<article> <p style="text-align: justify;">ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নানা ঘটনা ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। সে সময় করাচি পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ায় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা সেখানে বসেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মূল কর্মপন্থা নির্ধারণ করতেন। তাঁরা শিক্ষাক্ষেত্রসহ দাপ্তরিক নানা কাজে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার অপকৌশল বাতলে দেন। এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়, বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হতাহতের পর পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, লাহোর প্রভৃতি শহরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সেখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন এবং পত্রপত্রিকায় ঢাকার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হয় এবং শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা ছাড়াও তাঁদের পরিবার-পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন ও ঘটনার তদন্তের দাবি তোলা হয়। এ ছাড়া বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিও সমর্থন করা হয়। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকে যেমন যুক্ত হয়, তেমনি সেখানে বসবাসরত পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা লক্ষ করা যায়।</p> <p style="text-align: justify;">পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা ভাষা বিরোধী তৎপরতা শুরু হয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">ডাকটিকিট, মুদ্রা, চাকরির পরীক্ষা প্রভৃতি থেকে বাংলা ভাষা বাদ দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ নভেম্বর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব মি. গুড ইন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়াদি সম্পর্কে যে সার্কুলার প্রচার করেন, তাতে ৯টি ভাষা স্থান পেলেও বাংলা ভাষা বাদ দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা পাস হয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করলে ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ মুসলিম লীগের নীতিনির্ধারক ও সদস্যদের বিরোধিতায় তা নাকচ হয়ে যায়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">১৯৪৯ সালে পাকিস্তান মূলনীতি কমিটির যে খসড়া প্রণয়ন করা হয়, তাতে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয়। গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দীন, ফজলুর রহমান প্রমুখ উর্দুর পক্ষে ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। ‘বাবা-ই-উর্দু’ নামে খ্যাত মওলানা আবদুল হক পশ্চিম পাকিস্তানে বসে ফতোয়া জারি করেছিলেন যে অন্য কোনো ভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দান করা পাপ। ১৯৫২ সালের ২১ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, উর্দুর ওপরই পাকিস্তানের সংহতি ও একতা নির্ভর করছে। ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি লাহোরে উর্দু সম্মেলন আয়োজন করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি জানান।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">১৯৫৪ সালের ২২ এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে উর্দু সমর্থকদের একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। তারা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও যানবাহন বন্ধ করে দেয়। আল-ওয়াহিদ নামের একটি সিন্ধি পত্রিকার অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। একই দাবিতে ২৬ এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে গণপরিষদ ভবন ঘেরাও করে ব্যাপক হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ওই দিন গণপরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া" height="341" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/February/09-02-2024/457.jpg" width="500" />১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণে হতাহতের পর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। করাচির ডন, ইভনিং টাইমস, ইভনিং স্টার প্রভৃতি পত্রিকায় ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নিন্দা, তদন্ত দাবি, শহীদদের প্রতি শোক জ্ঞাপন ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানানো হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি ডন পত্রিকায় ‘ঢাকার মর্মান্তিক ঘটনা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলা ভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দেওয়া হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মোটেও আপত্তি থাকতে পারে না। ঢাকার মর্মান্তিক ঘটনার ফলে সমগ্র পাকিস্তান দুঃখ-ভারাক্রান্ত হবে এবং পাকিস্তানের শত্রুরা উল্লসিত হবে। গুলিবর্ষণের তদন্ত দাবি ছাড়াও দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতেই হবে বলে উল্লেখ করা হয়। ইভনিং টাইমসে বলা হয়, উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষাও যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তাই যত শিগগির এ প্রশ্নের মীমাংসা হয়, ততই মঙ্গল। আরো বলা হয়, বাংলা ভাষার দাবির সমর্থকরা দেশপ্রেমিক নয় বলে যে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, তা অন্যায়। ওই দাবির জন্য সংগ্রামে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, সেই বীর শহীদদের আমরা অন্তরের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জানাই। ভাষা আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে ইভনিং টাইমসের সম্পাদক জেড এ সুলেরি পূর্ব পাকিস্তানে এলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুক্তিলাভের পর করাচিতে ফিরে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, তার পেছনে রয়েছে পূর্ববঙ্গের সমস্ত অধিবাসী। এতে উর্দুভাষীরাও রয়েছে। তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এ ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের কাছ থেকে সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।</p> <p style="text-align: justify;">পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন; যেমন—পাকিস্তান সমাজতন্ত্রী দল, প্রাদেশিক এছলাম লীগ ও গণতন্ত্রী ছাত্র ফেডারেশন ঢাকায় গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করে। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সমাজতন্ত্রী দলের সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের আদেশ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি তোলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি গণতন্ত্রী ছাত্র ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটি করাচিতে এক প্রতিবাদ সভা আয়োজন করে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে এবং নিহতদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে তদন্ত দাবি জানায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি করাচি প্রাদেশিক এছলাম লীগের কার্যনির্বাহী সমিতির এক সভায় পূর্ববঙ্গে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের দাবি তোলা হয় এবং বলা হয়, নূরুল আমীন সরকার ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরিস্থিতিতে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করায় তাদের অপমানিত হওয়া উচিত বলে প্রস্তাব পাস করা হয়। এক প্রস্তাবে গুলিবর্ষণের নিন্দা, শহীদদের প্রতি শোক জ্ঞাপন ও ঘটনার তদন্ত দাবি করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">করাচি ও লাহোরে অধ্যয়ন ও বসবাসরত পূর্ববঙ্গের ছাত্ররাও ২১ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শামিল হন। ২৪ ফেব্রুয়ারি করাচির মেথরান হোস্টেলে বসবাসরত ছাত্ররা এক তারবার্তায় ঢাকায় পুলিশি তাণ্ডবের তীব্র প্রতিবাদ জানান। ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির কথা ওই বার্তায় উল্লেখ করা হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি এম আর খোন্দকার এক বিবৃতিতে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশের জুলুমের নিন্দা করেন। তিনি শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি করেন। একই  দিনে লাহোরের উইং হলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মুস্তাফিজুর রহমান। সভায় শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয় এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি এবং পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণে আহত-নিহতদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠন করে দোষী কর্মচারীদের স্থায়ীভাবে পদচ্যুতি এবং বিচার দাবি করা হয়। সভায় পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার অনুরোধ জানানো হয়।</p> <p style="text-align: justify;">১৯৫২ সালের মে-জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে এক সফরে যান। তিনি করাচিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভাষা আন্দোলনের বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান এবং ছাত্র হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন। তিনি হায়দরাবাদে গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর বিবৃতি গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি লাহোরে সংবাদ সম্মেলন অয়োজন করে ভাষা আন্দোলন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিভ্রান্তি দূর করেন। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জোরদার হয়।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>গবেষক-প্রাবন্ধিক, সাবেক ডিন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় </p> </article>