<article> <p>বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই চ্যালেঞ্জগুলো কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ছিল। দিনে দিনে সেগুলো প্রকট হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো এখন আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।</p> </article> <article>বাজেট খুব বেশি দূরে নয়। নতুন বাজেট ঘোষণার আগেই কতগুলো বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। বাজেট যখন পেশ করা হবে, তখন এসব সমস্যার আলোকে বাজেট পর্যালোচনা করা যাবে। <p>প্রথমত, আমাদের যেটা সমস্যা, সেটা হলো মূল্যস্ফীতির অপ্রতিরোধ্য ঊর্ধ্বগতি।</p> </article> <article> <p>মূল্যস্ফীতি কোনোক্রমেই বাগে আসছে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। রোজা শেষ হয়ে যাচ্ছে।</p> </article> <article>ঈদ সমাগত। এখন লোকজনের উৎসবের আমেজে, উৎসবের নানা রকম উপকরণ বা পোশাক-আশাক কিংবা অন্য কিছু কিনবে—সেটা এখন তাদের কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের জীবনধারণের যে অতি আবশ্যকীয় সামগ্রী—সেগুলোর দাম কোনোক্রমেই কমছে না। <p>আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার নানা রকম চেষ্টা করছে। বাজারে নির্দিষ্ট পণ্যের দাম বেঁধে দিচ্ছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।</p> </article> <article>এভাবে কোনো কোনো দেশে সম্ভব হলেও এখানে তা সম্ভব হবে না। এখানে যেটা বেশি দরকার, সেটা হচ্ছে সরবরাহ বাড়ানো এবং সরবরাহ যেটাই আসে, সেটা ঠিকভাবে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো। অতএব পণ্যের সরবরাহ এবং সেই সঙ্গে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো রকম বাধাবিপত্তি, কোনো রকম চাঁদাবাজি বরদাশত করা যাবে না। পাইকারি হোক বা খুচরা বিক্রেতা হোক, ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করতে দেওয়া যাবে না। কোনো সমস্যা হলে সেটার ব্যবস্থা নিতেই হবে। আমরা দেখছি, সেটা হয়ে উঠছে না। <p><img alt="আর্থিক খাতে অনেক চ্যালেঞ্জ" height="434" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/06-04-2024/Untitled-1.jpg" width="500" />দ্বিতীয়ত, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিন্তু বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বহু চেষ্টা করছে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য। টাকা-বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ কিছুটা বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আবার ক্রলিং পেগ চালু করবে বলে শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ টাকার অবমূল্যায়নটা অল্প অল্প করে করবে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও রিজার্ভ বাড়েনি, বরং রিজার্ভ কমছে। কারণ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। আমদানি অত্যাবশ্যকীয়। সেই সঙ্গে এখন দেখছি, রেমিট্যান্সের গতিও হঠাৎ করে কমে যাচ্ছে। ঈদের সময় হয়তো বা রেমিট্যান্স বাড়বে কিছুটা। এতে কিন্তু আমাদের ডলারের সরবরাহ খুব বাড়বে না।</p> <p>অন্যদিকে রপ্তানি যে খুব বাড়ছে, তা নয়। রিজার্ভের ধস ঠেকানো যাচ্ছে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আইএমএফের একটা টার্গেট ছিল, সে টার্গেটটা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। টার্গেট পূরণ না করলে আইএমএফ কিস্তি দেবে কি না সংশয় আছে। তবে আমার মনে হয় না, সে কিস্তি আটকে থাকবে। কারণ যেটা বাংলাদেশ চেষ্টা করছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলো মোটামুটি তারা দেখতে পাচ্ছে যে চেষ্টার ত্রুটি হচ্ছে না, কিন্তু সেগুলো খুব কার্যকরও হচ্ছে না।