<article> <p style="text-align: justify;">লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানাল, দেশজুড়ে গড় ভোট পড়েছে ৬১ শতাংশ। দেশের ১৩টি রাজ্যে ৮৮টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। এ ছাড়া এ দফায় কেরলের সব কটি আসনে আর রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশের একটি বড়সংখ্যক আসনে ভোট হয়েছিল।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তবে হিন্দি বলয়ের রাজ্য উত্তর প্রদেশ-মধ্য প্রদেশে ভোটের হার কিন্তু বেশ কম। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বিশ্লেষণ এবং সমীক্ষা করতে বসেছেন যে কেন এই ভোটের হার কম হলো? কারণ এই রাজ্যগুলো বিজেপির সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি।</p> <p style="text-align: justify;">২৬ এপ্রিল শুক্রবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুসারে উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশে যথাক্রমে ৫২.৭৪ ও ৫৪.৮৩ শতাংশ ভোট পড়ে। মহারাষ্ট্রেও কম ভোট পড়েছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সেখানে ভোট পড়েছে ৫৫ শতাংশ। এই মহারাষ্ট্রেই উদ্ভব ঠাকরের জোট সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন শিন্ডে। দ্বিতীয় দফায়ও মণিপুরে ভালো সাড়া মিলেছে। মণিপুরে ভোট পড়েছে প্রায় ৭৬.০৬ শতাংশ।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">রাজস্থানে ৫৯.১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। কেরলের ২০টি আসন, কর্ণাটকের ১৪টি আসন, রাজস্থানের ১৩টি আসন, মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশের আটটি আসন, মধ্য প্রদেশের সাতটি আসন, আসাম ও বিহারের পাঁচটি করে আসন, বাংলা ও ছত্তিশগড়ে তিনটি করে আসন, জম্মু-কাশ্মীর, মণিপুর ও ত্রিপুরায় একটি করে আসনে ভোট হয়ে গেল।</p> <p style="text-align: justify;">দ্বিতীয় দফা শেষ হতেই কেরল, ত্রিপুরা ও রাজস্থানের ভোট পর্ব শেষ হয়ে গেল। তাহলে প্রথম দফার মতো দ্বিতীয় দফায়ও বিহারে কিন্তু ভোটের হার খুব কম। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ত্রিপুরায়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সেখানে ভোট পড়েছে ৭৭.৫৩ শতাংশ। জম্মু-কাশ্মীরে ৬৭.২২ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে উত্তর প্রদেশে সব থেকে কম ভোট পড়া নিয়ে নানা দিক থেকে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি বিরোধীরা কটাক্ষও করতে শুরু করে দিয়েছেন যে অযোধ্যায় বিরাট রামমন্দির তৈরি করে, এত জোর প্রচার চালিয়ে এত কম ভোট কেন পড়ল? ২৬৬টি আসনে এবার ভোট কম পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশনই জানাচ্ছে। ২১৫টি গ্রামীণ আসন আর ৫১টি শহুরে আসন। এখন প্রচণ্ড গরমের জন্যও মানুষ ভোট দিচ্ছে না, এমনও হতে পারে। আবার মানুষের একটা অনীহা এসেছে ভোট নিয়ে, এটাও অনেকে বলছে। বিশেষ করে নতুন ভোটারদের জন্য এত প্রচার করার পরও কিন্তু তারা খুব একটা ভোট দিতে এগিয়ে আসছে না। ভোট দেওয়া থেকে তারা বিরত থাকছে। আর ‘নোটা’ যাতে মানুষ না দেয়, মানে কারোরই হয়ে ভোট না দেওয়া, এটাকে NOTA বলা হয়, সেটাও কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে। নোটার জন্যও যে বিরাটসংখ্যক মানুষ এসে ভোট দিচ্ছে, তা নয়। আসলে তারা ভোটের প্রক্রিয়ায়ই শামিল হচ্ছে না। এই অনীহাটা ভারতের মতো একটা বৃহৎ গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়।</p> <p style="text-align: justify;">উত্তর প্রদেশে বিশেষ করে, যেখানে রামমন্দিরের পর ঢেলে ভোট হওয়ার কথা, সেখানে ভোট কম হওয়াটা নিশ্চয়ই একটা প্রশ্ন তৈরি করেছে। দ্বিতীয় দফায় ৮৯ আসনে ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টির একজন প্রার্থীর মৃত্যুর পর মধ্য প্রদেশের বেতুলে ভোটের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ৭ মে তৃতীয় দফায় ভোট হবে বেতুলে। দ্বিতীয় দফায় হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যার মধ্যে আছেন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী, কেসি বেনু গোপাল, অশোক গেহলাতের পুত্র বৈভব গেহলাত—এ রকম অনেকেই আছেন। কিন্তু ২০১৯ সালে বিজেপি কর্ণাটকে ২৮টি লোকসভা আসনের বোধ হয় ২৫টি পেয়েছিল।</p> <p style="text-align: justify;">কংগ্রেস গত বিধানসভা নির্বাচনে ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছে। এখন অনেকে বলছে যে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে এবার বিজেপি বেশি আসন পাওয়ার চেষ্টা করলেও নরেন্দ্র মোদি প্রচণ্ড চেষ্টা করেছেন, প্রচুর প্রচার করেছেন। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কেরলে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি ওয়ানাড। এই আসনে প্রার্থী কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী। বিরোধীদের কাছে কিন্তু কেরল একটা বড় আশার আলো, যদিও বাম এবং কংগ্রেস দক্ষিণের এই রাজ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তবু এখানে বিজেপির যে বিপুল জয়ের সম্ভাবনা, সেটাও কিন্তু মনে হচ্ছে না। ২০১৯ সালে ৩০৩টি আসনে বিজেপি জিতেছিল। তার বেশির ভাগই ছিল হিন্দি বলয়, যদিও কংগ্রেস দাবি করেছে যে এবার তারা ২০১৯ সালের তুলনায় অনেক ভালো পারফরম্যান্স দেখাবে, বিশেষ করে রাজস্থান ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশে।</p> <p style="text-align: justify;">পশ্চিম উত্তর প্রদেশে ভোটারদের একটা বড় অংশ হলো কৃষিজীবী এবং জাঠ। এবার যেহেতু হিন্দি বলয়ের অনেকগুলো আসনে ভোট হচ্ছে, তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবার সরাসরি হিন্দুত্বের লাইনে প্রচার করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, এবার হিন্দু ও মুসলিম পরিচয়ের এই মেরুকরণ চূড়ান্ত জায়গায় চলে গেছে।</p> <p style="text-align: justify;">প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের সব সম্পদ তারা মুসলিমদের হাতে তুলে দেবে। মহিলাদের মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত ছাড়বে না। এই ধরনের প্রচারের জন্য এটাকে ‘হেট স্পিচ’ বলে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনের কাছে নালিশ পর্যন্ত জানিয়েছে। যে দলটা ৫৫ বছর ধরে দেশে ক্ষমতায় ছিল, তাদের শাসনামলে জনগণ তাদের সম্পদ এবং মঙ্গলসূত্রের জন্য ভয় পেয়েছিল—এই অভিযোগ নিয়ে আসার মানেই হলো, মেরুকরণের পথ আরো প্রশস্ত করা। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এখন যে ইস্যুতে ভোট হচ্ছে দেশে, তা হলো হিন্দুস্তান কা মুসলমান। একে তো ভারতে কমবেশি ৮০০ বছর ধরে মুসলিম শাসন হয়েছে। এই রাজত্বে হিন্দুরাও সমানভাবে সেখানে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি আওরঙ্গজেবসহ মোগল শাসকদের সেনাপতিদেরও অনেকে রাজপুত হিন্দু ছিলেন। আর মুসলিম শাসনে হিন্দুদের কখনোই দেশের খতরনাক সমস্যা হিসেবেও ভাবা হয়নি। দেশের প্রধানমন্ত্রী জনাবে আলা নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি হিন্দুদের কাছে, তারা যেই গোত্রের বা জাতপাতেরই অন্তর্গত হোক না কেন, মুসলিমদের ইস্যু বানিয়ে ভোট চাইছেন। তাঁর দোসর ভাই অমিত শাহও পিছিয়ে নেই। মোদিজির পথ অনুসরণ করে তিনিও মুসলিমদেরই প্রধান ইস্যু হিসেবে প্রচার করছেন। </p> <p style="text-align: justify;">বিজেপির এই রণকৌশলটার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। গুজরাটে যখন মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা হয়েছিল, তখন সেখানেও এই রকম প্রচার হয়েছিল। মুসলিমদের কিভাবে গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত করা হচ্ছে, সেটা আজকে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে বিজেপির বিভিন্ন প্রচারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজে ‘মুসলিম’ শব্দটা খুব একটা ব্যবহার করতেন না। এবারও তিনি বলেছেন, ভোট ব্যাংক, মা-বোনদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন। এর ফলে এগুলো মস্ত বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে এবারের ভোট প্রচারে।</p> <p style="text-align: justify;">গোটা দেশে এখনো চার দফায় ভোট বাকি। পশ্চিমবঙ্গে সাত দফার ভোট শেষ হবে ১ জুন। ভোটের ফল বেরোবে ৪ জুন। কিন্তু এই বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে সুদীর্ঘ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গোটা পৃথিবীর নজর রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও মালদ্বীপ। এসব রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভবিষ্যৎও নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সর্বোপরি চীনের মতো রাষ্ট্র নজর রেখেছে ভারতের নির্বাচনী গতি-প্রকৃতির দিকে। কিন্তু ভারতের বহুত্ববাদী সহিষ্ণু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চরিত্র কোনোভাবে সমস্যায় পড়বে, সেটা আর যা-ই হোক, সুস্থ স্বাভাবিক ভারতীয় কোনো নাগরিকই চাইতে পারেন না।</p> <p style="text-align: justify;"><b>লেখক : নয়াদিল্লিতে</b> কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি</p> </article>