<p>সিলেট অঞ্চলে একসময় মূল্যবান সম্পদ বা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হতো কড়ি। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটি তুচ্ছ হলেও হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার উত্তর সাঙ্গর গ্রামে মাটির নিচে পাতিলভর্তি একসময়ের মূল্যবান কড়ি পাওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।</p> <p>স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত এক সপ্তাহ আগে বানিয়াচং উপজেলার উত্তর সাঙ্গর গুরুগৃহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেয়াল নির্মাণ করার সময় একটি পরিত্যক্ত টিলামতো ভূমির মাটি খনন করলে মাটির নিচে পাওয়া যায় একটি বড় মাটির পুরনো পাতিল। পাতিলটির ভেতরে পাওয়া যায় সহস্রাধিক কড়ি। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও এলাকার লোকজনের মাঝে কড়ি সংগ্রহের হিড়িক পড়ে যায়।</p> <p>উত্তর সাঙ্গর গুরুগৃহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মায়া রানী দাস জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, জায়গাটি হয়তো কোনো বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। দেড় শ-দুই শ বছর আগে কড়িগুলো মাটির নিচে রাখা হয়েছিল।</p> <p>কড়ি পাওয়ার খবর শুনে বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) বিকেলে ওই এলাকার কবি কাজী বশিরুল হক ও পার্শ্ববর্তী উত্তর সাঙ্গর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গৌতম চন্দ্র দাস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, ‘গর্তের চারপাশে পাতিলের ভাঙা অংশ ও দু-একটি কড়ি মাটির সঙ্গে মিশে থাকতে দেখি। সেখান থেকে কয়েকটি কড়ি সংগ্রহ করি। পরের দিন আমার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নীতেন্দ্র দাসকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতায় সেই স্থানে ভাঙা  পাতিলের মধ্যে আরো কিছু কড়ির সন্ধান পাই। কড়িপ্রাপ্তির কথা শুনে প্রাথমিকভাবে জায়গাটিকে পূর্বকালের কোনো বাণিজ্যিক কেন্দ্র বলে ধারণা হচ্ছে। কিন্তু কড়িপ্রাপ্তির খবর শোনার পর বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও উৎসুক জনতা জায়গাটি খুঁড়ে কড়ি নিয়ে যাওয়ায় স্থানটির প্রকৃত স্বরূপ অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়ে।’  </p> <p>গৌতম চন্দ্র দাস বলেন, ভারতবর্ষে কড়ির ব্যবহারের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। ব্যাপকভাবে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কড়ি ব্যবহৃত হলে ও কিছু ক্ষেত্রে অলংকার হিসেবে কড়ি ব্যবহারের প্রমাণ আছে। সিলেট ও রংপুর অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলেও এর ব্যবহার ছিল। ইংরেজরা এসে রৌপ্য মুদ্রা চালু করলে এটি বিলুপ্ত হতে থাকে। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিল চীন, আফ্রিকা ও ইউরোপেও। সাধারণ পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের পাশাপাশি মানুষ (ক্রীতদাস) ক্রয়-বিক্রয়েও কড়ি ব্যবহৃত হতো। তবে আমাদের দেশে প্রাপ্ত কড়ি ও বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত কড়ির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। </p> <p>তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের কড়ির পৃষ্ঠদেশ কচ্ছপ আকৃতির, এর পৃষ্ঠদেশে কালো ও নীলাভ বর্ণের ছটা থাকে। অন্যদিকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত কড়ির আকৃতি ছিল একটু চ্যাপ্টা, গায়ের রং দুধ-সাদা বর্ণের। এসব কড়ি আসত মালদ্বীপ থেকে। ভারতবর্ষ থেকে পাঠানো চালের বিনিময়ে এসব কড়ি নিয়ে আসা হতো বলে জানা যায়। বর্তমানেও লোকচিকিৎসা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের কিছু পর্বে কড়ির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। লৌকিক ভাষার কিছু ক্ষেত্রে এখনো কড়ি ব্যবহারের ঐতিহ্যের প্রমাণ রয়ে গেছে। যেমন অগ্রিম (প্রিপেইড) মূল্য পরিশোধ বোঝাতে ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ বলা হয়।’</p> <p>জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জয়ন্ত কুমার সিংহ বলেন, ‘পাল ও সেন বংশের শাসনের সময় কড়ি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে এখানে প্রাপ্ত কড়িগুলো এত পুরনো নয়। তবে ব্রিটিশ আমলেও এখানে কড়ির প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। তখনকার সময় ব্যাংকিং সুবিধা না থাকায় লোকজন মাটির নিচে এভাবেই গোপন করে রাখত তাদের সম্পদ। সম্ভবত এভাবেই এই কড়িগুলো কেউ সঞ্চয় করে রেখেছিল। তবে ছবি দেখে কিছু ধারণা করা কঠিন। আমরা সরজমিনে জায়গাটি পরিদর্শন করব।’</p> <p>ভারতের আসাম প্রদেশের গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও লেখক অলক সাহা বলেন, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম, পাঁচ কড়ি, কানাকড়ি’ এসব শব্দের মধ্যে কড়ি যে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো সেই ইতিহাস রয়ে গেছে।</p>