</p> <p>এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের যেটা করা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেটা হলো আমাদের যে মুদ্রানীতি বা মনিটারি পলিসি এবং রাজস্বনীতি বা ফিসক্যাল পলিসি—দুটির মধ্যে সমন্বয় এবং বাস্তবায়ন করা। আমরা দেখছি, বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছে, যাতে ইনফ্লেশনটা কমানো যায়। অর্থাৎ মুদ্রা সরবরাহ সীমিত করে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা সাধারণত মুদ্রানীতির একটা ধরন। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা যে খুব ফলপ্রসূ হবে, এমনটা মনে হচ্ছে না।</p> <p>এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখছি, বলা হচ্ছে সুদের হারটাও বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে, যদিও সম্পূর্ণভাবে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের যে গড়, সেটার ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করা হচ্ছে। এখন আমরা দেখি যে ১৩ শতাংশ, মানে এখন আমরা সুদের হার দেখতে পাচ্ছি তেরোর দিকে পৌঁছেছে। ৬ ও ৯-এর বৃত্ত থেকে আমরা বেরিয়ে এসে সুদের হার তোরোর দিকে হচ্ছে। সেটা হওয়া স্বাভাবিক। কারণ এমনিতেই ব্যাংকে তারল্য সংকট আছে। ব্যাংকে মানুষের টাকা দেওয়ার প্রবণতা কমে গেছে।</p> <p>এখন এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য হলো, সুদের হার বাড়ছে, এই বাড়তি সুদের হারটাকে যাঁরা বড় ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা বড় ঋণগ্রস্ত আছেন, তাঁদের কিন্তু বাড়তি সুদের হারটাকে গ্রহণ করতে হবে। কারণ টাকা সেই আগের মতো চিপ মানি আর নেই। সস্তা বা সুলভ টাকা, একেবারে কম হারে সুদের টাকা পৃথিবীর কোনো দেশে এখন নেই। অন্যান্য দেশেও সুদের হার বাড়ছে। আর সুদের হার বাড়া মানেই যে যাঁরা ব্যবসায়ী, তাঁরা একেবারে বসে পড়বেন, তা নয়। সুদ হলো তাঁর খরচের একটামাত্র অংশ। এর বাইরে মজুরির ব্যাপার আছে, তাঁর দক্ষতারও ব্যাপার আছে। তাঁর বিদ্যুৎ-জ্বালানি বিলের ব্যাপার আছে, কাঁচামালের খরচ আছে। এসব বিবেচনা করেই ব্যবসায়ীকে এগোতে হবে। এসব যদি সাশ্রয়ীভাবে করেন, বিশেষ করে তাঁর উৎপাদনক্ষমতা যদি বৃদ্ধি করেন, যাতে তিনি এই সুদের হার বহন করতে পারেন।</p> <p>অন্যদিকে সুদের হার বাড়ানোর একটা প্রয়োজন আছে। কারণ ওই দিকে যারা ডিপোজিটর, যারা টাকা রাখে, তাদের কিন্তু আগের মতো ৬-৭ শতাংশ হারে জমা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ মূল্যস্ফীতির হার ৯-এর বেশি। অতএব আমানতকারীদের সুবিধার জন্য এটা অতি প্রয়োজন। তবে আমি বলব, একেবারে ঢালাওভাবে ১৩ শতাংশ সুদের হার সবখানে প্রযোজ্য করা ঠিক হবে না, বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে। কৃষি উৎপাদন, কুটির শিল্প, ছোট শিল্প, নারী উদ্যোক্তা এবং কিছু সেক্টর আছে; যেমন—নানা রকম মসলা, যেগুলো আমরা উৎপাদন করি। এগুলো কিন্তু কম সুদে ঋণ না নিলে এগুলোর উৎপাদনকারীরা টিকতে পারবেন না।