<p>ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন আজ। বেঁচে থাকলে আজ এই মহান পরিচালকের বয়স হতো ১০৩ বছর। ১৯২১ সালের ২ মে ক্ষণজন্মা এই মানুষটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতায়। শুধু চলচ্চিত্রের জন্যই নয়, বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন তিনি।</p> <p>আধুনিক বাংলা সংস্কৃতি জগতের একটি বিরল প্রতিভা সত্যজিৎ রায়। তাকে বলা হয়, বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃৎ, যার হাত ধরে বাংলা সিনেমা প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে পৌঁছেছিল। নির্মাতার পাশাপাশি লেখক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং শিল্প নির্দেশক হিসেবেও তার ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। মধ্য বয়সে ছবি বানানো শুরু করা মি. রায় পরবর্তীতে পরিচিতি লাভ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে। মার্টিন স্কোরসেস থেকে শুরু করে খ্যাতনামা বহু পরিচালক তার সিনেমা দেখে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ পেয়েছেন বলে জানা যায়। একজন সিনেমাপ্রেমী হিসেবে কতটুকু জানেন সত্যজিৎ সম্পর্কে? <strong>চলুন আজ এই কিংবদন্তির জন্মদিনে জেনে নিই তাঁর আদ্যোপান্ত।</strong></p> <p>১৯২১ সালের আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়, বাংলা কথাসাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রকর ও চলচ্চিত্র পরিচালক। সত্যজিৎ রায়ের জন্ম কলকাতা শহরে। সাহিত্য ও শিল্প সমাজে খ্যাতি ছিল রায় পরিবারের। তাঁর পূর্বপুরুষ বাস করতেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে মহকুমার (বর্তমানে বাংলাদেশ) কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। </p> <p>সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা উঠলেই অবধারিতভাবে যে চলচ্চিত্রটির নাম সামনে চলে আসে, সেটি হচ্ছে ‘পথের পাঁচালী’। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্র দিয়ে মি. রায় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং প্রথম ছবিতেই সমালোচকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে বাংলা ভাষার খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস অবলম্বনে।</p> <figure class="image"><img alt="1" height="225" src="https://assets.telegraphindia.com/abp/2021/Apr/1619316006_satyajit-ray.jpg" width="400" /> <figcaption><sub><em>সত্যজিৎ রায়</em></sub></figcaption> </figure> <p>‘পথের পাঁচালী’ ছিল সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর টিমের জন্য অবিস্মরণীয় কাজ। আর্থিক দিক বজায় রেখে, সঠিক কাস্ট এবং শ্যুটিং লোকেশন নির্বাচন করা, এটি একটি অবিশ্বাস্য কাজ ছিল। ছবিটিতে আর্থিক তহবিলের অভাব দেখা দিলে, সত্যজিৎ তাঁর জীবন বীমা পলিসি বিক্রি করে দেন। সেইসময় তাঁর স্ত্রী আর্থিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাঁর গয়নাও বন্দক দিয়েছিলেন। এই ম্যারাথন শ্যুটিং সম্পূর্ণ করতে তিন বছর লেগেছিল। সত্যজিৎ রায় 'পথের পাঁচালী' নির্মাণকে অলৌকিক ঘটনা বলতেন। এই মাস্টারপিসটি ভারতীয় সিনেমাকে বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরেছিল। চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে অপু নামের একটি শিশু, যাকে নিয়ে মি. রায় পরবর্তীতে ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ নামে আরও দু’টি সিনেমা নির্মাণ করেন। এই তিনটি চলচ্চিত্র একত্রে ‘অপু ট্রিলজি’ বা ‘অপু ত্রয়ী’ নামেও পরিচিত। এরপর নিজের বর্ণিল ক্যারিয়ারে তিনি একের পর এক উপহার দিয়েছেন মহানগর, জলনসাঘর, অশনি সংকেত, হীরক রাজার দেশের মতো কালজয়ী সব সিনেমা।</p> <p>চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখার আগে, সত্যজিৎ ১৯৪৭ সালে কলকাতায় প্রথম চলচ্চিত্র ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ ছিল এই ক্লাবে প্রদর্শিত প্রথম চলচ্চিত্র। এমনকী তিনি সংবাদপত্রের জন্য সিনেমা নিয়ে অনেক নিবন্ধ লিখেছিলেন এবং দুর্দান্ত চিত্রনাট্য তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। এমন আবেগ ছিল যে যখনই কেউ উপন্যাস বা গল্পের উপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র ঘোষণা করতেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের স্ক্রিপ্ট তৈরি করতেন এবং মূল ছবির সঙ্গে তুলনা করতেন। এই উদ্যোগ তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণে বড় পদক্ষেপ হয়ে ওঠে।