<p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ষাটের দশকের স্বতন্ত্র স্বরের কবি মাকিদ হায়দার। বেশ প্রস্তুতি নিয়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। রোদে ভিজে তাঁর আর বাড়ি ফেরা হবে না। বেশ কিছু দিন ধরে নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতায় ঘরে-বাইরে তিনি অস্বস্তিকর সময় যাপন করেছেন। মাঝে মাঝে টেলিফোনে আমাদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয় গত বছরের নভেম্বর মাসে বগুড়া লেখকচক্র আয়োজিত সাহিত্য উৎসবে। দেখে মনে হয়, তাঁর শরীর খুব একটা ভালো নেই।  আমি তাঁকে রীতিমতো বকাবকি করেছি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে বগুড়া সাহিত্য উৎসবে আসা ঠিক হয়নি। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলেছিলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">না রে! আর আসতে পারব না বোধ হয়।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> মনে পড়ছে, সেবার খুব একটা আড্ডা হয়নি তাঁর সঙ্গে। বেশ কিছু দিন ধরে তাঁর কোনো খবরাখবর পাচ্ছিলাম না। গত মে মাসে রাজশাহী লেখক পরিষদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত দুই দিনব্যাপী </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">-এ প্রধান অতিথি হিসেবে আমি অংশগ্রহণ করেছি। এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমি যখনই রাজশাহী গিয়েছি, রাতে বা দিনে একবার অবশ্যই আমাকে আরিফ হায়দারের বাসায় যেতে হয় আরিফপত্নী ছোট বোন কবিতার ডাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আরিফ এসে অনেকটা জোর করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত তার নতুন বাসায় নিয়ে যায়। আমার সঙ্গে ছিলেন কবি মজিদ মাহমুদ। দুপুরের আহার খেতে খেতে আমরা কথা বলছিলাম মাকিদ ভাইকে নিয়ে। রাজশাহীতে সাহিত্য উৎসব হচ্ছে, সেই উৎসবে কবি মাকিদ হায়দার নেই</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তা কী করে হয়! আরিফ বলল, ভাড়া বাসা ছেড়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষিত ডুপ্লেক্সে উঠেছি শুনে খুব খুশি হয়েছেন; সপরিবারে বেড়াতে আসবেন বলেছেন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শরীরের যে অবস্থা, হয়তো আসতে পারবেন না। তখনই মনস্থির করেছিলাম, ঢাকায় ফিরে আমি ও আমার স্ত্রী তাঁকে দেখতে যাব উত্তরায় তাঁর বাড়িতে। কিন্তু যাব যাব করেও আর যাওয়া হলো না। প্রতি ঈদে যে কজন প্রিয় মানুষের সঙ্গে সরাসরি কিংবা টেলিফোনে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করি তাঁদেরই একজন কবি মাকিদ হায়দার</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের সম্পর্কের বয়স প্রায় ৪৫ বছর। তাঁর অগ্রজ কবি-নাট্যকার অধ্যাপক জিয়া হায়দার ছিলেন আমার শিক্ষক। জিয়া স্যারই নাকি আমার কবিতা নিয়ে মাকিদ ভাইকে বলেছিলেন। সেই সুবাদে আমার সঙ্গে হায়দার পরিবারের সবার সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্ক কত যে নিবিড় ও অন্তরঙ্গ তা এককথায় বোঝাতে পারব না। তাঁর এই চলে যাওয়া বাংলা কবিতায় কতখানি শূন্যতা সৃষ্টি করছে তা কবিতার বোদ্ধা পাঠক ও সমালোচকরাই বলতে পারবেন। আমার ভেতরে সকাল ১০টা ১০ মিনিট থেকে এক দীর্ঘতর শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে জেগে মোবাইলে দেখতে পাই সহোদরতুল্য আরিফ হায়দারের দুটি মিস কল। সময় সাড়ে ৯টা। সাইলেন্ট মুডে থাকায় শুনতে পাইনি। এত সকালে আরিফ তো কখনো কল করে না! আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে শুয়ে শুয়ে আরিফকে কল দিতেই শুনতে পেলাম দুঃসহ দুঃসংবাদটি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মাকিদ ভাই নাই, আজ সকালে চলে গেছেন। এখন বর্ষাকাল। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, কিন্তু বৃষ্টি নেই। আমার মনে হলো, আকাশের সব মেঘ আমার হৃদয়ে এসে জমা হয়েছে এবং সেই মেঘমণ্ডল আমার অপ্রকাশ্য কান্নাগুলো ধরে আছে। আরিফের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে ফোন করলাম বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ভাইকে। হুদা ভাই খবরটি আগেই পেয়েছেন। বললেন, পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে কবির মরদেহ একাডেমির নজরুল মঞ্চে আনা হবে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর জন্য। কবি মাকিদ হায়দার কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। রেওয়াজ অনুযায়ী তিনি বাংলা একাডেমির একজন ফেলো। এই ক্যাটাগরির ফেলোদের মরদেহে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায়ি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়। বাংলা একাডেমির পরিচালক কবি সরকার আমিন ফোন করে জানালেন, দুপুর ২টা থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত কবির মরদেহ বাংলা একাডেমিতে রাখা হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের অনলাইনে খবর ছড়িয়ে পড়ে। আমিও মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকি। তার আগে আরেকটি তথ্য দিতে চাই। আরিফের কাছ থেকে খবর পাওয়ার পর জাহিদ হায়দারের সঙ্গে কথা বলা দরকার বলে মনে করি। জাহিদকে কোনোভাবেই ফোনে পাচ্ছিলাম না। মনে পড়ল দাউদ ভাইয়ের কথা। কবি দাউদ হায়দার</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাংলাদেশের একজন নির্বাসিত কবি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে আছেন। তিনি  মাকিদ ভাইয়ের ছোট ভাই। আমার খুব প্রিয় একজন কবি। তখন সকাল ১১টা ২০ মিনিট। দাউদ ভাইকে ফোন দিতেই ও প্রান্ত থেকে ক্ষণে ক্ষণে তাঁর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমি তো বহু দূরে! এই ভাইকেও বিদায় জানাতে পারলাম না। জিয়া ভাই (জিয়া হায়দার), রশীদ ভাই (রশীদ হায়দার)</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এঁরাও চলে গেলন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেখতে পাইনি।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> আবার কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দূরে থাকলও আপনি সবার কাছে আছেন। আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনি ভেঙে পড়লে এখানে যাঁরা আছেন তাঁদের কষ্ট ও বেদনা আরো বেড়ে যাবে।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শুধু কবি হিসেবে নয়, তাঁকে আমি দেখেছি অসামান্য গুণাবলিসম্পন্ন একজন চমৎকার নির্মল চরিত্রের মানুষ হিসেবে। তাঁর তুলনা তিনি নিজে। কবিদের মধ্যে সচরাচর নেতিবাচক যেসব দোষ খুঁজে পাওয়া যায় তিনি বরাবরই সেসবের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাঁর একটা বড় গুণ, তিনি সহজেই তরুণ কবি ও লেখককে কাছে টানতে পারতেন। বয়সের ব্যবধান ভুলে গিয়ে মিশে যেতে পারতেন। বহু জায়গায় কবিতা বা সাহিত্য উৎসবে আমরা একসঙ্গে অংশ নিয়েছি। দেখেছি তাঁকে ঘিরে তরুণদের কী আন্তরিক উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা! নিজের কবিতা সম্পর্কে নির্মোহ নীরবতা পালন করতে তিনি। কে বড় কে ছোট কবি, কার কী দোষ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এসব নিয়ে নিজ মুখে কারো নিন্দা করতে দেখিনি। অন্যের প্রশংসা করে কী যে আনন্দিত হতেন!</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমার মন ভালো নেই</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আর কোনো দিন সেই প্রসন্ন মুখ আর দেখব না। আমার কাছে উত্তরা মানে মাকিদ হায়দার। কতবার ভেবেছি সপরিবারে তাঁর বাড়িতে একদিন বেড়াতে যাব। আমরা দুজন গিয়েছি। সারা দিন ছিলাম। কী যে আনন্দ পেয়েছিলাম! তিনিও খুব খুশি হয়েছিলেন।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আজ মনে পড়ছে একদিনের স্মৃতি। আমি রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনারের দায়িত্ব পালনের সময়। রশীদ ভাই ও মাকিদ ভাই দুজনে পরামর্শ করে তাঁদের পাবনা শহরের পৈতৃক বাড়িতে আমাদের সম্মানে একটি পারিবারিক মিলনমেলা বসিয়েছিলেন। উপলক্ষ পাবনা পৌরসভা তাঁদের বাড়ির সামনের সড়কটির নাম রেখেছে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">জিয়া হায়দার সড়ক</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">। উনাদের অভিমত, এ ক্ষেত্রে আমার জোরালো ভূমিকা না থাকলে সম্ভব হতো না। এটি আসলে ঠিক নয়, জিয়া হায়দারের মতো এমন গর্বিত সন্তান পাবনা শহরে খুব কি বেশি আছে? না, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে হায়দার পরিবারের সমকক্ষ আর কোনো পরিবার অন্তত আমার চোখে পড়েনি।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মাকিদ ভাই! রোদে ভিজে বাড়ি না ফিরে আমাদের চোখের জলে ভিজে আপনি এখন মায়ের বুকে ঘুমিয়ে থাকুন আপনার প্রিয় রোকনালির দোহারপাড়ায়।</span></span></span></span></span></p>