<p>পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি হওয়ার কারণগুলোকে বোঝার জন্য কিছু প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক উপাদান বিবেচনা করতে হবে। পদ্মা নদী বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী, যার প্রবাহ অনেক দীর্ঘ এবং শক্তিশালী। পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ, এর মিঠা এবং লবণাক্ততার ভারসাম্য, এবং স্রোতের গতিবেগ—এসব উপাদান ইলিশ মাছের স্বাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। পদ্মার ইলিশ সাধারণত সমুদ্র থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মায় পৌঁছায়, যার ফলে এদের মাংস মজবুত হয় এবং প্রাকৃতিক তেলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এই তেল ইলিশের আরও কোমল ও স্বাদে পরিপূর্ণ করে তোলে।</p> <p>সাধারণত সমুদ্র থেকে নদীর দিকে আসার পথে ইলিশ মাছ খুব বেশি খাদ্য গ্রহণ করে না। সমুদ্রের প্ল্যাঙ্কটন, ওয়াটার ফ্লি, এবং অন্যান্য খাদ্য গ্রহণের ফলে ইলিশের দেহে তেলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যখন তারা মিঠা পানিতে প্রবেশ করে, তখন এই তেল ভেঙে যায় এবং একটি বিশেষ ফ্যাটি অ্যাসিড (পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বা PUFA) তৈরি হয়। এই ফ্যাটি অ্যাসিড ইলিশের স্বাদকে আরও বৃদ্ধি করে এবং এটিকে অন্য ইলিশের তুলনায় বেশি সুস্বাদু করে তোলে।</p> <p>পদ্মার স্রোতের শক্তি ইলিশ মাছকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বাধ্য করে, যার ফলে তাদের পেশি শিথিল হয়ে মাংস নরম হয়ে আসে। এভাবে তাদের স্বাদ ও গন্ধ উন্নত হয়। এছাড়া, পদ্মার পানির স্বচ্ছতা এবং এর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধতা ইলিশের পুষ্টি মান বৃদ্ধি করে, যা স্বাদেরও উন্নতি ঘটায়। এই কারণেই পদ্মার ইলিশের স্বাদ অন্য নদীর ইলিশের চেয়ে আলাদা এবং বেশি হয়।</p> <p><strong>গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের পার্থক্য কী?</strong><br /> গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের উৎস যদিও একই, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর, তবুও এদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। সরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশে তিন ধরনের ইলিশ পাওয়া যায়: সাধারণ ইলিশ, চন্দনা ইলিশ, এবং গুর্তা ইলিশ। অন্যদিকে, গঙ্গার ইলিশ মূলত দুটি ধরনের হয়: ঝাটকা ইলিশ এবং বড় ইলিশ। পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে ঝাটকা ইলিশকে খয়রা বা পিল মাছ বলা হয় এবং কিছুটা বড় ইলিশকে কোকিলা ইলিশ নামে বিক্রি করা হয়।<br /> গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের আকার এবং গঠনগত পার্থক্য তেমন না থাকলেও স্বাদে ভিন্নতা দেখা যায়। পদ্মার ইলিশের উজ্জ্বলতা এবং মাংসের কোমলতা গঙ্গার ইলিশের তুলনায় বেশি হয়। পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো পদ্মা নদীর লম্বা পথ এবং স্রোতের শক্তি, যা ইলিশের পেশি ও তেলের গঠনকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে, গঙ্গার ইলিশের স্বাদ কিছুটা কম হয়, কারণ গঙ্গার ইলিশকে তেমন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় না।</p> <p><strong>ইলিশের স্বাদে পার্থক্যের কারণ</strong><br /> ইলিশের স্বাদে পার্থক্য অনেক ক্ষেত্রে মাছের খাদ্যাভ্যাসের ওপর নির্ভর করে। সমুদ্র থেকে নদীর দিকে যাত্রা করার সময় ইলিশ খুব বেশি খাদ্য গ্রহণ করে না। তবে সমুদ্রের ইলিশ মূলত প্ল্যাঙ্কটন এবং অন্যান্য ছোট প্রাণী খেয়ে থাকে। এসব খাদ্যাভ্যাস ইলিশের দেহে তেল জমাতে সাহায্য করে, যা ইলিশের স্বাদকে প্রভাবিত করে। কিন্তু নদীর পানিতে আসার পর, ইলিশের এই তেল ভেঙে যায় এবং স্বাদ পরিবর্তিত হয়। সমুদ্রের ইলিশের তেল অনেক সময় পেট্রলের মতো গন্ধ ধারণ করে, যা নদীর ইলিশে থাকে না। নদীতে আসার পর ইলিশের শরীর থেকে পুরানো বর্জ্য বের হয় এবং লবণাক্ততা কমে যায়, যা ইলিশের স্বাদকে উন্নত করে।