ঢাকা, রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫
২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৭ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫
২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৭ মহররম ১৪৪৭

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার রোডম্যাপ দরকার

  • ড. নিয়াজ আহম্মেদ
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার রোডম্যাপ দরকার

করোনার মতো অতিমারিতে দেশের অর্থনীতি ও শিক্ষা আজ বড় বিপন্ন। একে কেন্দ্র করে সমাজে অপরাধ ও সামাজিক অস্থিরতা আজ বেড়েই চলছে। বেকারদের জন্য সরকারি চাকরি একেবারেই বন্ধ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে আর অনেকের চাকরি থাকলেও বেতন কমে গেছে। নন-এমপিওভুক্ত ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের কথা আর না-ই বা বললাম।

সমস্যা অন্যদিকেও—করোনায় চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেক পরিবার আজ নিঃস্ব, অসহায়। নতুন কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ দেখছি না, যেখানে সরকারকে প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখতে দেখা যায়। বড় উদ্যোক্তা ও নিম্নবিত্তদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকলেও মধ্যবিত্তদের জন্য কোনো কিছুই নেই। তারা না পারছে অন্যের কাছে হাত পাততে, না আছে তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা।
চলমান লকডাউনের মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্তে দ্রুত পরিবর্তনে কলকারখানা খুলে গেল অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। এখানে কোনো চাপ আমরা অনুভব করছি না। নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নিদের্শনা বা রোডম্যাপ। অথচ শিক্ষা একটি বড় এবং এতটাই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র, যার ওপর নির্ভর করে আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
শিক্ষার্থীরা যদি ভালোভাবে না শিখে ডিগ্রি অর্জন করে, তাহলে আমরা ভবিষ্যতে বিপদে পড়ব। দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি তৈরি হবে। শিক্ষার্থীদের এভাবে বসিয়ে রাখাও কাম্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞদের মতামত বিশ্লেষণে যা দাঁড়ায় তা হলো, করোনা এত সহজে নির্মূল হওয়ার কোনো বিষয় নয়। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৫ শতাংশের নিচে না এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না—এমন ধারণা থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
আমাদের এমন একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, যেখানে কিভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায়, এর নির্দেশনা থাকবে।

আমরা টিকার স্বল্পতা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। মেডিক্যালের শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমাদের প্রথম কাজ মেডিক্যাল কলেজগুলো খুলে দেওয়া এবং তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা। অন্তত ১৫ দিনেই আমরা বুঝতে পারব শিক্ষার্থীদের পদচারণে করোনার গতি-প্রকৃতি। এরপর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পালা। আমার জানা মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে টিকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যেতে পারে। এখানেও আমাদের সব কিছু পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়ে একটু অপেক্ষা করা যেতে পারে। কেননা আমরা এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারিনি। অক্টোবর কিংবা নভেম্বরে পরীক্ষা নিলে ক্ষতি কী। তবে সব শিক্ষককে এ সময়ে টিকার আওতায় আনা জরুরি, যাতে করোনার বর্তমান ঢেউ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলতে পারি। লাখ লাখ ভর্তীচ্ছুকে টিকার আওতায় এনে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা সম্ভব নয়। করোনা স্বাভাবিক হলে আমরা ভর্তি পরীক্ষা সশরীরে নিতে পারব, কিন্তু তা সম্ভব না হলে আমাদের বিকল্পও ভাবতে হবে। টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অগ্রাধিকার পাওয়া এখন সময়ের দাবি। কেননা শিক্ষকদের টিকা না দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব নয়। সরকার এরই মধ্যে ১১ আগস্টের মধ্যে সব শিক্ষককে টিকা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। শিক্ষকদের উচিত, নির্দেশনা মেনে টিকা নেওয়া এবং নিজেদের পাঠদানের জন্য প্রস্তুত করা।

