ইংল্যান্ডের ইতিহাসে রানি প্রথম এলিজাবেথ এক অনন্য চরিত্র। রাজা অষ্টম হেনরির কন্যা এলিজাবেথ একমাত্র ব্রিটিশ রানি, যিনি কখনো বিয়ে করেননি। তবে আজ থেকে ৪৫০ বছর আগে কেনিলওয়ার্থ দুর্গে তার এক স্মরণীয় সফর ও প্রেম-সম্ভাবনার গল্প কৌতূহল জাগায় মানুষের মনে। সম্প্রতি বিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই গল্প।
১৫৭৫ সালের ২০ জুলাই, ৪১ বছর বয়সে রানি এলিজাবেথ এসেছিলেন কেনিলওয়ার্থ দুর্গে। সেই দুর্গটি তিনি বহু আগেই উপহার দিয়েছিলেন তার প্রিয়জন রবার্ট ডাডলিকে। ডাডলির সঙ্গে রানির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে তখনকার সমাজে চলত নানা গুঞ্জন। অনেকে মনে করতেন, এই সফরের আয়োজন আসলে ছিল এক অনন্য প্রেম নিবেদন।
রানির আগমন উপলক্ষ্যে দুর্গে ডাডলি আয়োজন করেছিলেন চমকপ্রদ সব বিনোদনের। সসংগীত, নৃত্য, অ্যাক্রোবেটিক কসরত, আতশবাজি, নাট্য পরিবেশনা—সব কিছুর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল বিবাহের আবেদন।
এই আয়োজনে প্রতি দিনে খরচ হয়েছিল প্রায় এক হাজার পাউন্ড, যা আজকের মূল্যে লাখো ডলার। অনেকে বলেন, ডাডলির এই আয়োজন ছিল রানিকে বিয়ে করার শেষ চেষ্টা—‘হিজ লাস্ট থ্রো অফ দ্য ডাইস’।
কিন্তু এই বিয়ের নাটকের ক্লাইম্যাক্সে আসে ভাটা।
শেষে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল একটি মাস্ক (নাট্য পরিবেশনা), যেখানে চাস্টিটির দেবী ডায়ানা খুঁজছিলেন তার সতী নিম্ফ জাবেট্টাকে—যা স্পষ্টতই এলিজাবেথের রূপক নাম। নাটকের মাধ্যমে রানিকে বিয়ে করতে অনুরোধ করবেন ভেবে রেখেছিলেন ডাডলি। কিন্তু নাটকটি আর মঞ্চস্থ হয়নি। কারণ কি কেবল খারাপ আবহাওয়া, নাকি রানি সেই বার্তা পছন্দ করেননি তা আজও অজানা।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৫৫৮ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসেন এলিজাবেথ। ততদিনে দেশজুড়ে চলছে ধর্মীয়, রাজনৈতিক আর আর্থিক সঙ্কট। সবাই বলছিলেন—একজন নারী শাসক একা শাসন করতে পারবেন না। সংসদ, উপদেষ্টা, এমনকি প্রজারাও চেয়েছিল তিনি বিয়ে করুক। কিন্তু এলিজাবেথ জানতেন, বিয়ে মানে স্বামীকে কর্তৃত্ব ছেড়ে দেওয়া। আর তেমন কিছু তিনি কখনোই করতে রাজি ছিলেন না।
তিনি নিজে ছিলেন উচ্চশিক্ষিত—পাঁচটি ভাষায় পারদর্শী, ইতিহাস ও বক্তৃতাশাস্ত্রে প্রশিক্ষিত। এছাড়াও তার শৈশবেই দেখেছেন কীভাবে তার সৎ মা ক্যাথারিন পার একজন নারী হয়েও রাজার অনুপস্থিতে ক্ষমতা সামলেছিলেন।
আর পারিবারিক ইতিহাস? তার মা, রানী অ্যান বোলিন মিথ্যা অভিযোগে হেনরি অষ্টমের আদেশে শিরচ্ছেদ হন। মেনডিকের শিল্পকর্মে দেখা যায় এক ভয়াবহ দৃশ্য—শিয়ালের রূপে অ্যান প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে, সামনে এক নৃশংস কুকুর সদৃশ শিরোচ্ছেদকারী।
এলিজাবেথ ব্যক্তিগতভাবে আকর্ষণীয় পুরুষদের পছন্দ করলেও, সন্তান ধারণ ও প্রসবকালীন ঝুঁকি তাকে ভয় পাইয়ে তুলেছিল। তখনকার দিনে সন্তান জন্ম মানেই ছিল মৃত্যুর হাতছানি—এটা তিনি খুব ভালো করেই জানতেন।
অন্যদিকে, রাজনীতির কৌশলেও বিবাহ ছিল একটি কার্ড। এলিজাবেথ তার বিয়ের গুঞ্জন ব্যবহার করেছেন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে—ফ্রান্স, স্পেনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন সম্ভাব্য বিয়ের আলোচনার মাধ্যমে।
তাই তিনি নিজেকে ‘ভার্জিন কুইন’ হিসেবে গড়ে তোলেন। জনতার সামনে বারবার ঘোষণা করেন—‘আমি বিয়ে করেছি ইংল্যান্ডকে।’
কেনিলওয়ার্থ দুর্গের সেই প্রেম নিবেদন আয়োজনের প্রায় ৪৫০ বছর পর রানির সব কাহিনিকে ঘিরে শিল্পী লিন্ডসে মেনডিক তৈরি করেছেন এক ব্যতিক্রমী ভাস্কর্য-স্থাপনাশিল্প, যার নাম ‘উইকেড গেম’। ইতিহাস আর রূপকের মিশেলে নতুন দৃষ্টিকোণ হাজির করেছে রানির চিরকুমারী জীবনের উপর। কেনিলওয়ার্থ ক্যাসলের গ্রেট হলে ৩১ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী।