<p>বিকেলের শেষ দিক। কিছু যাত্রীর দেখা মিলছে রাজধানীর সদরঘাট এলাকায় অবস্থিত ঢাকা নদীবন্দরে। সারি সারি থেমে থাকা লঞ্চগুলোর কর্মীরা নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেন। কারো হাতে-কাঁধে ব্যাগ-বোঝা দেখলেই নিজ লঞ্চে তোলার উদ্দেশ্যে ডেকে গন্তব্য জিজ্ঞাসা করছেন।</p> <p>গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ঠিক ৫টা ১০ মিনিটে সদরঘাটে ঠিক এই চিত্রই দেখা গেল। রাজধানী তথা দেশবাসী ঢাকা সদরঘাটের বিকেলের যে ছবিটা দেখে অভ্যস্ত, বিশেষ করে ঈদের প্রাক্কালে, তার সঙ্গে এই দৃশ্য মোটেই মেলে না। সদরঘাট মানেই তো ছিল অসংখ্য যাত্রীর ব্যস্ত পদচারণ, কর্মীদের হাঁকডাক, লঞ্চের ভেঁপুর আওয়াজ আর কুলিদের দৌড়াদৌড়ি।</p> <p>ঢাকা থেকে বরিশাল-ঝালকাঠি যাওয়ার পথে রওনা দেওয়ার অপেক্ষায় ঘাটে ভিড়ে ছিল ফরহাদ-৭ লঞ্চ। এই লঞ্চের কর্মী মো. ইব্রাহিম চেঁচিয়ে যাত্রী ডাকছিলেন। কথা হলে মো. ইব্রাহিম কালের কণ্ঠকে জানান, লঞ্চ ছাড়বে রাত ৮টায়। যাত্রীরা আসা শুরু করেছেন। ভিড় তেমন নেই। কিন্তু ৮টা পর্যন্ত যে কজন যাত্রী হবে তা নিয়েই লঞ্চ ছাড়তে হবে। তাই দু-চারজন যাত্রী যা দেখা যাচ্ছে তাদেরকেই লঞ্চে তোলার চেষ্টা করছেন।</p> <p>বরিশাল যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল মানামী নামের আরেকটি লঞ্চ। তখনো লঞ্চটিতে তেমন কোনো যাত্রী দেখা গেল না। রাত ৯টায় এর ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা। সন্ধ্যায় পুরো লঞ্চ ঘুরে ৫০ জন যাত্রীরও দেখা পাওয়া যায়নি। তখনো কোনো কেবিন বুক হয়নি। নিচতলায় টিকিট কাউন্টারে কয়েকজন কর্মী বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন।</p> <p>মানামী লঞ্চের সুপারভাইজার ইমরান হোসেন কালের কণ্ঠকে বললেন, ‘যাত্রী খুবই কম। আগের তুলনায় ২০ শতাংশ হতে পারে। আরো সপ্তাহখানেক পর ঈদের পরিস্থিতি বোঝা যাবে।’</p> <p>ঢাকা থেকে একসময় প্রতিদিন আট থেকে ৯টি লঞ্চ বরিশাল যেত। পদ্মা সেতু চালুর পর কমতে কমতে এখন তা দুটিতে নেমে এসেছে। সপ্তাহে এক দিন যায় সর্বোচ্চ তিনটি। সারা বছর ধরে মোটামুটি এই চিত্রই চলে। ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যবসা খুব বেশি বাড়বে এমনটা মনে করছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে যাত্রীর সংখ্যা কিছুটা বেশি হবে এ আশা নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন লঞ্চ মালিকরা।</p> <p>লঞ্চের যাত্রী কমে যাওয়ায় অগ্রিম টিকিটেরও চাহিদা নেই। অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হলেও শুধু ঈদের একেবারে আগের ৮ ও ৯ এপ্রিলের কিছু কেবিন বুক হচ্ছে। অন্যদিনের টিকিট এখনো তেমন বিক্রি হচ্ছে না।</p> <p><strong>নিয়মিত লঞ্চের সংখ্যা ৯০ থেকে ৪০</strong></p> <p>বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) ঢাকা নদীবন্দর সূত্র বলছে, ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে ২২০টির মতো লঞ্চ তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে আগে নিয়মিত ৯০টি লঞ্চ চলত। এখন সংখ্যাটি ৪০-এ নেমে এসেছে। যাত্রীর অভাবে ১০টির মতো নৌপথ পুরোপুরি এবং অনেকগুলো আংশিক বন্ধ হয়েছে।</p> <p><strong>বন্দর কর্তৃপক্ষ সেবা দিতে প্রস্তুত</strong></p> <p>এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক (বন্দর ও ট্রাফিক) মোহাম্মদ আলমগীর কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা মাঠে কাজ করতে যাচ্ছি। আগের মতো যাত্রীর সেই ভিড় হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবু আমাদের কার্যক্রমের কোনো কমতি নেই।’</p> <p><strong>মালিকরা রোজার শেষ সপ্তাহের অপেক্ষায়</strong></p> <p>জানতে চাইলে বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাত্রী একেবারেই নেই। ঈদের পরিস্থিতি কেমন হবে তা ২৫ রমজানের পরে বোঝা যাবে। তবে আমরা আমাদের সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। যেসব লঞ্চ সারা বছর পড়ে ছিল সেগুলো চলাচলের উপযোগী করে তোলা হয়েছে।’