রোডম্যাপ অনুযায়ী আমরা প্রথমে কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার বিষয়ে চিন্তা করতে পারি। এমনকি কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে পরীক্ষা চালানো যেতে পারে। যখন আমাদের লকডাউন থাকে না, এমনকি লকডাউনের সময়ও হাট-বাজার, পথে-ঘাটে আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাচল করি, কিন্তু যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ভাবব, তখন কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার কথাই ভাবতে হবে। ইউজিসি চেয়ারম্যানের এক সাক্ষাৎকারে আমরা জানতে পারলাম, আগামী দুই মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরিকল্পনার কথা। খুবই ভালো সংবাদ। আমরাও চাই, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে যাক, কিন্তু এর জন্য প্রস্তুতি দরকার। সবার একই কথা, করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত। সরকার চাপে পড়ে হোক কিংবা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য হোক, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখছে না, কিন্তু যৌক্তিক কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে না। মাসের পর মাস এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলে এর প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে আজ হয়তো পড়ছে না, কিন্তু আগামী দিনে পড়বে। আমাদের রোডম্যাপের অন্যতম লক্ষ্য এমন এক প্রস্তুতি নেওয়া, যেখানে করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারি। সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের টিকার আওতায় এনে তাঁদের প্রস্তুত রাখতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি নির্দেশনা তৈরি করা, যেখানে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কী ধরনের শাস্তি পেতে হয়, তার উল্লেখ থাকবে। আমাদের প্রয়োজনেই আমাদের কঠোর হতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারকে ঢেলে সাজানো উচিত। এখানে পর্যাপ্ত বেড, আইসোলেশন সেন্টার এবং অক্সিজেনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার ও অন্যান্য সাপোর্ট স্টাফ নিয়োগ দিয়ে একটি ছোট হাসপাতালে রূপান্তরিত করতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চৌকস স্বেচ্ছাসেবী দল তৈরি করতে হবে, যাদের কাজ হবে কোনো শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা। এ ছাড়া প্রতিটি আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি তদারকি টিম গঠন করতে হবে। সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুল্যান্স প্রস্তুত রাখতে হবে। সার্বিক বিষয় তদারকির জন্য শিক্ষকদের নিয়ে একটি তদারকি ও সমন্বয় কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে গঠন করতে হবে। প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ থাকতে হবে। কলেজ পর্যায়েও এমন নির্দেশনা ও তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। মোটকথা, শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পাশাপাশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য পূর্বপ্রস্তুতিমূলক একটি পরিকল্পনা এবং কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, আমরা যদি দুই মাস সময় নিয়ে টিকা প্রদান এবং উল্লিখিত কাজগুলো করতে পারি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুল খোলা কোনো সমস্যাই নয়।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

neazahmed_2002@yahoo.com

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বিদেশে বাংলাদেশিদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া

    আবু তাহের খান
শেয়ার
বিদেশে বাংলাদেশিদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া

সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে মালয়েশীয় পুলিশ ৩৬ জন বাংলাদেশিকে আটক করেছে। মালয়েশিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ এর আগেও উঠেছে এবং সেসব কারণে অতীতে বহু বাংলাদেশিকে দেশে ফেরতও পাঠানো হয়েছে। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর তো মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়াই প্রায় বন্ধ রেখেছিল।

বাংলাদেশি লোকজন শুধু যে মালয়েশিয়ায় গিয়েই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে তা-ই নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অপরাপর দেশে গিয়েও তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে বা সে ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।

তবে অন্যান্য দেশে গিয়ে ঘটানো অপরাধ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হুবহু মালয়েশিয়ার অনুরূপ নয়। অন্যান্য দেশে গিয়ে তারা হয় ভিসার মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও সেখানে অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করে অথবা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য দেশেও তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এসব অপরাধ সাম্প্রতিক সময়ে এতটাই বেড়ে গেছে যে অনেক দেশ বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে কিংবা তা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।

চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিরা আগে খুব সহজেই ভিসা পেয়ে যেতেন। কিন্তু তা এখন এতটাই কড়াকড়ি করা হয়েছে যে বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশির ভিসা আবেদন এখন নিয়মিতই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস এখন বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান অনেকটা বন্ধই করে দিয়েছে এই অভিযোগে যে ভিসার মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও বহু বাংলাদেশি ওই সব দেশ ছাড়ছেন না কিংবা সেসব দেশে থেকেই অন্যবিধ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। ফলে পর্যটক ভিসায় সেসব দেশে যাওয়া এখন প্রায় বন্ধ।

