<article> <p style="text-align: justify;">নবাবগঞ্জ উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের ঠিক উল্টো দিকে একটি সরু রাস্তা। আঁকাবাঁকা সেই সড়ক ধরে কিছুদূর এগোলেই চার রাস্তার মোড়। সেখানে একজনকে জিজ্ঞেস করে তাঁর কথামতো কিছুদূর এগোতেই কানে এলো শিশুদের কোরাস। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল মেহগনির সারির নিচে গোল হয়ে বসে আছে ১৪-১৫টি শিশু।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সবাই সমস্বরে বলছে, ‘পৃথিবীটা দেখব, প্রতিদিন শিখব’। এই শিশুদের <img alt="জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে বেড়ান মাধুরী" height="56" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/07.July/06-07-2024/90900.jpg" style="float:left" width="243" />মধ্যমণি তাদের নানি-দাদির বয়সী এক নারী। তিনিই মাধুরী বণিক। কাছে গেলে বোঝা গেল, চুলে তাঁর ভালোই পাক ধরেছে। অবয়বে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু কণ্ঠের জোর অটুট। তিনি শিশুদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো তো, সবার ওপরে কী?’ ‘মানুষ’—একযোগে উত্তর দিল শিশুরা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">“এবার সবাই আমার সঙ্গে বলো—‘মায়ের কথা শুনব। আমার মা শ্রেষ্ঠ মা। সবার মা শ্রেষ্ঠ মা।’” সমস্বরে কথাগুলো বলেই একসঙ্গে হাততালি দিল সবাই। </p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম। হাসিমুখে বসার অনুরোধ জানিয়ে মাধুরী বণিক বললেন, ‘এই শিশু এবং মায়েদের নিয়েই দিন কাটে আমার।’</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;"><b>বইয়ের মানুষ</b></p> <p style="text-align: justify;">মাধুরী বণিকের বয়স সত্তরের কোঠায়। এই বয়সেও সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সমাজের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বই পড়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ঢাকার নবাবগঞ্জের পানালিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া মাধুরী উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন। ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও নানা কারণে শেষ করতে পারেননি। বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়াই এখন তাঁর প্রধান কাজ। খুব ভোরে ঘুম ভাঙার পর প্রাত্যহিক দরকারি কাজ সেরে ঝোলায় বই নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। যান গ্রামের ঘরে ঘরে। বিশেষ করে মায়েদের কাছে। যার যে বই পছন্দ হয় পড়তে দিয়ে আসেন। আবার আগের দেওয়া বই ফেরত নিয়ে আসেন। এর মধ্যে কোনো আয়-রোজগারের বিষয় নেই, কাজটা করেন একেবারেই বিনা পয়সায়। মাধুরী বই বিলি করেন মানুষকে জ্ঞানের আনন্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। পাশাপাশি সপ্তাহে পাঁচ দিন শিশুদের পড়ান। এটিও বিনা পয়সায়। শুরু করেছিলেন নিজের গ্রাম পানালিয়া থেকে। এখন আশপাশের সামসাবাদ, কাসেমপুর, নবাবগঞ্জ ও সুরগঞ্জ এলাকার লোকদেরও বই পড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। এসব গ্রামের মানুষ বলছে, মাধুরী জ্ঞানের আলো বিলিয়ে সমাজ থেকে অশিক্ষা ও কুসংস্কার দূর করতে ভূমিকা রাখছেন।</p> <figure> <figure class="image"><img alt="জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে বেড়ান মাধুরী" height="483" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/print/Magazine%202023/01-07-2024/WhatsApp%20Image%202024-07-05%20at%207.40.27%20PM.jpeg" width="800" /> <figcaption>মানুষকে বই পড়ার আনন্দের সঙ্গে পরিচিত করাতে চান মাধুরী বণিক। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ</figcaption> </figure> <figcaption> <p style="text-align: justify;"> </p> </figcaption> </figure> <p style="text-align: justify;"><b>যাত্রা শুরু ২২ বছর আগে</b></p> <p style="text-align: justify;">২০০২ সালে মাত্র পাঁচটি বই দিয়ে পাঠাগার শুরু করেছিলেন মাধুরী বণিক। তখনো তিনি বিশেষ করে নারীদের বই পাঠে উৎসাহিত করতেন। তাঁর স্লোগানও ‘মায়েদের জন্য বই’। এখন তাঁর পাঠাগারের বইয়ের সংখ্যা ছয় শর বেশি। এসবের মধ্যে আছে গল্প, কবিতা, উপন্যাস ছাড়াও মনীষীদের জীবনী ও গবেষণাধর্মী বই। বইগুলোর বেশির ভাগই অন্যদের কাছ থেকে সহায়তা হিসেবে পাওয়া। মাধুরী বণিক বলেন, ‘সমাজে এখন নীতি-নৈতিকতার অভাব। দিন দিন অবক্ষয় বাড়ছে। এসব রোধে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাই মায়েদের বই পড়ানোর মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করার চেষ্টা করছি। কারণ মায়েরা বই পড়লে তাদের সন্তানরাও সুশিক্ষিত হবে।’</p> <p style="text-align: justify;"><b>পাঠাগারটির সংস্কার দরকার</b></p> <p style="text-align: justify;">মুক্তিযুদ্ধের সময় নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন মাধুরী। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা বার্তাসংবলিত চিরকুট জায়গামতো পৌঁছে দিতেন। তাঁদের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন মুক্তিযোদ্ধারা। মাধুরীর মা তাঁদের রান্না করে খাওয়াতেন।</p> <p style="text-align: justify;">দেশ স্বাধীন করা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মাধুরী তাঁর পাঠাগারের নাম রেখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’।</p> <p style="text-align: justify;">সামসাবাদের বাসিন্দা মো. মাসুদ কালের কণ্ঠের এ প্রতিবেদককে বললেন, ‘বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া সহজ কথা নয়। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাধুরী সেই কঠিন কাজটিই করে যাচ্ছেন।’</p> <p style="text-align: justify;">মাধুরীর অন্যতম নিয়মিত পাঠক পানালিয়ার সাহেরা আক্তার। তিনি বলেন, ‘মাধুরী খালার সবচেয়ে বড় গুণ তিনি সমাজের অবহেলিত নারীদের পাশে দাঁড়ান। নারীদের উন্নয়নে নানা ধরনের কাজ করেন। আমি মাধুরী খালার নিয়মিত পাঠক।’</p> <p style="text-align: justify;">গত বছর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সংবর্ধনা দিয়েছে মাধুরীকে। তাদের সহযোগিতায় পাঠাগারটি নতুনভাবে সাজিয়েছিলেন তিনি। পাঠাগারে বসেই বই পড়া যেত। জাতীয় দিবসগুলোতে সেখানে শিশুদের চিত্রাঙ্কন ও কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করা হতো। কিন্তু গত ১৬ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ে পাঠাগারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভেঙে পড়ে এর বারান্দার ছাউনি। বৃষ্টিতে ভিজে কিছু বইও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাকি বইগুলো তাই এখন ঘরে নিয়ে রেখেছেন। মাধুরী বললেন, ‘অর্থাভাবে পাঠাগারটি মেরামত করতে পারছি না।’</p> <figure> <figure class="image"><img alt="জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে বেড়ান মাধুরী" height="483" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/print/Magazine%202023/01-07-2024/WhatsApp%20Image%202024-07-05%20at%207.40.26%20PM.jpeg" width="800" /> <figcaption>এভাবেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই বিলান মাধুরী বণিক। ছবি : সংগৃহীত</figcaption> </figure> <figcaption> <p style="text-align: justify;"> </p> </figcaption> </figure> <p style="text-align: justify;"><b>সমাজের ভাবনা ছোটবেলা থেকেই</b></p> <p style="text-align: justify;">স্কুলে পড়ার বয়স থেকেই অল্প অল্প অর্থ জমিয়ে অবহেলিত মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন মাধুরী। নবাবগঞ্জে নারীদের প্রথম সংগঠন ‘নবাবগঞ্জ মহিলা সংঘ’ প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল মাধুরীর।</p> <p style="text-align: justify;">১৯৬৮ সালে তৎকালীন নবাবগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন মাধুরী। গ্রামে লেখাপড়া জানা লোক ছিল হাতে গোনা। একদিন মাধুরী তাঁর মা মিলন দাসী বণিককে বললেন, তিনি স্কুলে না যাওয়া আশপাশের কিছু শিশুকে পড়াতে চান। শুনে খুশি হয়েছিলেন মা। উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, খুব ভালো কথা। তখন বাড়ির উঠানে মাদুর বিছিয়ে শিশুদের বর্ণমালা শেখাতে শুরু করেন মাধুরী। কিশোরী মাধুরীর সেই পাঠশালা এখন হয়েছে ‘মা ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্র’। সেখানে শিশুদের পাশাপাশি নিরক্ষর মায়েদের অক্ষরজ্ঞান দেওয়া হয়। এখনো চট কিংবা মাদুর বিছিয়ে গাছতলা কিংবা বাড়ির উঠানে শিশুদের পাঠদানের কাজ করছেন মাধুরী। পাঠশালায় আসতে আগ্রহী করতে ছুটির সময় শিশুদের হাতে চকোলেট, বিস্কুটসহ বিভিন্ন কিছু উপহার দেন। ভবিষ্যতে তাদের স্কুল ব্যাগ, টিফিন বক্স, ছাতা ও বইখাতা দেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।</p> <p style="text-align: justify;">নবাবগঞ্জ বাজারে একটা জুতার দোকান চালান মাধুরী। সেখান থেকে আয়ের একটা অংশ ব্যয় করেন শিক্ষার্থীদের পেছনে।</p> <p style="text-align: justify;"><b>সব দান করে যাবেন</b></p> <p style="text-align: justify;">ব্যক্তিগত জীবনে মাধুরী অবিবাহিত। সমাজের জন্য কাজ করতে গিয়ে তাঁর আর ঘর-সংসার করা হয়নি। এখন শরীর ততটা সায় দেয় না। তবু মনের জোরে বই হাতে চলেন এপাড়া-ওপাড়া। বড় দুই ভাই ও এক বোন মারা গেছেন। পানালিয়ার পৈতৃক ভিটায় তিনি একাই থাকেন। মাধুরী স্বপ্ন দেখেন, তাঁর পাঠাগারটি একদিন অনেক বড় হবে, সেখান থেকে এলাকার মানুষ বই নিয়ে পড়ে আনন্দ পাবে, বাড়বে জ্ঞানের পরিধিও। পৈতৃকসূত্রে ২৫ শতাংশের মতো জমি পাওয়ার কথা মাধুরীর। সেই জমিসহ নিজের যা আছে তা পাঠাগারের নামে দান করে যেতে চান। তাঁর মৃত্যুর পরও যেন জ্ঞানের আলো ছড়ানোর কাজটা অব্যাহত থাকে, সেটাই প্রত্যাশা মাধুরীর।</p> </article>
