<p>মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েক দিন ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত এখন বাংলাদেশ সীমান্তে এসে পৌঁছেছে। বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে দেশটির সীমান্তরক্ষী পুলিশ (বিজিপি) সদস্যদের অনেকেই পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। </p> <p>সীমান্তচৌকিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি। গতকাল রবিবার মিয়ানমার থেকে আসা গোলার আঘাতে অন্তত তিন বাংলাদেশি আহত হয়েছে।</p> <p>ঝুঁকি এড়াতে সীমান্তবর্তী অন্তত সাতটি স্কুল এবং কিছু সড়কে যান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আতঙ্কে সীমান্ত এলাকার অনেকে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা।</p> <p>গতকাল রবিবার রাত ১১টা পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের অন্তত ৬৮ জন সশস্ত্র বিজিপি সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।</p> <p>তাঁদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছেন। আরো অনেকেই বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। আশ্রয় নেওয়া বিজিপি সদস্যদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা চলছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন।</p> <p>ঢাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ আত্মরক্ষার্থে বাংলাদেশে ঢুকেছে।</p> <p>তারা অস্ত্র হাতে ঢুকেছে, কিন্তু যুদ্ধ করতে আসেনি। তারা যুদ্ধপরিস্থিতিতে এসেছে। তাদের ফেরত পাঠানো হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা নেই জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এর মানে এই নয় যে গায়ের ওপর পড়লে ছেড়ে দেওয়া হবে।</p> <p>এমন প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে মিয়ানমার ও সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে চীনের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।</p> <p>বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অংশে গত শনিবার রাত ৯টা থেকে আবারও গোলাগুলি শুরু হয়। গতকাল দিনভর এই অবস্থার মধ্যে বেশ কয়েক দফায় সামরিক হেলিকপ্টার ব্যবহার করে গোলাবর্ষণ করতে দেখা গেছে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে।</p> <p>নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট ক্যাম্প এবং ঢেকুবুনিয়া সীমান্তচৌকির দখল নিয়েছে বিদ্রোহী গেরিলা গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। মিয়ানমারের জান্তা অনুগত বাহিনী মরিয়া হয়ে সীমান্ত এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আরাকান আর্মিকে লক্ষ্য করে তারা হেলিকপ্টার থেকে হামলা করছে। আরাকান আর্মির সদস্যরা গুলি ছুড়ে তাদের জবাব দিচ্ছেন।</p> <p>আরাকান আর্মির উপর্যুপরি হামলার মুখে টিকতে না পেরে বিজিপির ১৪ জন জওয়ান গতকাল সকালে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাঁরা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির বিভিন্ন চৌকিতে আশ্রয় নেন। এরপর কয়েক দফায় অর্ধশতাধিক বিজিপি সদস্য এ দেশে আশ্রয় নেন।</p> <p>বিজিবি সদর দপ্তরের কর্মকর্তা সাইফুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৬৮ জন সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের অস্ত্র ও গুলি বিজিবির কাছে জমা রাখা আছে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তে গোলাগুলির পরিমাণ কিছুটা কমেছে বলে নিশ্চিত করেছে বিজিবি।</p> <p>ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আব্দুল্লাহ আল আশরোকি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যারা আসছে, তারা মূলত মিয়ানমারের সিকিউরিটি ফোর্সের (নিরাপত্তা বাহিনীর) সদস্য। তাদের আমরা কর্ডন করেছি। তাদের ‘ডিস-আর্ম’ (অস্ত্র জমা নেওয়া) করেছি। অস্ত্র আলাদা করেছি এবং তাদের আমরা নিরাপদ স্থানে রেখেছি।” আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রচলিত বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।</p> <p>সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সীমান্ত পরিস্থিতির কথা বিজিবি স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।</p> <p>কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দূতাবাসের মাধ্যমে মিয়ানমারের জান্তা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ আছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মিয়ানমারে বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা জান্তা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ আলাপ-আলোচনা করে আসছে। সীমান্ত ইস্যুতে বাংলাদেশের আলোচনা হয় মিয়ানমারের বিজিপির সঙ্গে। এখন সীমান্তে বিজিপির বদলে সরকারের বাইরের কোনো গোষ্ঠী দায়িত্বে থাকলে বাংলাদেশকে জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে।</p> <p>কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরো জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কয়েক শ সেনা ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের পর্যায়ক্রমে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশও পরিস্থিতি অনুযায়ী সব দিক বিবেচনায় নিয়ে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যদের বিষয়ে করণীয় ঠিক করবে।</p> <p>এদিকে মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে গতকাল অন্তত তিনজন পথচারী আহত হয়েছে। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নুরুল আলম জানান, আহতদের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।</p> <p>ঘুমধুম-তুমব্রু, কোনারপাড়া, ভাজাবুনিয়াসহ সীমান্তসংলগ্ন গ্রামগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের কয়েক শ মানুষ শনিবার রাতেই গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।</p> <p>বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেছেন, সীমান্ত পরিস্থিতির দিকে সরকার কড়া নজর রেখেছে। তিনি বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কয়েকটি স্কুল সাময়িক ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে কয়েকটি সড়কে যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।</p> <p>গতকাল সকালে সরেজমিনে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে গিয়ে দেখা যায়, তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি ঘাঁটি দখল করে মিয়ানমারের পতাকা নামিয়ে ফেলে আরাকান আর্মি। এ সময় মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে। ঘাঁটি হাতছাড়া হয়ে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপির) বেশ কিছু সদস্য বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। তাঁরা তুমব্রুর বিজিবির বিওপিতে আত্মসমর্পণ করেছেন।</p> <p>দুপুরের পর থেকে মিয়ানমারের তিনটি হেলিকপ্টার থেকে ওপারের তুমব্রু ঘাঁটি এবং এর আশপাশে আরাকান আর্মির সম্ভাব্য অবস্থানে গোলাবর্ষণ করা হয়। আরাকান আর্মিও তখন হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে মর্টার ও গুলি ছোড়ে। এ সময় উভয় পক্ষের ছোড়া অসংখ্য গুলি বাংলাদেশের তুমব্রু পশ্চিমকুলে পড়েছে।</p> <p>গতকাল সকাল ১১টার দিকে মিয়ানমার থেকে ছুটে আসা গুলি বিদ্ধ হয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা পবীন্দ্র ধর অনবোর (৬৫) শরীরে। বিকেল ৫টার দিকে বাংলাদেশের এপারে তুমব্রু পশ্চিমকুল এলাকায় অসংখ্য গুলি পড়েছে। এ সময় স্থানীয়রা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। সে সময় শামসু নামের এক অটোরিকশাচালক গুলিবিদ্ধ হন। তিনি ঘুমধুম ঘোনারপাড়ার বাসিন্দা। পরে স্থানীয়রা তাঁকে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।</p> <p>তুমব্রু বাজার শ্রীশ্রী দুর্গামন্দির কমিটির সভাপতি ও স্কুল শিক্ষক রূপলা ধর বলেন, ‘মিয়ানমারের ওপারে আরাকান আর্মি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। সকালে আমার প্রতিবেশী ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির শরীরে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি লেগেছে। তুমব্রু এলাকায় শনিবার রাত থেকে মর্টার শেল ও ভারী অস্ত্রের শব্দে স্থানীয় বাসিন্দারা রাতভর ঘুমাতে পারেনি। ভোর হতেই অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য চলে গেছে।’</p> <p>মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এর আগে এপারে ষোলোটি মর্টার শেল পড়েছে। এতে তেমন কেউ হতাহত হয়নি। তবে গতকাল ভোররাতে ঘুমধুম জলপাইতলী এলাকার শফিকুল ইসলামের বসতবাড়িতে একটি মর্টার শেল পড়লে অল্পের জন্য দুই সন্তানসহ ওই দম্পতি বেঁচে যান। এ ছাড়া গতকাল সারা দিনে এপারে কত গুলি পড়েছে, তার হিসাব নেই।</p> <p><strong>স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন</strong></p> <p>স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘মিয়ানমার সংকট লেগেই আছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার আর্মির যুদ্ধ চলছে। আমরা কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাই না, যুদ্ধ চাইও না। এটা প্রধানমন্ত্রী সব সময় আমাদের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তার মানে এই নয় যে আমাদের গায়ে এসে পড়বে আর আমরা ছেড়ে দেব। সেটার জন্য আমরা সব সময় তৈরি আছি।’</p> <p>স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সেখানে (সীমান্ত) বিজিবির শক্তি বৃদ্ধি করেছি। আমাদের পুলিশ ও কোস্ট গার্ডকেও নির্দেশনা দিয়েছি, যাতে কোনোভাবেই আমাদের সীমানায় কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে। সে ব্যাপারে আমরা খুব সতর্ক আছি। মিয়ানমারে যে যুদ্ধ চলছে, সেই যুদ্ধ কত দিন চলবে আমরা জানি না। আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করে কাউকে আমরা আসতে দেব না। বিজিবিকে আমরা সেই নির্দেশনা দিয়েছি।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘তারা (বিজিপি) আত্মরক্ষার্থে এখানে ঢুকেছে। এটা হতেই পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যখন ভারতে ঢুকে পড়েছিলাম, মনে আছে না? আমরা তো একজন নয়, কোটি মানুষ গিয়েছিলাম। আত্মরক্ষার্থে ঢুকেছে, তারা যুদ্ধের জন্য ঢোকেনি।’</p> <p>রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত একটিই, সীমান্তে এখন যুদ্ধ চলছে, এখানে এখন কারো আসা উচিত হবে না। এই মুহূর্তে আর কাউকে আমরা ঢুকতে দেব না।’</p> <p><img alt="আর্মি" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/Harun/January-2024/February-2024/05-02-2024/Arakan Army_kalerkantho_pic.jpg" width="1000" /></p> <p>বিদ্রোহী আরাকান আর্মি সঙ্গে লড়াইয়ে ঠিকতে না পেরে পালিয়ে আশ্রয় নিতে বাংলাদেশে এসেছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের অনেকেই। গতকাল তোলা।  ছবি : সংগৃহীত</p>