প্রায় একই অবস্থা এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রেও। সেসব দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের ভিসা পাওয়া আগে এতটাই সহজ ছিল যে পর্যটন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেসব দেশে পর্যটক পাঠানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হন্যে হয়ে বিজ্ঞাপন দিত। কিন্তু উজবেকিস্তান, কাজাখস্তানসহ সেই দেশগুলোও এখন বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে চায় না। বাংলাদেশিদের প্রতি মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু যে পর্যটকদের জন্যই দুঃসংবাদ তা-ই নয়, বরং এর সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে যাচ্ছে ওই সব দেশে বাংলাদেশি পণ্যের যে বিপুল বাজার-সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তার ওপর। আগে দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় কোনো দেশেই বাংলাদেশিরা তেমন একটা যেতে চাইতেন না।

এখন আফ্রিকার দেশগুলোও বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশ তো এরই মধ্যে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ভিসা প্রদান পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। সেটি আবার কবে চালু হবে, কেউ তা জানে না, এমনকি যারা ভিসা দেবে, তারাও না।

অন্যদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা পাওয়া অনেক আগে থেকেই কঠিন। গত ৪ জুন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানের বিষয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা শুধু আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরই পরপন্থী নয়, জাতিগত অপমানেরও এক লিখিত ভাষ্য। সেখানে তারা বাংলাদেশি ভিসাপ্রার্থী নাগরিকদের উদ্দেশে লিখেছে, যদি কর্মকর্তাদের মনে হয়, কারো যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য সেখানে সন্তান জন্ম দিয়ে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা, তবে তার পর্যটন ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে। কী আশ্চর্য বাক্যাচার!

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের এই যে ক্রমবর্ধমান হারে নানা জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং অন্য নানাবিধ অপরাধ ও আইন ভঙ্গের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, এর প্রতিকার কী? এর প্রতিকার আইন করে বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিকভাবে প্রণোদিত করে সাধন করা সম্ভব নয়। আসলে এটি একটি জাতিগোষ্ঠী ও সমাজের নানা আচার-আচরণ ও মূল্যবোধের দীর্ঘকালীন চর্চারই ক্রমরূপান্তরজনিত ফলাফল। দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষের মধ্যে যে সুউচ্চ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের পরিচালকরা সেটি ধরে রাখতে তো পারেনইনি, বরং দিনে দিনে তার আরো অধঃপতন ঘটিয়েছেন। ফলে এ সময়ের মধ্যে এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দেশের ভেতরে বা বাইরে যখন যেখানেই গেছে, সেখানেই তারা নিজেদের মর্যাদাপূর্ণভাবে তুলে ধরার পরিবর্তে আরো নানাবিধ অপরাধী আচরণ ও চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছে, যা বস্তুত একাত্তরের মূল্যবোধ ও ভাবমূর্তিকে ধরে রাখতে না পারারই ফল।

অন্যদিকে দেশ, রাষ্ট্র ও সমাজ বর্তমানে যে ধারায় এগোচ্ছে, তাতে দেশ-বিদেশের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এ দেশের নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান হারে জড়িয়ে পড়া থেকে শিগগির পরিত্রাণ মিলবে বলে তো মনে হচ্ছে না। তার পরও একটি ছোট্ট সাময়িক প্রস্তাব : বিদেশের বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো যদি কাগুজে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে মমতা ও আন্তরিক দায়বোধ নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে তাঁদের ওই ক্ষুদ্র অপরাধী অংশের অধঃপতনশীল আচরণ বহুলাংশেই সীমিত হয়ে আসবে বলে আশা করা যায়।

 

লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)

শিল্প মন্ত্রণালয়

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

দক্ষিণ এশিয়ার ফ্যাশন : একটুখানি দৃষ্টিভঙ্গির অভাব

    মো. রায়হান কবির
শেয়ার
দক্ষিণ এশিয়ার ফ্যাশন : একটুখানি দৃষ্টিভঙ্গির অভাব
সংগৃহীত ছবি

একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশ নির্ধারিত হয় কেবল উৎপাদন দক্ষতা দ্বারা নয়, বরং সেই অঞ্চলের কল্পনার সীমা, চিন্তার গভীরতা এবং নিজের গল্প বলার সক্ষমতার মাধ্যমে। দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম পোশাক উৎপাদনকারী অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। তবে এখনো জন্ম নিতে পারেনি কোনো গ্লোবাল ব্র্যান্ড। বাংলাদেশ আজ বছরে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করে প্রধানত অন্যের ব্র্যান্ড নামের ছায়ায়।

ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা মিলে দক্ষিণ এশিয়ার মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০০ বিলিয়নের কাছাকাছি। অথচ এই উপমহাদেশ থেকে Zara, Uniqlo কিংবা H&M-এর মতো হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ড এখনো উঠে আসেনি।

কারণটি ডিজাইন বা বাজেট নয়, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয়, মূল সমস্যা আমাদের ব্র্যান্ড নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তার অভাব। বিশ্বের প্রধান ব্র্যান্ডগুলো প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট কাস্টমার গ্রুপের অন্তর্নিহিত চাহিদা, আবেগ ও স্বপ্নকে নিজেদের ব্র্যান্ডে রূপ দিয়েছে।

Zara তার ফাস্ট ফ্যাশন আর স্বল্প বাজেটের মিশ্রণে তৈরি করেছে সাশ্রয়ী কিন্তু ট্রেন্ডি লাইফস্টাইলের প্রতিচ্ছবি। Patagonia তার সাস্টেইনেবল ফ্যাশন মডেল দিয়ে নির্মাণ করেছে এক নতুন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। Uniqlo-এর LifeWea কনসেপ্ট আমাদের শেখায় সঠিক প্রোডাক্টের সঠিক মার্কেটিং হলে একটি ব্র্যান্ড গড়ে উঠতে পারে একটি জীবনের ভাষা হিসেবে।

অন্যদিকে আমরা এখনো বলতে চাই এই জামাটা ভালো, এই জুতাটা টেকসই, দামটা তুলনামূলক কম

কিন্তু ভোক্তা কেন কিনবে, কেন এই ব্র্যান্ডটিকে সে বিশ্বাস করবেএগুলোর ওপর নির্ভর করে ব্র্যান্ড স্টোরি আমরা তৈরি করি না। আমাদের ডিজাইন স্ট্র্যাটেজিতেও দেখা যায় স্টাইলে ধারাবাহিকতার অভাব। যেখানে গ্লোবাল ফ্যাশন এখন ‘clean lines’, ‘local aesthetics with modern context’, ‘culturally adaptive silhouettes’—এই তিনটি রূপরেখার মধ্য দিয়ে চলছে, সেখানে আমাদের ডিজাইন মেসেজ এখনো মাঝপথে দাঁড়িয়ে।

আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা আমাদের কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স ডিজাইন ও ডিজিটাল কমার্স রেডিনেস। একজন ইউরোপীয় বা আমেরিকান ক্রেতা এখন শুধু প্রোডাক্ট নয়, চায় একটি ডিজিটাল ব্র্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স যেখানে সহজ ব্রাউজিং, প্রোডাক্টের সঠিক ছবি বা ভিডিও, ফিট প্রেডিকশন, ঝামেলামুক্ত রিটার্ন পলিসি, কাস্টমার কেয়ার...সবকিছুই থাকবে।

আমরা অনেকাংশেই এই ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে পারিনি।

ব্র্যান্ড কমিউনিকেশনের দিক থেকেও আমরা বেশ পিছিয়ে। আমাদের সেগমেন্টেশন এবং টার্গেটিং হয় প্রচলিত প্যাটার্নে, যেখানে বয়স, আয়, অবস্থান দেখে ভোক্তাকে ভাগ করা হয়। কিন্তু ভোক্তার সাইকোগ্রাফি বুঝে তার ওপর নির্ভর করে লাইফস্টাইলের মাইক্রো সেগমেন্টেশন নিয়ে আমরা খুব বেশি কাজ করি না। আরেকটি জটিলতা হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি। ব্র্যান্ড প্রফেশনালরা কর্মক্ষেত্রে তাদের কৌশলগত দক্ষতা আর সৃজনশলতা চর্চার স্বাধীনতা পাচ্ছে না। একটি ভিজ্যুয়াল ডিজাইন, একটি ক্যাম্পেইন বা একটি ট্যাগলাইন কখনোই ব্যক্তিগত মতামতের বিষয় হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, সৃজনশীলতা বা ক্রিয়েটিভিটি একটি আপেক্ষিক বিষয় এবং ব্যক্তিভেদে এটি ভিন্ন হয়ে থাকে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই গ্লোবাল ব্র্যান্ড তৈরি করতে চাই, তবে আমাদের এই ক্রিয়েটিভিটি চর্চার স্বাধীনতা আর সাংগঠনিক জটিলতার ঊর্ধ্বে যেতে হবে।

