<div> বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করা আবার তাকে ছেড়ে দেওয়া, জুয়াড়ি না হলেও জুয়াড়ি বানানো, ব্যবসা না করলেও মাদক ব্যবসায়ী বানানো। অপরাধী কিংবা নিরাপরাধীদের কাছ থেকে কৌশলে অর্থ আদায়ে পটু। এলাকার জনসাধারণের কাছে আইজিপি'র 'বিশেষ ক্ষমতা' রয়েছে তার, এভাবে মিথ্যা প্রচার করা। ওইসব কর্মকাণ্ড ও মানুষ ধোকা দেওয়া যার কাছে মামুলি একটা বিষয়। তিনি এএসআই (সহকারি উপ-পরিদর্শক) পদের ফারুক হোসেন। কুড়িগ্রামের রৌমারী থানায় কর্মরত আছেন তিনি। তাকে নিয়ে জনসাধারণের মাঝে যেমন তীব্র ক্ষোভ সমালোচনা হচ্ছে তেমনি থানা পুলিশের মাঝেও দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ।<br /> 'বিশেষ ক্ষমতাধর' ওই ফারুক হোসেনের রেকর্ড ফাইল খুঁজে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা ভয়াবহ। এর আগে ওই এএসআই একই জেলার ফুলবাড়ি থানায় চাকরি করা অবস্থায় নানা অপকর্মের কারণে ফুলবাড়ি উপজেলার জনতার হাতে ধোলাই হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা গাঁজা গোপনে বিক্রি করে ওই ফারুক হোসেন। তার বিরুদ্ধে ফেন্সিডিল বিক্রি করারও অভিযোগ আছে। বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে মার ও ধাওয়া খাওয়ার ঘটনাও খুব বেশি আগের ঘটনা নয় গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসের। সীমাহীন অপকর্মের কারণে ওই ফারুক হোসেনকে স্টান্ড রিলিজ করে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে রৌমারী থানায় বদলি করে দেওয়া হয়। রৌমারীতে যোগদান করেই তিনি এলাকায় ঘোষণা দেন আইজিপির 'বিশেষ ক্ষমতা' নিয়ে এসেছেন রৌমারীকে মাদকমুক্ত করতে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনায় মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা গ্রহণ করেন আর যারা সেবন করেন তাদেরকে গ্রেপ্তার করেন।<br /> নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রৌমারী থানার এক এসআই (উপ-পরিদর্শক) জানান, থানায় যত অভিযোগ আসে সব অভিযোগের তদন্ত করানো হয় এএসআই ফারুক হোসেনকে দিয়ে। অথচ একজন এএসআইর কোনো মামলার তদন্ত করার ক্ষমতা নেই। অর্থ আদায়ে পারদর্শির কারণে ওসি স্যার তাকে দিয়ে প্রথমে তদন্ত করান আর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে লেখানো হয় এসআইদের। এ নিয়ে থানা পুলিশের মাঝে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।<br /> <strong>২০ ফেব্রুয়ারি : </strong>রাত পৌনে ১১টার দিকে রৌমারী থেকে প্রকাশিত মাসিক 'উত্তর চিত্র' পত্রিকার কার্যালয় (রৌমারী ইসলামী ব্যাংকের নিচতলায়) সংবাদ সংক্রান্ত কাজ করা অবস্থায় পত্রিকার বার্তা সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সাজুকে আটক করে পুলিশ। এসময় ওই ফারুক হোসেন তার ব্যাগ থেকে মদের বোতল বের করে প্রথমে সাংবাদিকের মুখে এবং পরে তার শরীরে মদ ঢেলে দেয়। এরপর মদপানের অভিযোগ তুলে সাংবাদিকের দু'হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে টেনেহিচরে বের করা হয়। এসময় হ্যান্ডকাপ পড়া অবস্থায় সাংবাদিককে জনতার সম্মুখে প্রদর্শন করার সময় চড়থাপ্পর ও লাথি মারার ঘটনা ঘটায় পুলিশ।<br /> রৌমারী থানা পুলিশের বিরুদ্ধে নিরাপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বাণিজ্য এবং মাদক-জুয়ায় পুলিশের চাঁদাবাজির একাধিক সংবাদ প্রকাশ করার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ ওই নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দেয়। ওই ঘটনায় সাড়া কুড়িগ্রামের সাংবাদিকদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।