<article> <p style="text-align: justify;">পানির অপর নাম জীবন। পানি যদি সুপেয় না হয়, তখন তা হয়ে ওঠে স্বাস্থ্য সমস্যাসহ মৃত্যুর কারণ। পানির সংকট বর্তমানে একটি বৈশ্বিক সংকট। ক্রমান্বয়ে এই সংকট আরো তীব্র হচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই সংকট ছড়িয়ে পড়ছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশই সুপেয় পানি পানের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর মৌলিক স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে সুপেয় পানির সুযোগবঞ্চিত জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিতি হলেও দেশের ৪১ শতাংশ মানুষ এখনো নিরাপদ পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং বাড়িতে নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত ৬১ শতাংশ মানুষ।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অনেক নদ-নদীও শুকিয়ে যাওয়ার কারণে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের জলাভূমি কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ এবং সারা দেশে এরই মধ্যে নৌপথ হারিয়ে গেছে কমপক্ষে আট হাজার কিলোমিটার।</p> <p style="text-align: justify;">দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ধ্বংসযজ্ঞের পর এই সংকট আরো তীব্র হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যা এখনো পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় গড় বৃষ্টিপাত কমে গেছে। একদিকে অস্বাভাবিক জোয়ারে বাঁধের নাজুক পরিস্থিতি, অন্যদিকে পানযোগ্য পানির অভাবে চিন্তা বাড়িয়েছে উপকূলীয় মানুষের।</p> <p style="text-align: justify;">বর্তমানে প্রায়ই সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী ও অন্যান্য উপকূলীয় জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে পানিসংকটের খবর পাওয়া যায়। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা; আর শুকনা মৌসুমে এক কলস পানির জন্য ছুটতে হয় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ। বেশির ভাগ পরিবারে পানি সংগ্রহের দায়িত্ব থাকে নারীর কাঁধে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সংসারের সব কাজ শেষ করে নারীকে ছুটতে হয় পানি সংগ্রহে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপদের পাশাপাশি উপকূল অঞ্চলের অনেক স্থানে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে বহু গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">উপকূলের অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই সুপেয় পানির জন্য যুদ্ধ করছে। তাদের কেউ পুকুর, বৃষ্টি বা বিশুদ্ধকরণ প্লান্ট থেকে সংগ্রহ করা পানি পান করছে। যারা এসব উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে। এতে নানা ধরনের রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে তারা। আবার অনেকেই এই লবণাক্ত পানি পানে অভ্যস্ত হয়ে বুঝতেই পারছে না যে কঠিন রোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি পান করলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়, যার ফলে নারীর গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শুধু লবণাক্ততাই নয়, বিশ্বজুড়ে পানির নতুন বিপদ হিসেবে অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার সমস্যাকে সামনে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আর্সেনিকের কারণে পানিদূষণের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, এসব সমস্যা বিশ্বের সুপেয় পানির উৎসগুলোকে বিষিয়ে তুলছে।</p> <p style="text-align: justify;">ভৌগোলিক ও মানবসৃষ্ট কারণে দেশে সুপেয় পানির সংকট অত্যন্ত প্রকট এবং এই সংকট দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় সবচেয়ে বেশি। দেশের উপকূলবর্তী ১৯টি জেলায় প্রায় তিন কোটি ৯০ লাখ মানুষের বসবাস, যাদের জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পানিসংকটের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পারে না প্রায় তিন কোটি মানুষ। শুধু ভূপৃষ্ঠে থাকা পানি নয়, ভূগর্ভস্থ পানিও ক্রমে লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। নলকূপেও উঠে আসে লবণাক্ত পানি। ধারণা করা হয়, বর্তমানে ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। নদীভাঙন, বন্যা, চিংড়ি চাষ ও ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততার কারণে গত কয়েক বছরে সুন্দরবন এলাকায় মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়েই চলেছে।</p> <p style="text-align: justify;">সুন্দরবন উপকূলে ৭৩ শতাংশ পরিবার সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট; সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটি; সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও অসচেতনতা। নিরাপদ পানির পাশাপাশি স্যানিটেশনের সুবিধা থেকেও এখনো অনেক দূরে এই উপকূলের মানুষ। এসব সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সুদৃষ্টি এবং একই সঙ্গে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। অন্যথায় উপকূলের মানুষ পানির অভাবেই উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিতে বাধ্য হবে।</p> <p style="text-align: justify;"><b>লেখক : চেয়ারম্যান</b>, অ্যাকোয়াকালচার বিভাগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা</p> <p style="text-align: justify;">mir.ali0077@gmail.com</p> </article>