এই অবস্থার মধ্যে আশার আলো হলো Apex Aarong| Apex তার রিটেইলিং সক্ষমতা, ম্যানুফ্যাকচারিং অভিজ্ঞতা এবং মার্কেটিং দক্ষতার মাধ্যমে আজ অনেকটাই রিজিওনাল রিটেইল পাওয়ারহাউস হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে Aarong তার দেশীয় ঐতিহ্য বহন করা ডিজাইন, কারিগর ক্ষমতায়নের মডেল আর শিকড়ঘেঁষা ব্র্যান্ড দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিকে একটি মৌলিক ও আধুনিক রূপ দিয়েছে।

এখানে রাষ্ট্রকেও নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একটি জাতীয় ব্র্যান্ড উদ্যোগ কার্যক্রম, ফ্যাশন প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক ফ্যাশন বাণিজ্যের প্রতিনিধিদল গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্লেয়ার হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। বিশ্বে বহু ব্র্যান্ড রয়েছে, যারা স্থানীয় বাজারের ছোট একটি চাহিদা নিয়ে শুরু করেছিল।

বাংলাদেশের ফ্যাশন বাজার গত তিন দশকে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকে যেখানে ফ্যাশন মানেই ছিল ঈদে নতুন জামা, এখন তা হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত স্টাইল প্রকাশের মাধ্যম। আমরা কে, আমাদের পোশাকে কী গল্প লুকিয়ে আছে এবং বিশ্বকে কী দেখাতে চাই এই তিনটি প্রশ্নের উত্তরেই গড়ে উঠবে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ফ্যাশন ব্র্যান্ড।

সত্যিকারের ব্র্যান্ড কেবল একটি পণ্য বিক্রির নাম নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি সম্পর্ক। আর এটি যদি আমরা বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে একদিন হয়তো বিশ্বের ফ্যাশন সাময়িকীতে লেখা থাকবে ‘Made in Bangladesh, Worn Around the World’!

লেখক : মার্কেটিং পেশাজীবী, ফ্যাশন রিটেইল ইন্ডাস্ট্রি

মন্তব্য

আগামী নির্বাচন হবে অত্যন্ত কঠিন

    গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
আগামী নির্বাচন হবে অত্যন্ত কঠিন

বিগত জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মারণাস্ত্র ব্যবহারসংক্রান্ত বিবিসির রিপোর্ট নিশ্চিতকরণ এবং চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার আদেশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। উপরোক্ত দুটি বিষয় নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে এখন এক স্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর দেশের রাজনীতিতে যে মেরুকরণ শুরু হয়েছিল, তা আরো গতি লাভ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। হাসিনার অবর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) তাঁর বিচার, আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখা কিংবা একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারেও বিএনপির আগের অবস্থানে এখন পরিবর্তন আসছে।

মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেছেন যে শেখ হাসিনার একক আদেশেই জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনামলে বিএনপিই তাদের রোষানলে পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। এর জন্য আওয়ামী লীগেরও বিচার হওয়া উচিত।

আন্দোলনকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার স্বকণ্ঠে প্রদত্ত নির্দেশ বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগে সেটি যাচাই করে বিশ্বময় প্রচার করেছে বিবিসি।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনা আইসিসিতে পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনার আহবান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এরই মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। গত বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। সুতরাং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার অপরাধে https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/13-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgবিচার করা কিংবা তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের চিহ্নিত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আর কোনো বাধা থাকতে পারে না বলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা মনে করেন।
এতে বিএনপির অভ্যন্তরে একটি মহলের মধ্যে শেখ হাসিনার বিচার কিংবা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, তা এখন দ্রুত অপসারিত হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এত দিন যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, তা-ও এখন কেটে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যবস্থা চূড়ান্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিশ্চিত করেছেন। সম্ভবত এরই ভিত্তিতে বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমরা আর সাত-আট মাস সরকারে থাকছি। তিনি আরো বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এবং আমি কিছু মৌলিক সংস্কার করতে খুবই সিরিয়াস।

