদের তুলনা আনাড়ি শিশু ফুটবল খেলোয়াড়দের সঙ্গে করা হয়েছে, যা বসনিয়ান গণহত্যাকে একটি কৌতুকে পরিণত করেছে।

১৯৯৫ সালে ডাচ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে আট হাজারেরও বেশি বসনিয়ান মুসলিম পুরুষ ও ছেলেকে হত্যা করা হয়েছিল। ডাচ সেনারা কেবল গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ হয়নি, বরং এতে সক্রিয় অংশগ্রহণও করেছিল।

নেদারল্যান্ডস এই পৃথিবীতে তিনটি বড় গণহত্যার সঙ্গে যুক্তহলোকস্ট, বসনিয়ান গণহত্যা এবং এখন গাজায় গণহত্যা।

গাজায় গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ডাচ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা করা হচ্ছে। এদিকে একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডাচ নাগরিক হলোকস্টে অংশ নিয়েছিল।

অস্বীকার কেবল একটি পরোক্ষ চিন্তা নয়, এটি গণহত্যা প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমনটি ইসরায়েলি টিকটক সেলিব্রিটিদের মধ্যে দেখা যায়, যারা গাজার ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য অনুদানের ভান করে ভাইরাল প্রাংক ভিডিও তৈরি করে, অথচ আবেদনটিকে তারা একটি নিষ্ঠুর রসিকতা হিসেবে প্রকাশ করে।

প্রশ্ন হতে পারে, পশ্চিমারা মূল্যবোধের এই স্তরে কিভাবে এসে পৌঁছল? কঠিন সত্য হলো তারা কখনো গণহত্যার চেতনা থেকে সত্যিকার অর্থে দূরে সরে যায়নি বা যেতে পারেনি।

ইতিহাস বলছে, পশ্চিমাদের গালভরা আর কখনো নয় শব্দবন্ধ বা আপ্তবাক্যটি বাস্তবে কখনো ছিল না। পশ্চিমারা তাদের দর্শন ও সংস্কৃতি থেকে বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ, অমানবিকীকরণ, সামরিকবাদের মূল কারণগুলো কখনো বাদ দিতে পারেনি। পরিবর্তে, হলোকস্টকে ইন্ধন জোগানো একই মতাদর্শগুলো নতুন সময়ে নতুন অভিব্যক্তি খুঁজে পায়, নতুন সংস্থাগুলোকে লক্ষ্য করে।

জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্ট্যান্টন গণহত্যার ১০টি ধাপের রূপরেখা দিয়েছেনশ্রেণিবিভাগ, প্রতীকীকরণ, বৈষম্য, অমানবিকীকরণ, সংগঠন, মেরুকরণ, প্রস্তুতি, নিপীড়ন, নির্মূলকরণ এবং অস্বীকার, যা তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনো এড়াতে পারেনি। ভাষাগতভাবেও তাদের প্রতিশ্রুতি সর্বদা ভঙ্গুর ছিল। তবে তাদের একটি মন্ত্র ভবিষ্যদ্বাণীতে পরিণত হয়েছে, আবার চিরকাল।

পশ্চিমে, বিশেষ করে অতীতের গণহত্যায় জড়িত দেশগুলোর সাংস্কৃতিক প্রচারণায় শিশুদের দুঃখ-কষ্ট ন্যায্য খেলায় পরিণত হয়েছে। পবিত্রতা এখন অপবিত্র। পশ্চিমা মিডিয়ায় শিশুরা সর্বদা একটি নির্দিষ্ট বিনোদনমূলক মূল্য ধারণ করে। তাদের ব্যথা আলোকিত, তাদের অশ্রু আবেগগতভাবে শক্তিশালী। কিন্তু দুঃখ-কষ্টকে উপস্থাপন করা এবং তা শোষণ করার মধ্যে একটি সূক্ষ্মরেখা রয়েছে। এবং আজ সেই রেখাটি কেবল অতিক্রম করা হয় না, এটি মুছে ফেলা হয়। তাই লাইভস্ট্রিম করা যুদ্ধ এবং অ্যালগরিদমচালিত সম্পৃক্ততার যুগে গণহত্যা আর কেবল একটি অপরাধ নয়, এটি আত্মতৃপ্তিও বটে। ওবামানা মানে বসনিয়ান গণহত্যা ছিল টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত প্রথম গণহত্যা। এরই ধারাবাহিকতায় গাজার গণহত্যা প্রথম সম্পূর্ণ ডিজিটাল গণহত্যা হয়ে উঠেছে।

