একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশ নির্ধারিত হয় কেবল উৎপাদন দক্ষতা দ্বারা নয়, বরং সেই অঞ্চলের কল্পনার সীমা, চিন্তার গভীরতা এবং নিজের গল্প বলার সক্ষমতার মাধ্যমে। দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম পোশাক উৎপাদনকারী অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। তবে এখনো জন্ম নিতে পারেনি কোনো গ্লোবাল ব্র্যান্ড। বাংলাদেশ আজ বছরে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করে প্রধানত অন্যের ব্র্যান্ড নামের ছায়ায়।
ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা মিলে দক্ষিণ এশিয়ার মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০০ বিলিয়নের কাছাকাছি। অথচ এই উপমহাদেশ থেকে Zara, Uniqlo কিংবা H&M-এর মতো হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ড এখনো উঠে আসেনি।
কারণটি ডিজাইন বা বাজেট নয়, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয়, মূল সমস্যা আমাদের ব্র্যান্ড নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তার অভাব। বিশ্বের প্রধান ব্র্যান্ডগুলো প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট কাস্টমার গ্রুপের অন্তর্নিহিত চাহিদা, আবেগ ও স্বপ্নকে নিজেদের ব্র্যান্ডে রূপ দিয়েছে।
Zara তার ফাস্ট ফ্যাশন আর স্বল্প বাজেটের মিশ্রণে তৈরি করেছে সাশ্রয়ী কিন্তু ট্রেন্ডি লাইফস্টাইলের প্রতিচ্ছবি। Patagonia তার সাস্টেইনেবল ফ্যাশন মডেল দিয়ে নির্মাণ করেছে এক নতুন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। Uniqlo-এর LifeWea কনসেপ্ট আমাদের শেখায় সঠিক প্রোডাক্টের সঠিক মার্কেটিং হলে একটি ব্র্যান্ড গড়ে উঠতে পারে একটি জীবনের ভাষা হিসেবে।
অন্যদিকে আমরা এখনো বলতে চাই ‘এই জামাটা ভালো’, ‘এই জুতাটা টেকসই’, ‘দামটা তুলনামূলক কম’।
কিন্তু ভোক্তা কেন কিনবে, কেন এই ব্র্যান্ডটিকে সে বিশ্বাস করবে—এগুলোর ওপর নির্ভর করে ব্র্যান্ড স্টোরি আমরা তৈরি করি না। আমাদের ডিজাইন স্ট্র্যাটেজিতেও দেখা যায় স্টাইলে ধারাবাহিকতার অভাব। যেখানে গ্লোবাল ফ্যাশন এখন ‘clean lines’, ‘local aesthetics with modern context’, ‘culturally adaptive silhouettes’—এই তিনটি রূপরেখার মধ্য দিয়ে চলছে, সেখানে আমাদের ডিজাইন মেসেজ এখনো মাঝপথে দাঁড়িয়ে।
আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা আমাদের কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স ডিজাইন ও ডিজিটাল কমার্স রেডিনেস। একজন ইউরোপীয় বা আমেরিকান ক্রেতা এখন শুধু প্রোডাক্ট নয়, চায় একটি ডিজিটাল ব্র্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স যেখানে সহজ ব্রাউজিং, প্রোডাক্টের সঠিক ছবি বা ভিডিও, ফিট প্রেডিকশন, ঝামেলামুক্ত রিটার্ন পলিসি, কাস্টমার কেয়ার...সবকিছুই থাকবে।
আমরা অনেকাংশেই এই ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে পারিনি।
ব্র্যান্ড কমিউনিকেশনের দিক থেকেও আমরা বেশ পিছিয়ে। আমাদের সেগমেন্টেশন এবং টার্গেটিং হয় প্রচলিত প্যাটার্নে, যেখানে বয়স, আয়, অবস্থান দেখে ভোক্তাকে ভাগ করা হয়। কিন্তু ভোক্তার সাইকোগ্রাফি বুঝে তার ওপর নির্ভর করে লাইফস্টাইলের মাইক্রো সেগমেন্টেশন নিয়ে আমরা খুব বেশি কাজ করি না। আরেকটি জটিলতা হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি। ব্র্যান্ড প্রফেশনালরা কর্মক্ষেত্রে তাদের কৌশলগত দক্ষতা আর সৃজনশলতা চর্চার স্বাধীনতা পাচ্ছে না। একটি ভিজ্যুয়াল ডিজাইন, একটি ক্যাম্পেইন বা একটি ট্যাগলাইন কখনোই ব্যক্তিগত মতামতের বিষয় হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, সৃজনশীলতা বা ক্রিয়েটিভিটি একটি আপেক্ষিক বিষয় এবং ব্যক্তিভেদে এটি ভিন্ন হয়ে থাকে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই গ্লোবাল ব্র্যান্ড তৈরি করতে চাই, তবে আমাদের এই ক্রিয়েটিভিটি চর্চার স্বাধীনতা আর সাংগঠনিক জটিলতার ঊর্ধ্বে যেতে হবে।
এই অবস্থার মধ্যে আশার আলো হলো Apex ও Aarong| Apex তার রিটেইলিং সক্ষমতা, ম্যানুফ্যাকচারিং অভিজ্ঞতা এবং মার্কেটিং দক্ষতার মাধ্যমে আজ অনেকটাই রিজিওনাল রিটেইল পাওয়ারহাউস হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে Aarong তার দেশীয় ঐতিহ্য বহন করা ডিজাইন, কারিগর ক্ষমতায়নের মডেল আর শিকড়ঘেঁষা ব্র্যান্ড দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিকে একটি মৌলিক ও আধুনিক রূপ দিয়েছে।
এখানে রাষ্ট্রকেও নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একটি জাতীয় ব্র্যান্ড উদ্যোগ কার্যক্রম, ফ্যাশন প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক ফ্যাশন বাণিজ্যের প্রতিনিধিদল গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্লেয়ার হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। বিশ্বে বহু ব্র্যান্ড রয়েছে, যারা স্থানীয় বাজারের ছোট একটি চাহিদা নিয়ে শুরু করেছিল।
বাংলাদেশের ফ্যাশন বাজার গত তিন দশকে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকে যেখানে ফ্যাশন মানেই ছিল ‘ঈদে নতুন জামা’, এখন তা হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত স্টাইল প্রকাশের মাধ্যম। ‘আমরা কে’, ‘আমাদের পোশাকে কী গল্প লুকিয়ে আছে’ এবং ‘বিশ্বকে কী দেখাতে চাই’ এই তিনটি প্রশ্নের উত্তরেই গড়ে উঠবে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ফ্যাশন ব্র্যান্ড।
সত্যিকারের ব্র্যান্ড কেবল একটি পণ্য বিক্রির নাম নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি সম্পর্ক। আর এটি যদি আমরা বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে একদিন হয়তো বিশ্বের ফ্যাশন সাময়িকীতে লেখা থাকবে ‘Made in Bangladesh, Worn Around the World’!
লেখক : মার্কেটিং পেশাজীবী, ফ্যাশন রিটেইল ইন্ডাস্ট্রি