আমরা কোনো দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে যাব না। যতটুকু সংস্কার শুরু হয়েছে, আমরা সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। সরকার মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিচ্ছে। নির্বাচন ও সংস্কার প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ও জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি অত্যন্ত শক্ত ভাষায় বলেছিলেন যে বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মেনে নেব না। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, মৌলিক সংস্কারগুলো নির্বাচনের আগেই হতে হবে। এখন বিভিন্ন ঘটনার অগ্রগতি ও বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অবস্থানগত দূরত্ব ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। তবে নির্বাচনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বিভেদ সৃষ্টির জন্য ইস্যুর অভাব হবে না। কারণ ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক তরুণ নেতা এবং বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমরা বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি করছি। এ ক্ষেত্রে যারা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কিংবা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব বিষয়ে বিরোধ রয়েছে, তাতে যারা ঐকমত্য পোষণ করবে না, তাদের সঙ্গে কোনো বিষয়েই নাগরিক পার্টির কোনো বোঝাপড়া হবে না।

এ কথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খবরে অনেকে এখনই কিছুটা উদ্বেলিত হয়ে উঠেছেন। দেশজুড়ে একটা নির্বাচনের আমেজ সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ দেড় দশক সময়ে দেশের বেশির ভাগ মানুষ নির্বাচনে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেনি। এখন এক ধরনের প্রশান্তি এবং স্বস্তি তাদের মনে কাজ করতে শুরু করেছে। তবে নির্বাচন নিয়ে আমাদের সব দুশ্চিন্তার অবসান এখনো হয়নি। কয়েক মাস ধরে দেশে সংখ্যানুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি উঠেছে। দেশের সব গণতান্ত্রিক দল না হলেও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করেছে। এই পদ্ধতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে কোনো নির্বাচনী এলাকায় কোনো দলের বাছাইকৃত প্রার্থী দেওয়া হয় না। ভোটাররা বিভিন্ন দলের দলীয় প্রতীকে ভোট প্রদান করে থাকেন। এতে যে দলীয় প্রতীক দেশব্যাপী সর্বাধিক ভোট লাভ করতে সমর্থ হয়, সে দলই সরকার গঠন করে। বিজয়ী দল নির্বাচন শেষে বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে তাদের দলীয় প্রতিনিধির নাম ঘোষণা করে এবং সরকার গঠন করে থাকে। এতে এক আসনে কোনো দলেরই একাধিক প্রার্থীর মনোনয়ন নিয়ে লড়াই কিংবা মারামারির আশঙ্কা থাকে না। একটি সাধারণ নির্বাচনে যে কয়টি দল অংশগ্রহণ করে থাকে এবং তারা দেশব্যাপী যে পরিমাণ মোট ভোট সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়, সে সংখ্যানুপাতেই বিভিন্ন দলের মধ্যে আসন বণ্টন করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ভোট না পেলে একাধিক দল নিয়ে কোয়ালিশন সরকারও গঠিত হতে পারে। ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই পদ্ধতি চালু থাকলেও আমাদের দেশে এটি এখনো অজানাই রয়ে গেছে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতিতে তাদের যোগ্য প্রতিনিধিদের সংসদে পাঠাতে পারে তুলনামূলকভাবে অনেক কম ঝক্কি-ঝামেলায়। এ ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ আরো কয়েকটি দল বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছে। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি এই পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে। দলের বর্ষীয়ান নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনের সঙ্গে দেশের সাধারণ নাগরিকরা এখনো পরিচিত হয়ে ওঠেনি। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে গেলে এখন ঘাটে ঘাটে নানা ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং প্রতিবেশী বড় রাষ্ট্রের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব কিংবা আধিপত্য বিস্তার ঠেকানোর ব্যাপারে উদগ্রীব দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের জনগণও সে ব্যাপারে এখন অনেক স্পর্শকাতর। দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির বিরুদ্ধে এসব ব্যাপারে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যরা ক্রমেই সমালোচনামুখর হয়ে উঠছে। জানতে চাচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে? বাংলাদেশের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দর ও ভূখণ্ড ব্যবহার, তথাকথিত করিডর কিংবা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কী করতে যাচ্ছে বিএনপি? বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী তরুণ প্রজন্ম তাদের জাতীয় স্বার্থ, ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক স্বার্থ রক্ষায় আগের তুলনায় অনেক সচেতন। ছেলে-ভোলানো রাজনীতি করে আগের মতো আর পার পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তারা বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অতীতের রেকর্ড নিয়ে দিনে দিনে অত্যন্ত সোচ্চার হয়ে উঠছে। যে দল রাজনীতির ক্ষেত্রে যত বেশি বিদেশনির্ভর কিংবা আধিপত্যবাদের প্রভাবাধীন হতে চেষ্টা করবে, তারা আগামী দিনে ততটাই জনসমর্থন বা ভোট হারাতে থাকবে। দেশি-বিদেশি অপশক্তির দালালি কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে কেউ বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। সে কারণেই আগামী নির্বাচন কিংবা নির্বাচনগুলো হবে অত্যন্ত কঠিন ও সংকটময়। এ ধারণা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক কিংবা ভোটারের।

