<p style="text-align: justify;">কয়েক মাস আগের ঘটনা। অনলাইনে উদ্যোক্তা হিসেবে সুপরিচিত বাংলাদেশি এক তরুণীর একটি অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। যে ভিডিওটি মূলত সেই তরুণীর নয়। কোনো পর্ন সাইট থেকে নেওয়া ভিডিও ক্লিপে ডিপ ফেক টুলের মাধ্যমে তরুণীর মুখাবয়ব ব্যবহার করে তৈরি করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">এমন ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। পরে তিনি পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের সহায়তায় মূল ভিডিও শনাক্ত করতে সক্ষম হন। অপরাধীকে শনাক্ত করার বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন।</p> <p style="text-align: justify;">শুধু ওই তরুণী নন, ডিপ ফেক ছবি বা ভিডিওর কারণে অনেকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে।</p> <p style="text-align: justify;">চলতি মাসের প্রথম দিকে ভারতীয় এক অভিনেত্রী এআইয়ের কারসাজিতে তৈরি ভিডিওর মাধ্যমে হেনস্তার শিকার হন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ভিডিও বা ছবি দেখে হৈচৈ বাধানোর আগে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;">আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইডের ‘বাংলাদেশে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। অনলাইনে হেনস্তার শিকার সবচেয়ে বেশি ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েশিশুরা।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশী উদ্যোক্তা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ছড়িয়ে পড়া সে ভিডিওটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলেও ওই তরুণীর জীবনে এ ঘটনা বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এ বিষয়ে তরুণী বলেন, ‘এখনো অনেকে ভাবেন, ভিডিওটি আমারই। সমবয়সীরা হয়তো বুঝতে পারে যে এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে করা হয়েছে। কিন্তু মুরব্বি শ্রেণির লোকজন বোঝেন না। এতে শুধু আমি নই, আমার পরিবারও বিব্রত।’</p> <p style="text-align: justify;">তরুণী বলেন, ‘একজন ভুক্তভোগী হিসেবে সবাইকে জানাতে চাই, এআইয়ের মাধ্যমে এখন এমন অনেক কিছু করা সম্ভব, যাতে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র বুঝতে পারে, কোনো মেয়ের এমন কোনো ভিডিও বা ছবি প্রকাশ পেলে ঘটনা যাচাই করে সত্যটাকে সামনে আনতে হবে।’</p> <p style="text-align: justify;">এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, ‘নারী বা মেয়েশিশুরা হেনস্তার শিকার আগেও হয়েছে, এ যুগেও হচ্ছে। যেহেতু আমরা ডিজিটাইজেশনের যুগে প্রবেশ করেছি, তাই হেনস্তার বিষয়টি এখন বাস্তব জগতের পাশাপাশি ভার্চুয়াল জগতেও চলে এসেছে। অনলাইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক বা শিশু-কিশোররাই বেশি হেনস্তার শিকার।</p> <p style="text-align: justify;">মইনুল হোসেন বলেন, এর কারণ হচ্ছে বোঝার মতো বয়স হওয়ার আগেই মোবাইল ফোনসেট, ল্যাপটপ ইত্যাদি শিশুদের হাতে যাওয়া। তারা তো জানে না যে এগুলো কী ভয়ংকর ফাঁদ! তারা নিজেদের ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে না বুঝেই শেয়ার করছে, কখনো-বা এসব মাধ্যমে পাতানো বন্ধুদের ব্যক্তিগত ইনবক্সে পাঠাচ্ছে। পরে নিজেদের বোকামির মাসুল গুনতে হচ্ছে। ভিডিও বা ছবিটি যে পাঠাচ্ছে, সে হয়তো সচেতন ছিল। কিন্তু যাকে পাঠাচ্ছে, সে হয়তো তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে ততটা সচেষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে আমরা প্রথমেই ভুক্তভোগীর দিকে আঙুল তুলি। অথচ আঙুল তোলা উচিত তার দিকে, যে ফাঁস করেছে বা যে এমন আপত্তিকর কিছু তৈরি করেছে।’