<p>কুয়াশার সকালে পূর্বাচলে এসে একঝাঁক পরিযায়ী পাখির দেখা পেলাম। পরিচিত পাখি, নাম মেটেমাথা-টিটি। বালু নদ থেকে নেমে আসা আধমরা এক খালের কাদায় ওরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে; লাল চোখের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে আমাদের গতিবিধি দেখছে। জানি না ওদের চোখে আমরা দেখতে কেমন! তবে আমাদের কাছে মেটেমাথা-টিটির ঝাঁক চোখ-জুড়ানো এক দৃশ্য, নববর্ষের সেরা উপহার! প্রতি শীতেই দেশের বাদাভুঁয়ে আমরা এদের দেখা পাই।</p> <p>এমনকি দালানকোঠার স্তূপে ডুবে থাকা এই নগরীতেও এদের সাক্ষাৎ মেলে। শীতের আগন্তুক হলেও এরা আমাদের চিরচেনা হট-টিটি পাখির নিকটাত্মীয়। হট-টিটির মতোই এরা লম্বা পায়ে ডগমগিয়ে চলে; আর কাছে গেলে জোরে ডাক ছেড়ে উড়ে যায়। কিন্তু এরা ডাকে নরম গলায় : ‘টিক, টিক, টিটিক’; হট-টিটির মতো ধমক দিয়ে বলে না : ‘হট, হট, হট, টিটি-হট’!</p> <p>হট-টিটির মতোই রক্তচক্ষু আর রঙিন চঞ্চু ও পা রয়েছে মেটেমাথা-টিটিদের। এরাও হট-টিটির মতো কাদামাটি আর ভেজা ঘাস থেকে পোকা খুঁটে খায়। কিন্তু হট-টিটির মতো এ দেশে বাসা বাঁধে না। গ্রীষ্মে এরা চলে যায় উত্তরে, চীনের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে। ডিম দেয় সেখানকার ঘাসের প্রান্তর ও বাজরা-ক্ষেতে। গ্রীষ্ম বিদায় নিলে মাঞ্চুরিয়ার বিশাল প্রান্তর আবার বিরান, রুক্ষ ও শীতল হতে থাকে।</p> <p>প্রজনন পর্ব শেষে তাই মেটেমাথা-টিটিরা ফিরে আসে আমাদের দেশে। এখানকার বাদাভুঁয়ে ও শিশিরসিক্ত প্রান্তরে এরা আহার খুঁজে পায়। হেমন্ত, শীত ও বসন্তজুড়ে এখানেই থাকে যত দিন পর্যন্ত আবার প্রজননের বার্তা না আসে। বাংলাদেশ ও চীনের মাঞ্চুরিয়ার মধ্যে প্রতিবছর এই যাওয়া আর আসা চলবে হয়তো যত দিন পৃথিবীতে এই পাখি বেঁচে থাকবে তত দিন।</p> <p>কোনো দীর্ঘমেয়াদি ও বড় ভূপ্রাকৃতিক বিপর্যয় বা পরিবর্তন না হলে আর কি! সুদীর্ঘকাল ধরেই চলছে এদের এই যাতায়াত; মুখস্থ হয়ে গেছে পথের নিশানা এবং সয়ে গেছে পথের কষ্ট। উড়তে সক্ষম হলেই এদের ছানাপোনাও জন্মভূমি ছেড়ে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে আসতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বালু নদ এলাকা আর মাঞ্চুরিয়ার সিংহুয়া-নদীর চরে মেটেমাথা-টিটিরা বসবাস শুরু করেছে মানুষের বসতি হওয়ারও লাখো বছর আগে। তার পর থেকে যুগে যুগে এই দুই নদীতীরেই মানুষ এসেছে; নানা কারণে সংকীর্ণ হয়েছে নদীনালা; বদলে গেছে দৃশ্যপট। বংশানুক্রমে সবই দেখেছে এই পাখিরা; মানিয়েও নিয়েছে তাবৎ পরিবর্তনের সঙ্গে।</p> <p>কয়েক দশক আগে ঢাকাবাসী হওয়ার পর থেকেই তুরাগ আর বালু নদের চরে শীতে মেটেমাথা-টিটি পাখির ঝাঁক দেখেছি। দিনে দিনে তুরাগ নদটি সংকীর্ণ ও চরমভাবে কলুষিত হওয়ার পরে ঢাকা মহানগরীতে এখন বালু নদই সম্ভবত এই পাখিদের শেষ আশ্রয়। কিন্তু বালু নদেও এই টিটির সংখ্যা হাজার থেকে এখন শতে নেমে এসেছে। এর মধ্যে নদ ও খালের আশপাশে আধুনিকায়ন তথা সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে গিয়ে ভবিষ্যতে নিরীহ টিটিদের আহার্য জন্মানোর পথ যেন বন্ধ না হয়, সেদিকে সবাই লক্ষ রাখবেন আশা করি।</p> <p>দুরবিন দিয়ে আমরা সারিবদ্ধ মেটেমাথা-টিটিগুলো ভালো করে চেয়ে দেখলাম। ঝাঁক বেঁধে থাকলেও বেশির ভাগ পাখি জোড়ায় জোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। নিশিভোরে এসেই হয়তো এরা এখানে কাদা থেকে পোকা তুলে উদরপূর্তি করেছে। এখন সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে নিঃশব্দে।</p> <p>পাখিমাত্রেই একটি পা ভাঁজ করে পালকের মাঝে গুঁজে রেখে এক পায়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায় কিংবা বিশ্রাম নেয়। আমাদের সামনে অনেক মেটেমাথা-টিটিরই মাত্র একটি করে পা দেখতে পাচ্ছি। অনেকেরই চোখ বন্ধ অথবা ঢুলু-ঢুলু। একটি পাখিও আহারের খোঁজে পানি-কাদায় চঞ্চু ডোবাচ্ছে না। মনে হলো, এই খালে আজও মেটেমাথা-টিটিদের জন্য পর্যাপ্ত পোকামাকড় আছে। তা না হলে সকাল সকাল এতগুলো পাখি এমনভাবে পা ভাঁজ করে বিশ্রামে যেতে পারত কি! খালগুলোর এই অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকুক সেটাই সংরক্ষণকর্মী ও পাখিপ্রেমীদের প্রত্যাশা।</p> <p>মেটেমাথা-টিটির বৈজ্ঞানিক নামকরণের ইতিহাসেও বাংলা বা বঙ্গ অঞ্চলের উল্লেখ আছে। ১৯ শতকের প্রথমার্ধে ‘রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর গবেষণাগারে কর্মরত জগদ্বিখ্যাত পাখিবিদ এডওয়ার্ড ব্লাইদ কলকাতা থেকে এই পাখিটির উপাত্ত ও নমুনা নিয়ে এর প্রজাতি নির্ধারণ ও নামকরণ করেছিলেন।</p> <p>পৃথিবীতে ৩০ প্রজাতির টিটি আছে। বাংলাদেশে এর পাঁচটি প্রজাতি দেখতে পাই আমরা। এর মধ্যে হট-টিটি, নদী-টিটি ও হলদেগাল-টিটি এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। পূর্বাচলে আজও এই তিন প্রজাতিরই দেখা মেলে। পরিযায়ীদের মধ্যে মেটেমাথা-টিটি ছাড়া আমাদের হাওরে ও বিলে আসে উত্তুরে-টিটি।</p> <p>শঙ্কার মধ্যে সুসংবাদ হলো, মহানগরী ঢাকার অদূরের নদীতীরে মেটেমাথা-টিটির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে এলেও সারা দেশের হিসাবে এরা আজও বেশ ভালো আছে। সারা দেশে জলচর পাখির বার্ষিক গণনার উপাত্তে অনেক অবনতির মধ্যে টিটিদের উঁচু সংখ্যা দেখে আজও আমরা স্বস্তি বোধ করি।<br />  </p>