<br /> <strong>১ <strong>ফেব্রুয়ারি : </strong></strong>উপজেলার যাদুরচর চাকতাবাড়ি গ্রামের কৃষক আব্দুস সবুরের পুত্র কলেজ ছাত্র শাহাদত হোসেনকে বিনা কারণে আটক ও নির্যাতন করার ঘটনা ঘটায় ওই একই ব্যক্তি ফারুক হোসেন। প্রায় ১২ ঘণ্টা থানা হাজতে আটকে রাখার পর কোনো অভিযোগ না পাওয়ার কারণে কলেজছাত্রকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তবে মজার কাণ্ড করে ওই এএসআই ফারুক। কলেজ ছাত্রের পিতার কাছ থেকে নগদ ৩ হাজার টাকা এবং গোল্ডলিফ সিগারেট প্যাকেট আদায় করে এলাকায় হুলস্থুল ফেলে দেয়।<br /> <strong>২০ জানুয়ারি : </strong>ওই রাতে প্রথমে উপজেলার নটানপাড়া গ্রামের ভ্যান চালক হাফিজুর রহমানকে (২২) আটক করে থানায় আনে ওই দারোগা। অভিযোগ আনা হয় সে মাদক ব্যবসা করে। কিন্তু ওই ভ্যান গাড়িচালক নিরাপরাধ কোনো মাদক ব্যবসা করে না। এমন যুক্তি সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও এলাকাবাসী সাংবাদিকদের জানান। এ অবস্থায় ওই এএসআই ফারুক হোসেন গ্রেপ্তারকৃতের বড় ভাই শাহীন আলমকে থানায় ডেকে নিয়ে ৫ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিলে মামলা এখানেই শেষ করে দেওয়া হবে। আর টাকা না দিলে তাকে কুড়িগ্রাম আদালতে প্রেরণ করা হবে। কোনো উপায় না পেয়ে শাহীন আলম তার ভাইয়ের জন্য ৫ হাজার টাকা তুলে দেন এএসআই ফারুক হোসেনের হাতে।<br /> একইদিন রাত ১১টার দিকে উপজেলার ইটালুকান্দা এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী আব্দুস ছাত্তারকে গ্রেপ্তার করেন ওই ফারুক হোসেন। এরপর রাতভর দেন-দরবার করে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ইটালুকান্দা গ্রামের মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলও করে। এনিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করা হলে ফারুক ভ্যানচালক হাফিজুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে ঘুষের ৫ হাজার টাকা ফেরত দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক জানান, আমরা জানতে পেরেছি ভ্যানচালক হাফিজুর মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল না। টাকা ফেরত দেওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।<br /> <strong>১২ জানুয়ারি : </strong>উপজেলার ছাটকড়াইবাড়ি গ্রামের একটি বাড়িতে তাস খেলা অবস্থা ৬ জন গ্রামবাসীকে জুয়াড়ি হিসেবে গ্রেপ্তার করেন ওই এএসআই। এরপর ৬ জনের কাছ থেকে জনপ্রতি ৩ হাজার করে ১৮ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। তারপর ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করে প্রত্যেককে ১শ' টাকা করে জরিমানা আদায় করে ছেড়ে দেয় আদালত। তারা হলেন ছাটকরাই বাড়ি গ্রামের সওদাগর আলী (৫৩), মনিরুজ্জামান (৩৮), ইন্তাজ আলী (৫৫), ইউনুছ আলী (৪৪), আজিজুর রহমান (২৭) ও সাইদুর রহমান (২৮)।<br /> <strong>৯ জানুয়ারি :  </strong>উপজেলার সায়েদাবাদ বাজারের একটি ঘর থেকে ভ্যান ও রিক্সা চালক ফারুক হোসেন (৩২), আশরাফুল ইসলাম (৩০), জিনাত আলী (৩৬), কামাল হোসেন (৪০), আব্দুল কাদের (৪৫), ইউছুফ আলী (৪৮) ও আব্দুর রহিম (৩০) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এদের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করার অভিযোগ করা হয়। এতেও ওই ফারুকের নাম ওঠে।<br /> <strong>পুলিশের বক্তব্য :</strong> অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত এএসআই ফারুক হোসেন সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'আমার মতাে কেউ থানার কোনো মাঠে দৌড়ায় না। আমাকে পাঠানো হয়েছে মাদকমুক্ত করার জন্য। আর সে হিসেবে আমি কাজ করছি আমাকে দেখে সবাই ভয় পায়।' আইজিপির 'বিশেষ ক্ষমতা' প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বিষয়টি আমাকে রাখতে বলা আছে।' একই প্রসঙ্গে ওসি সোহরাব হোসেন বলেন, 'ফারুকের ওই ক্ষমতা প্রসঙ্গে আমি কিছুই জানি না। আমার অনুমতি না নিয়ে সে বাইরে কোথাও যেতে পারবে না।'</div>