</p> <p style="text-align: justify;">তথ্য গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে বি এম মইনুল হোসেন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তৈরিই হয়েছে বন্ধু, পরিবার-পরিজন নিয়ে একটি গণ্ডি তৈরির জন্য। যেখানে ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ছবি ভাগাভাগি করে সংযোগে থাকা যাবে। এখানে ছবি বা ভিডিও যদি শেয়ার না করেন, তাহলে এটি ব্যবহারের উদ্দেশ্যই তো অসফল। তাই ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নিজেদের ছবি-ভিডিও শেয়ার করা বন্ধ করে নয়, বরং এসব নিয়ে যারা অশ্লীল, অনৈতিক কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।’</p> <p style="text-align: justify;">উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ইউনিসেফ এক সতর্কতা জারি করে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, অনলাইনে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার মতো বিপদের মুখে রয়েছে। চার বছর পরে এই হার আরও বেড়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।</p> <p style="text-align: justify;">ভিডিওনির্ভর অনলাইনভিত্তিক সাইবার বুলিংয়ের মাত্রা বাড়ছে। এমন বুলিংয়ের শিকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এক শিশুশিল্পী বলেছে, ‘আমার ভিডিও-ছবি কেটে কেটে অনলাইনে মানুষ ট্রল করে। এটা আমার জন্য খুবই বাজে অভিজ্ঞতা। জানি না মানুষ কেন এত বাজেভাবে অনলাইনে আচরণ করে? আমার মতো শিশুর প্রতি এত সহিংসতা কেন?’ </p> <p style="text-align: justify;">শিশুটির মা বলেন, ‘এখন অনলাইননির্ভর বুলিং বা ভার্বাল হ্যারাসমেন্টের মাত্রা খুব বেড়েছে। নারীরা তো আছেনই, শিশুদেরও মুক্তি নেই। এভাবে শিশুদের নিরাপদ অনলাইনের অধিকার হরণ করা হচ্ছে।’</p> <p style="text-align: justify;">থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নাদিম রেজা বলেন, ‘অনলাইনে নানা ধরনের নির্যাতন বাড়ছে। আমাদের শিক্ষা কাঠামোতে এমন কোনো বিষয় নেই, যার মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মকে শেখাতে পারি কিভাবে অনলাইনে বুলিং প্রতিরোধ করা যায়।’ তিনি বলেন, ‘জার্মানি বা অন্যান্য পশ্চিমা দেশে অনলাইন যেন শিশুদের জন্য নিরাপদ থাকে, তা নিয়ে অনেক কর্মসূচি চালু আছে। আমাদের মোবাইল অপারেটর থেকে শুরু করে যারা ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে, তাদের এ ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ভিডিও বা প্ল্যাটফরমগুলোতে নিয়ন্ত্রণ আনা প্রয়োজন।’</p> <p style="text-align: justify;">সাইবার ক্রাইম বা ইন্টারনেটে নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘অন্তর্জাল’-এর চিত্রনাট্যকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আশা জাহিদ বলেন, এখন অনলাইনের নানা সফটওয়্যার ও প্ল্যাটফরম থেকে সহজেই ডিপ ফেক ভিডিও বানানো যায়। এ জন্য বিশেষ কোনো কোডিং শেখার প্রয়োজন হচ্ছে না। অনেক মোবাইল অ্যাপও আছে, যার মাধ্যমে ছবি থেকে ভিডিও তৈরি করা যাচ্ছে। বিভিন্ন সিনেমার ক্লিপকে বিশেষভাবে সম্পাদনা করে ভিডিও বানানো যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, স্পাইডারম্যান বা আয়রনম্যান সিনেমায় নায়কের বদলে অন্য কারো চেহারা বসিয়ে ভিডিও তৈরি করা যাচ্ছে। প্রথম দিকে বিষয়টি আনন্দের মনে হলেও ধীরে ধীরে এসব ভিডিও বানানোর কৌশল বুলিংয়ে ব্যবহূত হচ্ছে। এসব ভিডিও সহজে শনাক্ত করার প্রযুক্তি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।</p> <p style="text-align: justify;">আজ ২৫ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে এগিয়ে আসুন, সহিংসতা প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন’। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিনটি পালন করছে বিভিন্ন সংগঠন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারী নির্যাতনের ধরন বদলাচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নারী ও কন্যাশিশুর হয়রানি, নির্যাতনের ঘটনাও বাড়ছে।  </p>