 

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

মন্তব্য

নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা পরিষ্কার হলো না

    এমরান কবির
শেয়ার
নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা পরিষ্কার হলো না

আমাদের রাজনীতিতে সন্দেহ জিনিসটা নতুন কিছু না। কিছুদিন আগেও এই সন্দেহটা ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল নির্বাচন ঘিরে। সরকার যখন সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করছিল না, তখনই এই সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি প্রথমে ক্ষীণকণ্ঠে আওয়াজ তুলল সুনির্দিষ্ট তারিখের দাবি নিয়ে।

সরকার অভিযোগ করল, শুধু একটি দল নির্বাচন চাচ্ছে। এরপর বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনৈতিক অবিশ্বাস ক্ষীণকণ্ঠে আবৃত থাকল না, প্রকাশ্য হলো। সরকার ও রাজনৈতিক দলের এই স্নায়ুযুদ্ধ উভয় পক্ষকে প্রায় মুখোমুখি করে তুলল। কোরবানির ঈদের আগে ঈদের পর আন্দোলনের আভাস দিয়ে ফেলল বিএনপি।
এর পরই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের বৈঠকের পর যখন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে সমঝোতা হয়ে গেল, তখন দেশবাসী হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কারণ এই সমঝোতা ব্যর্থ হলে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের আশঙ্কা করছিল সচেতন মহল। আপাতত সবাই স্বস্তি বোধ করল।

যে যাই-ই বলুক না কেন, এখন জনগণ কয়েকটি জিনিস চায়।

একটি হলো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে ন্যূনতম সংস্কার, জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার,  দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার বিষয়ে সবার সহমত ও পথনকশা এবং নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সংক্রান্ত যে সংস্কার ও ঐকমত্য প্রয়োজন, দেশবাসী তা চায় সবার আগে। চায় সরকার এটির প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিক এবং গতিময় ও দৃশ্যমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখুক। সব কাজেরই ধারাবাহিকতা থাকে, থাকে যথাযথ গতি। এই ধারাবাহিকতা ও গতিময়তার ব্যতিক্রম ঘটলে যথারীতি সন্দেহ চলে আসে।

গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃততিতে বলা হয়, সব প্রস্তুতি শেষ করা গেলে ২০২৬ সালে পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন। সে ক্ষেত্রে ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির প্রয়োজন হবে।

এরই মধ্যে জুনের শেষ সপ্তাহে গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, লন্ডন বৈঠকের কোনো প্রতিফলন নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে দৃশ্যমান না হওয়ায় এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি ও সমানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ আরো কিছু বিষয় নতুন করে সামনে আনার চেষ্টা হচ্ছে, যা জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উদ্দেশ্য বলে মনে করছে বিএনপি।

