<p>ইসমাঈল হোসেন হীরা ও ময়না বেগমের বিয়ে হয় ৯ বছর আগে। বিয়ের এক বছরেই দম্পতির ঘর এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এরপর তাদের সঙ্গে পরিবারের মানুষদেরও বড় শখ ছিল এক কন্যা সন্তানের। যে মেয়ে মা-বাবা স্বজনদের কোলে-কোলে বড় হবে। একটু বড় হয়ে নূপুর পায়ে রুমঝুমিয়ে ঘুরে বেড়াবে সারা বাড়ি। ছোটাছুটিতে ক্লান্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে মায়ের কোলে। পরম মমতায় মা কোলে নিয়ে আদর করবেন। তবে সেই মেয়ের আশা তাদের পূরণ হচ্ছিল না। দীর্ঘ ৮ বছর অপেক্ষার পর অবশেষে সেই কন্যা সন্তান তাদের পরিবারে এসেছে। তবে তার জন্মের সময়ই শিশুটি হারিয়েছে তার মাকে। ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার কারণে ফুটফুটে শিশুটি তার মাকে হারিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা। </p> <p>এ ঘটনা ঘটে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে যশোর শহরের জেল রোডের বেসরকারি বন্ধন হাসপাতাল এন্ড ডায়াগস্টিক সেন্টারে। এ ঘটনায় রোগীর অস্ত্রোপচারকারী ডাক্তার পরিতোষ কুমার কুন্ডু ও হাসপাতালের ম্যানেজার আকরামুজ্জামানকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। </p> <p>যশোর পালবাড়ি মোড় গাজীরঘাট এলাকায় মৃত ময়না বেগমের বাড়িতে শুক্রবার দুপুরে যেয়ে দেখা যায়। বাড়িতে ভীড় করেছে এলাকার মানুষ। সবার চোখে মুখে বেদনার ছায়া। মৃত ময়নার মা ফজিলা বেগম হাউমাউ করে কাঁদছেন। তিনি বিলাপ করে বলছেন। ‘ডাক্তারের কারণে আমার মেয়েকে হারালাম। এখন কে আমার নাতনিকে আদর করবে? কে শিশুটিকে দুধ খাওয়াবে। পাশেই ময়নার খালাতো বোন রাবেয়ার কোলে চাঁদের মতো ফুটফুটে একদিনের শিশুটি মাঝে মাঝে দু-তিন সেকেন্ডের জন্য পিট পিট করে চোখ মেলে দেখছে। আবার চোখ বুঝে ঘুমাচ্ছে। যেখানে নিরাপদ মায়ের কোলে বসে তার পান করার কথা ছিল মায়ের বুকের দুধ। পরিবর্তে তাকে ফিডারে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন রাবেয়া। এসব দৃশ্য আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ।</p> <p>মৃত প্রসূতি হলেন- যশোর শহরের পালবাড়ি গাজিরঘাট এলাকার ইসমাইল হোসেন হীরার স্ত্রী ময়না বেগম (২৬)।</p> <p>নিহতের স্বামী ইসমাইল হোসেন আজ শুক্রবার দুপুরে বলেন, ‘মেহরাজ নামে আমাদের ৮ বছর বয়সি একটা ছেলে আছে। এরপর আমাদের দুজনের বড় শখ ছিল একটা মেয়ের। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ময়নার (স্ত্রী) পেটে সন্তান আসার ৪ মাস পর আল্ট্রাসনো করে জানতে পারি এবারের সন্তানটি মেয়ে। তারপর থেকে আমাদের খুশির সীমা ছিল না। এমনকি আমার স্ত্রী বাপের বাড়ি খাজুরায় যেত না রাস্তা খারাপ বলে। যদি পেটের মেয়ের কোনো অসুবিধা হয় এই ভয়ে। অথচ ডাক্তারের ভুলের কারণে আমার স্ত্রী মারা গেল। আমার সন্তানরা এতিম হলো। আমি এর বিচার চাই। ’ </p> <p>নিহতের ভাই শিমুল পারভেজ বলেন, ‘সন্তানসম্ভবা আমার বোনের ব্যথা ওঠায় বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় যশোর শহরের বেসরকারি হাসপাতাল কুইন্স হসপিটালে নিয়ে যাই। সেখানে যাওয়ার পর কুইন্স হসপিটালের নার্স সুরাইয়া আমাদের জানায় পাশের বন্ধন হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঢাকা থেকে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ এসেছেন। তার কাছে গেলে ভালো হবে। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তাকে বন্ধনে নিয়ে যাই। সেখানকার ডাক্তার পরিতোষ কুমার কুন্ডু আমাদের জানান, রোগীর অবস্থা ভালো না, এই মুহূর্তে তার সিজার করা লাগবে।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘আল্ট্রাসনো অনুযায়ী ডেলিভারি ডেট আরো তিনদিন বাকি ছিল। কিন্তু ডাক্তার নতুন করে কোনো আল্ট্রাসনো কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই আমার বোনকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওটিতে নিয়ে যান। এমনকী তিনি আমাদের কারো কাছ থেকে কোনো প্রকার বন্ড সইও করাননি। সিজার করেই ডাক্তার বেরিয়ে চলে যান। ২০-২৫ মিনিট পরেই বোনের খিঁচুনি ওঠে এবং তিনি মারা যান। এ সময় আমার বোনের খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল। অক্সিজেন দিতে বললে তারা আমার বোনকে কোনো অক্সিজেনও দেননি। এমনকি তাদের অক্সিজেনও ছিল না। অথচ আমার বোনের শ্বাসকষ্টের সমস্যার কথা আমরা অপারেশনের আগেই ডাক্তারকে জানিয়েছিলাম।’ </p> <p>তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘সিজারশেষে আমার বোনের অবস্থা যখন খুব খারাপ তখন নার্সরা আমাদের রক্ত সংগ্রহ করতে বলেন। এক ব্যাগ রক্ত আনা হয়। পরে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নার্সরা আরো কয়েকটি ইনজেকশন এবং রক্ত আনার কথা বলেন। কিন্তু সেই সময় আমার দুলাভাই বোনের হাত-বুক পরীক্ষা করে দেখেন, তিনি আর বেঁচে নেই। কিন্তু হাসপাতালের নার্স ও কর্মীরা মৃত অবস্থায় বোনের শরীরে ইনজেকশন দেয়। এমনকী তাকে খুলনায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তারা ৩-৪ মিনিটের মধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্সও ম্যানেজ করে ফেলে। তখন আমরা বিষয়টি কোতোয়ালি পুলিশকে জানাই।’</p> <p>এ ব্যাপারে কোতয়ালী থানা হেফাজতে থাকা ডাক্তার পরিতোষ কুন্ড বলেন, ‘রাত ১০টার দিকে সিজার করা হয়। সুন্দরভাবে সিজার হয়েছে। এতে কোনো সমস্যা হয়নি। অপারেশনের পর সেলাই করে দিয়ে আমি চলে গেছি। এরপর তাকে পরিষ্কার করে বেডে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আমাকে হাসপাতাল থেকে রোগীর অবস্থা খারাপ বলে ফোন দেওয়া হয়। আমি ইমার্জেন্সি কিছু ড্রাগ ব্যবহারের কথা বলে দিই। আমাদের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার ওখানেই থাকে। সেও রোগীর কাছে আসে। আমিও আসি। আমরা চেষ্টা করেছি। যা করণীয় তা  করেছি। তার কিছুক্ষণ পর রোগী মারা যায়। আট বছর বয়সী ওনার একটা বাচ্চা আছে। আর ৮ বছর পর দ্বিতীয় সন্তান। এটা বিরাট গ্যাপ। আর উনি মারা গেছে শ্বাসকষ্টের কারণে। রোগীর যে শ্বাসকষ্ট ছিল সে কথা রোগীর স্বজনরা আগে জানায়নি। তাই শ্বাসকষ্টের কারণে তিনি মারা গেছেন।’ </p> <p>এ বিষয়ে যশোর কোতয়ালী থানার ওসি তদন্ত তাসমীম আলম শুক্রবার দুপুরে জানান, ‘রাতে উত্তেজনা হচ্ছিল। আমরা ডাক্তার ও ম্যানেজারকে আমাদের হেফাজতে নিয়ে আসি। যদি ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ দেন তাহলে মামলা হবে।’</p>