</p> <p>১৯৫০ সালে লন্ডনে ফিরে যাওয়ার সময়, সত্যজিৎ একটি বিস্ময়কর ১০০টির উপর চলচ্চিত্র দেখেছিলেন। সেই সময় তিনি ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। এমনকী তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি উদ্ভাবনী উপায় ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর প্রস্তাবিত চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যে অভিনেতা, মেকআপ ছাড়াই নতুন লোকেশনের শ্যুটিং অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু, কেউ তাঁকে বিশ্বাস করেনি। তাঁকে তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে পথের পাঁচালী তৈরি করতে রাজি করেছিলেন। ঠিক যেভাবে তিনি সবসময় স্বপ্ন দেখেছিলেন।</p> <figure class="image"><img alt="1" height="300" src="https://satyajitray.org/wp-content/uploads/2019/11/Ray-1024x768.jpg" width="400" /> <figcaption><sup><em>ক্যামেরার পেছনের জাদুকর সত্যজিৎ রায়</em></sup></figcaption> </figure> <p>সত্যজিৎ রায়ের অপর একটি মাইলফলক, তিনি প্রথম রঙিন বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজগুলির মধ্যে একটি, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ (১৯৬২) প্রথম রঙিন বাংলা চলচ্চিত্র এবং এটিকে প্রথম ভারতীয় নৃতত্ত্ব চলচ্চিত্র হিসেবেও গণ্য করা হয়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, পার্বত্য অঞ্চলে স্থাপিত একটি আদি অবস্থানে বিংশ শতাব্দীর সমস্যাগুলিকে ঘিরে তৈরি। দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্যাগুলো আমরা লুকানোর চেষ্টা করি সেগুলো সবার সামনে প্রকাশ করেছেন সিনেমার মাধ্যমে।</p> <p>আজকের যুগে বিজ্ঞাপনের আধিপত্য সবকিছুতেই। বিজ্ঞাপনই পুজিবাদি দুনিয়ার একমাত্র ভরসা। এই বিজ্ঞাপনের জাদুকরও বলা হয় সত্যজিৎ রায়কে। তিনি একটি ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থায় জুনিয়র ভিজ্যুয়ালাইজার হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ডিজে কিমার কোম্পানির সঙ্গে ১৯৪৩ সাল থেকে প্রথম নির্দেশিকা পথের পাঁচালী মুক্তি পর্যন্ত কাজ করেছিলেন যা ১৯৫৬ সালে একজন পেশাদার চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে তাঁর অবস্থান অনেকটা শক্তিশালী করে তুলেছিল। তাঁর বিজ্ঞাপনের দিনগুলিতে, তিনি কিছু উজ্জ্বল উদ্ভাবনী বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিলেন, যা টাইপোগ্রাফি এবং চিত্রের প্রতি তাঁর আবেগকে তুলে ধরে। সুতরাং, তাঁকে একজন বিজ্ঞাপনের জাদুকরও বলা যেতে পারে।</p> <p>১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক লিজিয়ন অফ অনারে ভূষিত হন সত্যজিৎ রায়। ফ্রান্স সবসময়ই অনেক ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই অলঙ্করণগুলি, যেমন ব্যাপকভাবে পরিচিত, যেমন ন্যাশনাল অর্ডার অফ দ্য লিজিয়ন অফ অনার, দ্য অর্ডার অফ অ্যাকাডেমিক পামস এবং অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস এই ধরনের সম্মান প্রদান করে। এছাড়াও বিশ্ব চলচ্চিত্রের আরেক আইকন চার্লি চ্যাপলিনের পর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত হন। অনেকে বিশ্বাস করেন যে এই সম্মানটি তাঁর আজীবন কৃতিত্বের জন্য ১৯৯২ সালে পাওয়া সম্মান অস্কারের চেয়েও বেশি মর্যাদাপূর্ণ।</p> <p>অসাধারণ সিনেম্যাটিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, সত্যজিৎ তাঁর কাজ দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করেছেন এবং সেরা পরিচালকের জন্য ছয়টির মতো জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটি এখনও একটি অতুলনীয় অর্জন। চিড়িয়াখানা (১৯৬৭), গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৮), প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৬৯), সোনার কেল্লা (১৯৭৪), জন অরণ্য (১৯৭৫) এবং আগন্তুক (১৯৯১) এর জন্য তিনি এই পুরস্কার জিতেছেন। এমনকী তিনি দু’বার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের জন্য জাতীয় পুরস্কার জিতেছিলেন।</p> <p>১৯৯২ সালে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড বা অস্কার পেয়ে পৃথিবীজুড়ে বাঙালি সিনেমা নির্মাতাদের জন্য নতুন বার্তা বয়ে আনেন সত্যজিৎ। তবে ওই বছরেরই ২৩ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান উপমহাদেশের বিখ্যাত এই চলচ্চিত্র নির্মাতা।</p>