</p> <p>এটা না করলে সার্বিকভাবে আবার আমরা বিপত্তির মুখে পড়ব। কারণ দেখা গেছে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি হলেই কিন্তু ব্যাংকগুলো ছোট শিল্প এবং এ সমস্ত ক্যাটাগরির যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁদের ঋণ দিতে চায় না বা তাঁদের ঋণ দিতে এতটা উৎসাহী হয় না। ঋণ সংকোচন করলে খড়্গটা তাদের ওপরে পড়ে। বড় ঋণগ্রহীতারা এতটা অসুবিধায় পড়েন না। অর্থাৎ সংকোচনমূলক নীতির যে নেতিবাচক দিক, সেটা পরিহার করার জন্য কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন এদিকে যদি আমরা দৃষ্টি না দিই, তাহলে এখান থেকে আমরা প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান কোনোটাই বাড়াতে পারব না।</p> <p>আরেকটা জিনিস এখানে সবচেয়ে বড় হয়ে আসে, আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি মন্থর হয়ে গেছে। কভিড-উত্তর মোটামুটি একটা ভালো জায়গায় আসছিল, এখন কিন্তু আবার মন্থর হয়ে গেছে। কারণ এখানে মূল্যস্ফীতির চাপ, উচ্চ সুদের চাপ, ব্যাংকের তারল্য সংকটের চাপ—সব কটি মিলিয়েই কিন্তু আমাদের ব্যবসা, বিশেষ করে দেশীয় শিল্প বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর ফলে কর্মসংস্থান তৈরিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কর্মসংস্থানে আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সেটা আগামী বাজেটে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।</p> <p>সবচেয়ে লক্ষণীয়, বাংলাদেশে কিন্তু শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা অনেক। এটা অনেকে বলেন যে শিক্ষিত যুবকের সংখ্যা ৪০ শতাংশের ওপরে। সেই শতাংশের হিসাবে না গেলেও দেখা যাবে শিক্ষিত যারা—বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসছে বা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে আসছে, তারা কিন্তু খুব সহজে চাকরি পাচ্ছে না। এটা আমাদের জন্য সবচেড়ে বড় একটা বিপত্তির দিক। কারণ যখন বেকার সমস্যা দেখা দেয়, এমনিতে আমাদের যে প্রবৃদ্ধির হার বা আমাদের মোট দেশজ যে উৎপাদন বাড়ানোর হার, সেটা কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, যারা বেকার হয়েছে, তাদের জীবিকার সংস্থান বা তাদের নিজস্ব জীবনধারণ, তার পরিবারের জীবনধারণ—এটা কিন্তু খুব কঠিন হয়ে পড়ে।</p> <p>অতএব এগুলো আমাদের ঠিক করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, সামনে যে বাজেট দেওয়া হবে, হয়তো বা মোটামুটি বড় আকারের বাজেটই হবে, সেটা যেন বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাজেটের যে সম্পদ আহরণ করবে—দেশীয় সম্পদ হোক, বাইরে থেকে ধার করা মানে বাইরে থেকে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া, সেটা সম্বন্ধে যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে। কারণ এখনো কিন্তু আমাদের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে কর আদায় করছে, সেটা এখনো কিন্তু অনেকটা ঘাটতিতে আছে।</p> <p>আর দ্বিতীয়ত, বাইরে থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা এখন তো বেড়ে গেছে। দেখা গেছে যে বিগত ১০ বছর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অনেক হারে বেড়ে গেছে। বৈদেশিক ঋণের আসল এবং সুদ পরিশোধ করা আমাদের ওপর বড় একটা বাড়তি বোঝা। বিশেষ করে বাজেটের বড় একটা অংশ কিন্তু এই খাতে চলে যাচ্ছে। অতএব এই দিকটাও আমাদের বিবেচনা করার সময় আসছে, আমরা কত ঋণ নেব—কোন উৎস থেকে নেব—সরকারের বৈদেশিক ঋণ নেওয়া, এটার যথাযথ ব্যবহার, এটা পরিশোধ করার সক্ষমতা, এগুলো বিবেচনা করতে হবে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আমরা কিভাবে উজ্জীবিত করব, এটা কিন্তু এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে নীতিনির্ধারকদের জন্য।</p> <p>লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়</p> </article>