স্মার্টফোনগুলো বাস্তব সময়ে শিশুদের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো ধারণ করে। লাইভস্ট্রিমে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া পুরো পরিবারগুলোকে দেখানো হয়শুধু সেই ছবিগুলোকে ব্যঙ্গ, অস্বীকৃতি অথবা আরো খারাপ প্যারোডি দ্বারা ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য। এটি সিস্টেমের কোনো বাগ নয়। এটি আজকের ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে, তার একটি বৈশিষ্ট্য। গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ একই রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের সাংস্কৃতিক শিল্পে তার শিকারদের উপহাসকে বিকশিত হতে দেয়। তবে গাজা এই নির্মম সত্যকে নিশ্চিত করে : একবার আমরা একটি গণহত্যাকে ক্ষমা করে দিলে, আমরা পরবর্তী গণহত্যাটিকে সক্ষম করে তুলব, অনিচ্ছা সত্ত্বেও।

নেটফ্লিক্স শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের বিকৃত শ্রেণিবিন্যাস উন্মোচিত করে, যেখানে এমনকি স্বর্ণকেশী, নীল চোখের ইউরোপীয় মুসলিম গণহত্যার শিকারদেরও পূর্ণ মানবতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। রিড হেস্টিংস এবং ডেভিড হাইম্যান সিরিজটি অপসারণের অযোগ্য বলে মনে করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব নতুন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে; যার মূলমন্ত্র হিসেবে দাবি করা হয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি স্পষ্ট হতে থাকেপশ্চিমাদের এই নীতিমালা সব দেশের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়, বরং একেক দেশের জন্য তা একেক রকম।

নেটফ্লিক্সের কথা বাদ দিন। পশ্চিমা দুনিয়ায় বিধর্মী শত্রু অথবা সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলমানরাই এখন প্রচারমাধ্যমের সবচেয়ে বড় টার্গেট। একটি তথ্য জানালেই সেটি টের পাওয়া যাবে। ডেনমার্কে গত বছরের ১৫ মে থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসের ছয়টি জাতীয় সংবাদপত্র এবং দুটি টিভি চ্যানেলের ওপর জরিপে দেখা গেছে, সেখানকার মিডিয়া কাভারেজের ৭৫ শতাংশই ইসলাম সম্পর্কিত এবং তার মধ্যে ৬০ শতাংশই নেতিবাচক অর্থাৎ উদ্দেশ্যপূর্ণ।

পশ্চিমের প্রচারমাধ্যম এমনভাবে মুসলমানদের সামাজিক পরিচয় বানায়, যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেওয়াটা একমাত্র তাদেরই বৈশিষ্ট্য। সহজেই পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলো ভুলে যায়, মুসলমানদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সন্ত্রাস পরিচালনা শুরু করার বহু আগে থেকে পৃথিবীতে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপকভাবেই ছিল। উদাহরণ হিসেবে ফিলিস্তিনে সারা দুনিয়ার ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে স্টার্ন গ্যাংইরগান এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বা এএনসি যেভাবে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ব্যবহার করেছে, তা যেকোনো মুসলিম সন্ত্রাসকে ম্লান করে দেয়। অথচ মুসলিমরাই এখন দুর্ভাগ্যে ভাগ্যবান!

 

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