<p>আপনারা নিশ্চয় অনেক মানুষকে অসংলগ্ন আচরণ করতে দেখেছেন। বিভিন্ন মুভি-উপন্যাসে হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন শব্দগুলো ব্যবহার করতে দেখেছেন। কোনো অদৃশ্য কণ্ঠের আওয়াজ পেয়ে অমুক লোক রাস্তায় নেমে অসংখ্য মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলেছে, এমনটাও শুনে থাকবেন।</p> <p>কেউ কেউ কল্পনার জগতে এত বেশি সময় কাটায় যে তারা অদৃশ্য কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পায়। কেউ কেউ ভাবে, তাদের ওপর অশরীরী কোনো সত্তা মানবজাতিকে উদ্ধারের ভার ন্যস্ত করেছে। গায়েবি আওয়াজ পেয়ে তারা খুন থেকে শুরু করে আরও বিভিন্ন অপরাধ করে।<br /> এ প্রসঙ্গে রবার্ট ব্রচের বিখ্যাত উপন্যাস 'সাইকো' এর প্রসঙ্গ আনা যায়। এর ওপর বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এই উপন্যাসের অনুপ্রেরণা জোগায় একজন সত্যিকারের সিরিয়াল কিলার এড গেইন। শুধু সিরিয়াল কিলিংই নয়, স্থানীয় কবর থেকে মহিলাদের লাশ চুরি করে লাশের চামড়া ছাড়িয়ে বিভিন্ন সামগ্রী, লেদার জ্যাকেট পর্যন্ত তৈরি করতেন তিনি। চিকিৎসকেরা এড গেইনকে সিভিয়ার সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত মানসিক রোগী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তার সিজোফ্রেনিয়া বিকাশ লাভ করেছিল তার নার্সিসিস্টিক মায়ের কারণে।</p> <p>মানসিকভাবে অসুস্থ হিসেবে 'Insanity Defense' এ (বর্তমানে যা Mental Disorder Defense নামে পরিচিত) যোগ্য প্রমাণ হওয়ায় ১৯৫৭ সালে ধরা পড়ার পর তাকে কারাগারে না পাঠিয়ে মেন্টাল হেলথ ফ্যাসিলিটিতে পাঠানো হয়। সেখানে দীর্ঘ এগারো বছর অবস্থান করেন তিনি।</p> <p>১৯৬৮ সালে আদালতে পাঠানোর যোগ্য হন এড গেইন। কিন্তু বিচারক পরবর্তীতে আবার তাকে সাইকোটিক সিজোফ্রেনিয়ার কারণে কারাদণ্ড না দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করেন। সেখানেই ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৪ সালে তিনি মারা যান।<br /> সন্তান জন্মদানের পরে পোস্টপার্টাম সাইকোসিস পৃথিবীর সব দেশে প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। আপনারা যারা হুমায়ূন আহমেদের গল্প পড়েছেন, `জিন কফিল'—ছোটোগল্পে এ ধরনের একটি কেসের উদাহরণ দেখতে পাবেন। সন্তান জন্মদানের পর মস্তিষ্কে কিছু নিউরোকেমিক্যালের অসংগতির জন্য জন্মদান পরবর্তী সময়ে সিজোফ্রেনিয়া, হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন দেখা দেয়। কোনো অশরীরী আত্মা মায়েদের আদেশ দিচ্ছে বাচ্চাকে খুন করতে—খুব সাধারণভাবে এমনটা দেখা যায়।</p> <p>এ ধরনের কেস, মা হয়তো মা দেখতে সন্তানের শরীরে সাধারণ হাত-পায়ের বদলে দৈত্যের মতো বড় বড় নখরযুক্ত হাত-পা। বাচ্চা রাক্ষসে পরিণত হচ্ছে এমন কেসও পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে খুব সাধারণ।<br /> নিউরোটিক এবং সাইকোটিক বিভাগের মধ্যে প্রধান পার্থক্য নিউরোটিক ডিজঅর্ডারে একজন মানুষ বাস্তবতার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। সে জানে, কোনটা ঠিক এবং কোনটা ভুল। সে কোনো গায়েবি আওয়াজ শুনতে পায় না, কোনো অশরীরী আত্মাকেও দেখতে পায় না এবং কাল্পনিক বা ভ্রমের জগতেও বাস করে না।<br /> পক্ষান্তরে, সাইকোটিক ডিজঅর্ডারে মানুষ বাস্তব জগৎ এবং কাল্পনিক জগতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। সাইকোসিসের রোগীর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। রোগীর জেনেটিক ফ্যাক্টর, বিভিন্ন রকম মানসিক পীড়ন, হরমোন এবং মস্তিষ্কের অন্যান্য কেমিক্যালের অসামঞ্জস্য (ডোপামিন এবং সেরোটনিন) ইত্যাদি কারণে একজন মানুষ সাইকোটিক রোগীতে পরিণত হয়।<br /> একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে অসুস্থ হিসেবে অপরাধ করার পর মুক্তি পাবে নাকি আদালতে শাস্তি পাবে তা বের করার জন্য শুধু দুটি বিষয় মাথায় রাখবেন—<br /> অপরাধ যখন হচ্ছিল তখন অপরাধী ঠিক আর ভুলের পার্থক্য জানতো কিনা। কিংবা, অপরাধ সংঘটনের সময় অপরাধী বাস্তব জগতে নাকি ঘোর কোন কাল্পনিক জগতে থাকত।<br /> এই দুই শর্তের মাধ্যমেই নিরূপণ করা হয় একজন ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতার অজুহাতকে বাতিল করে কাঠগড়ায় তোলা সম্ভব কি না।</p> <p>লেখক: চিকিৎসক ও কথা সাহিত্যিক<br />  </p>