বিএনপির সন্দেহের পেছনে যথেষ্ট যুক্তি, কারণ ও ভিত্তি রয়েছে। প্রথমোক্ত ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আর তাত্ত্বিকভাবে বলা যেতে পারে, সরকার একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে অনির্দিষ্ট বিষয় দ্বারা শর্তারোপ করায় প্রথমোক্ত নির্দিষ্ট বিষয়টি অনির্দিষ্ট হয়ে গেছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। নির্বাচন কমিশনকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করার তেমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে অবধারিতভাবেই জাতীয় নির্বাচন পেছাবে। আর তা যদি যথাযথভাবে সফল না হয়, তাহলে এর ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে বিশ্লেষণ ও সমাধানের চেষ্টায় কালক্ষেপণ হতে থাকবে। আর এর ভেতরে যদি নির্বাচনপদ্ধতিতে সংখ্যানুপাতিক হার ঢুকে যায়, তাহলে কোনোভাবেই ঘোষিত সময় অনুযায়ী নির্বাচন সম্ভব হবে না।

এরই মধ্যে গত ৩০ জুন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বৈঠক করেছেন। দেশবাসী ধারণা করছিল নির্বাচনবিষয়ক দিকনির্দেশনা থাকতে পারে ওই বৈঠকে। কিন্তু ১ জুলাই সিইসি সংবাদ সম্মেলনে জানালেন ওই বৈঠক ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ। নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা না হলেও ফুল গিয়ারে চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। আর সেটি আগামী ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিল-এ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে এতে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা একটুও পরিষ্কার হলো না।  জিনিসপত্র বিক্রির জন্য প্রায়ই কম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের অফার দিয়ে থাকে। সেখানে দেখা যায়, ছাড় দেওয়া হয়েছে ৫০, ৬০ বা ৭০ শতাংশ, যা লেখা থাকে বেশ বড় অক্ষরে। তার নিচেই স্টার চিহ্ন দেওয়া থাকে কিংবা ছোট অক্ষরে লেখা থাকে আপ টু। স্টার চিহ্নের ব্যাখ্যা হিসেবে দেওয়া থাকে শর্ত প্রযোজ্য, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিডেন (গুপ্ত) অবস্থায় থাকে। এখন সরকারের ঘোষিত সংস্কার ও বিচারের পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন যদি ওই আপ টু বা স্টার চিহ্নের মতো থাকে আর তার ভেতরে যদি দুর্বোধ্য শর্ত থাকে, তাহলে তো সন্দেহের অবকাশ থাকেই। সরকারকে ওই স্টার চিহ্ন বা আপ টুকে খোলাসা করতে হবে।

একটি কৌতুক দিয়ে শেষ করি। কপি করা কৌতুক। কৌতুকে কোনো যুক্তি খোঁজাটাই যুক্তিহীন। একবার একটি বিমান ক্রাশ করে সবাই মারা গেল। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে গেল ওই বিমানের এক যাত্রী। সে একটি বাঁদর। তো বিমান ক্রাশের রহস্য উদঘাটনের জন্য বাঁদরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হলো। প্রথমেই জিজ্ঞেস করা হলো, বিমান ধ্বংসের আগে পাইলট কী করছিল? বাঁদর তো আর কথা বলতে পারে না। তাই  দুই হাত এক করে মাথার নিচে দিয়ে মাথা কাত করে দেখাল। তার মানে হলো পাইলট ঘুমাচ্ছিল। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো কো-পাইলট কী করছিল। বাঁদর একই রকম ভঙ্গি করে দেখাল। ক্রু? বাঁদর একই ভঙ্গি করে দেখাল। যাত্রীরা? বাঁদর এবারও একই ভঙ্গি করে দেখাল। তার মানে সবাই ঘুম। বাকি থাকে বাঁদর। তাকে এবার জিজ্ঞেস করা হলো তুমি কী করছিলে? বাঁদরটি তখন দুই হাত দিয়ে স্টিয়ারিং ঘোরানোর অভিনয় করে দেখাল। তার মানে সবাই যখন ঘুমাচ্ছিল, তখন সেই বাঁদরটিই বিমান চালাচ্ছিল। আর তার পরিণতি বিমান ধ্বংস হয়ে সবার মৃত্যু।

সবাই ঘুমালে কিন্তু বিমান চালাতে পারে ওই রকম বাঁদর।

লেখক : কবি-কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