</p> <p><strong>গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের চলাচল এবং স্বাদে প্রভাব</strong><br /> গঙ্গার মূল প্রবাহ পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং এর সঙ্গে মিশে যায় মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদী। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা নদী মূলত গঙ্গার মূল প্রবাহ নয়। তাই গঙ্গার স্রোত কমজোরী। ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গার ইলিশের চলাচল ব্যাহত হয়, ফলে পশ্চিমবঙ্গের ইলিশ সাধারণত হুগলি নদীতে ধরা পড়ে, যা সমুদ্র থেকে তুলনামূলকভাবে কম দূরত্বে অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের কোলাঘাট এবং ডায়মন্ড হারবারের ইলিশের স্বাদ পদ্মার ইলিশের তুলনায় কম হয়ে থাকে, কারণ এদের চলাচল কম এবং স্রোতের শক্তি কম থাকে।<br /> অন্যদিকে, পদ্মা নদীর চাঁদপুর অঞ্চলে ধরা পড়া ইলিশকে সমুদ্র থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া ইলিশের স্বাদকে উন্নত করে এবং এদের মাংসকে আরও কোমল ও স্বাদে পরিপূর্ণ করে তোলে।</p> <p><strong>ফারাক্কা বাঁধ এবং গঙ্গার ইলিশের স্বাদে প্রভাব</strong><br /> ১৯৭৮ সালে ফারাক্কা বাঁধে নেভিগেশন লক চালু হওয়ার পর থেকে গঙ্গার ইলিশের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে ইলিশের প্রজনন এবং চলাচল কমে গেছে, যা গঙ্গার ইলিশের স্বাদকে প্রভাবিত করেছে। সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা অনুযায়ী, ফারাক্কা বাঁধ স্থাপনের পর থেকে উজানের দিকে ইলিশের প্রজনন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে গঙ্গার ইলিশের স্বাদ আগের তুলনায় কমে গেছে এবং পশ্চিমবঙ্গের ইলিশের সুনাম কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।</p> <p>গঙ্গার দূষণ এবং হুগলি নদীর প্রবেশ পথে পলিমাটির জন্যও গঙ্গার ইলিশের স্বাদে ভিন্নতা দেখা যায়। ফারাক্কার নতুন নেভিগেশনাল লকগেট স্থাপনের ফলে ইলিশের চলাচল বাড়লেও দূষণের কারণে ইলিশের স্বাদ উন্নত হতে পারে না। দূষণ কমিয়ে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করলেই গঙ্গার ইলিশের স্বাদ ফিরে আসতে পারে।</p> <p><strong>বাংলাদেশের ইলিশের বিশ্বব্যাপী সুনাম</strong><br /> বিশ্বের ১১টি দেশে ইলিশ ধরা পড়লেও বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। বাংলাদেশের ইলিশের জোগান বিশ্বের ৮৬ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে, ভারত থেকে আসে মাত্র ১০ শতাংশ ইলিশ। বাংলাদেশে উৎপাদিত ইলিশ জি-আই (ভৌগলিক নির্দেশক) পণ্য হিসেবে বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জন করেছে। পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি হওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গের মানুষও পদ্মার ইলিশের স্বাদ নিতে আগ্রহী।</p> <p><strong>গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের স্বাদ পরীক্ষা</strong><br /> গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের স্বাদের প্রকৃত পার্থক্য জানতে চাইলে দুই ধরনের ইলিশ একসঙ্গে রান্না করে নিজেই চেখে দেখতে হবে। ইলিশের স্বাদে পার্থক্য থাকলেও রন্ধন কৌশলও স্বাদের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশ একসঙ্গে রান্না করে স্বাদের আসল পার্থক্য নিজেই অনুভব করতে পারেন।</p> <p>সূত্র: ফিশারিজ রিসার্চ ও ইনভারমেন্টাল বায়োলজি অব ফিশেস</p> <p><br />  </p>