<article> <p style="text-align: justify;">ঘূর্ণিঝড় রিমালে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পুরো উপকূলীয় অঞ্চল এখন নোনা পানিতে সয়লাব। লবণাক্ত পানি আটকে আছে মিষ্টি পানির আধার ৩০ হাজারের বেশি পুকুরসহ অন্যান্য জলাশয়ে। অসংখ্য পানি সংরক্ষণের ট্যাংক, নলকূপ, পানি শোধনাগার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">এই অবস্থায় পানি সংকটে ভুগছে মানুষ, গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণী। ভয়াবহ বিপদে পড়েছে সুন্দরবনের প্রাণীরাও। এই অবস্থায় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই সংকট মোকাবেলায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, নদ-নদী ভরাট, লবণাক্ততার আগ্রাসন ও মনুষ্য সৃষ্ট নানা কারণে উপকূলে সুপেয় পানির সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলে এই সমস্যা প্রকট। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হলেও সংকট কমছে না। এই সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে রিমাল।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সরকারের জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর পানি সমস্যা সমাধানে কাজ করলেও এখনো ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির সুনির্দিষ্ট হিসাব দিতে পারেনি। তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিমালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা ও বরিশালে। বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকায় লবণাক্ত হয়ে পড়েছে ৩০ হাজার ৩০১টি পুকুর। এসব এলাকায় খাওয়ার পানির প্রধান উৎস ১৬ হাজার ৫০০টি নলকূপও অকেজো হয়ে পড়েছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সরেজমিনে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ট্যাংকগুলোর বেশির ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে সংরক্ষিত পানি। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরের মিঠা পানির শতাধিক পুকুর ও জলাশয়ও লবণাক্ত পানিতে ডুবে গেছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে সুন্দরবনে পর্যাপ্ত সুপেয় পানি সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কমিটি বলেছে, বন্য প্রাণী, বনজীবী, পর্যটক ও বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পুকুরগুলো থেকে দ্রুত নোনা পানি নিষ্কাশন করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;">বাগেরহাটের মোংলা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নূর আলম শেখ বলেন, ‘ঝড়ে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা তলিয়ে যায়। আগে এলাকাবাসী যে পুকুরের পানি পান করত, তা এখন লবণাক্ত। রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের খাবার পানি কিনে আনারও উপায় নেই।’</p> <p style="text-align: justify;">উপকূলে সুপেয় পানির সংকট নিরসনে দীর্ঘদিন কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘লিডার্স’। সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডল কালের কণ্ঠকে জানান, সুপেয় পানি নিশ্চিতের লক্ষ্যে লিডার্স খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে ১৮৫টি রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সিস্টেম (বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ), পাঁচ হাজার ২৫০টি বায়োস্যান্ড ফিল্টার স্থাপন এবং ২১টি পুকুর খনন করেছে। এ ছাড়া কৃষিকাজে সেচের সুবিধার্থে সাতটি গভীর নলকূপ স্থাপন, তিনটি খাল ও ৬৯টি ছোট পুকুর খনন করেছে। এসবের বেশির ভাগই ঝড়ে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">খুলনার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউপি চেয়ারম্যান তুহীন কাগজী জানান, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তরা এখন বেড়িবাঁধ সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত। তাদের রান্না, গোলসসহ সব কাজ লবণ পানিতে করতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষকেও লবণ পানি পান করতে হচ্ছে। ফলে অনেকের পেটের পীড়া ও চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘লবণাক্ত ও দূষিত পানি পান করার কারণে দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলোতে ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগ, হেপাটাইসিস বি-ভাইরাস, জন্ডিস ও টাইফয়েড জ্বর দেখা দিচ্ছে। ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থেকে নিউমোনিয়ার মতো কঠিন রোগ দেখা দিতে পারে। ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’</p> <p style="text-align: justify;">খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান বলেন, ‘পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে চার লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। দুর্যোগকবলিত মানুষকে ত্রাণসামগ্রী, সুপেয় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা খোঁজ নিয়েছেন এবং দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।’</p> <p style="text-align: justify;">সুন্দরবন বিভাগের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘সুন্দরবনে বন্য প্রাণী, বনজীবী এবং বনকর্মীদের সুপেয় পানির একমাত্র উৎস পুকুরগুলোর সবই নোনা পানিতে নিমজ্জিত।’</p> <p style="text-align: justify;">সংকট কাটানোর উপায় হিসেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবন অঞ্চলে সুপেয় পানির প্রাকৃতিক আধার পুকুর ও জলাশয়গুলো শ্যালো মেশিন দিয়ে নোনা পানিমুক্ত করতে হবে। এরপর বৃষ্টির পানি জমে সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে। একইভাবে সুন্দরবনে বন্য প্রাণীর জন্য সুপেয় পানির আধার সৃষ্টি করতে হবে। পূর্বপ্রস্তুতি নিলে জুন-জুলাই (বর্ষা মৌসুম) মাসে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে লবণাক্ততা কমে যাবে।’</p> <p style="text-align: justify;">জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আকমল হোসেন জানান, বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তাঁরাও বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছেন। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটও দেওয়া হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে বিশুদ্ধ পানির সংকট কেটে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।</p> </article>