</p> <p><strong>‘বিচ্ছিন্ন সদরঘাটকে যুক্ত করতে হবে’</strong></p> <p>পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বেড়েছে বাসের যাত্রী তথা ব্যবসা। উল্টোদিকে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য নদীপথে যাত্রায় ভাটা নেমেছে। লঞ্চ মালিকরা তাঁদের ব্যবসা কমে যাওয়ার পেছনে সাদা চোখে পদ্মা সেতুতে বাস চালু হওয়াকে দায়ী করলেও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে একটু বৃহত্তর  দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। তাঁদের মতে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকা সদরঘাটের আধুনিকায়ন হয়নি। তা ছাড়া বিলাসবহুল অনেক লঞ্চ চালু হলেও সদরঘাটে এসে পৌঁছানোই এক বিড়ম্বনা। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে বিপজ্জনক যাত্রাও আরেকটি শঙ্কার বিষয়। তাই দূরের যাত্রীরা আগ্রহ থাকলেও লঞ্চে ভ্রমণ এড়িয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছেন।</p> <p>পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকায় সাম্প্রতিককালে যেসব বড় যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে সদরঘাটের সংযোগ নেই। দ্রুতগতির পরিবহন ব্যবস্থার সুফল সদরঘাট অঞ্চল পায়নি। তাই মিরপুরের যাত্রী ভোগান্তি সয়ে সদরঘাটে এসে লঞ্চে উঠতে রাজি হচ্ছেন না। ঢাকা নদীবন্দরকে টিকিয়ে রাখতে হলে মেট্রো, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদির সঙ্গে এই অঞ্চলের যোগসূত্র তৈরি করতে হবে।</p> <p><strong>দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পথে ১৫ ফেরি</strong></p> <p>ঈদে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ১৫টি ফেরি ও ২০টি লঞ্চ চলবে। ঈদের আগের তিন দিন ও ঈদের পরে তিন দিনসহ মোট সাত দিন বন্ধ থাকবে পণ্যবাহী যান চলাচল। গতকাল রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আসন্ন ঈদ উপলক্ষে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পথে ফেরি ও লঞ্চ চলাচলসহ ঘাটের সার্বিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আয়োজিত সভায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।</p> <p>সভায় বলা হয়, ঈদের ছুটির দ্বিমুখী যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ঈদের আগে পাঁচ দিন ও পরে পাঁচ দিন দুর্ঘটনা এড়াতে নৌপথে সব ধরনের মালবাহী নৌযান ও সড়ক পথে পণ্যবাহী যান বন্ধ থাকবে। দুটি ফেরি বাড়িয়ে ১৫টি ফেরি এবং তিনটি লঞ্চ বাড়িয়ে ২০টি লঞ্চ চলাচল করবে। যার প্রায় সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছে। দৌলতদিয়া প্রান্তে ঘাট সচল থাকবে তিনটি।</p> <p><strong>যাত্রীবাহী নৌযানে পণ্য নয়</strong></p> <p>নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ঈদের আগে পাঁচ দিন ও পরের পাঁচ দিন রাজধানীর সদরঘাট থেকে যাত্রীবাহী নৌযানে সব ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকবে। দেশের অন্যান্য প্রান্ত থেকে ঢাকা সদরঘাটে আসা যাত্রীবাহী নৌযানে পণ্য পরিবহন করা যাবে না। ঈদের আগে ও পরে নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে লঞ্চের মাধ্যমে মোটরসাইকেল পরিবহন করা যাবে। নৌপথে রাতের বেলায় স্পিডবোট চলাচল বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া ৪ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত দিন-রাত সব ধরনের বালুবাহী বাল্কহেড  চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে।</p> <p>এ ছাড়া ঈদের আগে ও পরে তিন দিন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও দ্রুত পচনশীল পণ্যবাহী ট্রাক ছাড়া সাধারণ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ফেরিতে পারাপার বন্ধ থাকবে। এবারের ঈদ কালবৈশাখী মৌসুমে হওয়ায় বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে নৌযান চালানো নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।</p> <p><em>[সংবাদে রাজবাড়ী প্রতিনিধি তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন]</em></p> <p> </p>