মুসলিম গণহত্যা যদি স্রেফ রসিকতার ব্যাপার হয়ে থাকে, তাহলে পশ্চিমা মূল্যবোধের আলোকে গড়ে ওঠা নেটফ্লিক্স বসনিয়ার স্রেব্রেনিচা আর ফিলিস্তিনের গাজার গণহত্যা নিয়ে নির্দয় রসিকতা করে মোটেও ভুল করেনি। কারণ পশ্চিমারা সভ্যতার ডেফিনেশন নিয়ে পাঁয়তারা করে বেড়ালেও মুসলিম ইস্যুতে নাক সিঁটকাতে মোটেও ভুল করে না। নেটফ্লিক্স তো পশ্চিমা মূল্যবোধের বাইরে যেতে পারে না।
গণহত্যা অথবা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে একসময় পশ্চিম বিশ্বে ‘আর কখনো নয়’ উচ্চারিত হতো কাঁপতে থাকা নিপাট আন্তরিকতার সঙ্গে।
এই মন্ত্রটি ছিল অজাত প্রজন্মের কাছে পশ্চিমা প্রতিশ্রুতি : ‘গণহত্যার ভয়াবহতার আর কখনো পুনরাবৃত্তি হবে না।’ কিন্তু আজ ডিজিটাল প্রদর্শনী এবং রাজনৈতিক দায়মুক্তির যুগে ‘আর কখনো নয়’ মাঝে মাঝে ‘আবার কখনো’ হয়ে উঠেছে। এবং এই গ্রহবাসী স্মৃতির এক ভয়াবহ বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করছে।
ওয়ারশ ঘেটো আর স্রেব্রেনিচা থেকে গাজা পর্যন্ত গণহত্যার চিত্র, বিশেষ করে শিশুদের দুর্ভোগ—কেবল তার পবিত্রতাই হারায়নি, এটি উপহাস, কৌতুক এবং বিনোদনের সবচেয়ে নিন্দনীয় রূপে পরিণত হয়েছে।
এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং অমীমাংসিত ইতিহাস এবং অমীমাংসিত মূল কারণগুলো কিভাবে সহিংসতার প্রতি সংবেদনশীল এবং প্রদর্শনের জন্য ক্ষুধার্ত একটি সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তারই প্রতিফলন।
অসংবেদনশীলতার এক মর্মান্তিক প্রদর্শনীতে, ডাচ নেটফ্লিক্স কমেডি ‘ফুটবল প্যারেন্টসে’ এমন একটি দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যেখানে স্রেব্রেনিচা গণহত্যার শিকারদের তুলনা আনাড়ি শিশু ফুটবল খেলোয়াড়দের সঙ্গে করা হয়েছে, যা বসনিয়ান গণহত্যাকে একটি কৌতুকে পরিণত করেছে।
১৯৯৫ সালে ডাচ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে আট হাজারেরও বেশি বসনিয়ান মুসলিম পুরুষ ও ছেলেকে হত্যা করা হয়েছিল। ডাচ সেনারা কেবল গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ হয়নি, বরং এতে সক্রিয় অংশগ্রহণও করেছিল।
নেদারল্যান্ডস এই পৃথিবীতে তিনটি বড় গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত—হলোকস্ট, বসনিয়ান গণহত্যা এবং এখন গাজায় গণহত্যা।
গাজায় গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ডাচ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা করা হচ্ছে। এদিকে একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডাচ নাগরিক হলোকস্টে অংশ নিয়েছিল।
অস্বীকার কেবল একটি পরোক্ষ চিন্তা নয়, এটি গণহত্যা প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমনটি ইসরায়েলি টিকটক সেলিব্রিটিদের মধ্যে দেখা যায়, যারা গাজার ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য অনুদানের ভান করে ভাইরাল ‘প্রাংক’ ভিডিও তৈরি করে, অথচ আবেদনটিকে তারা একটি নিষ্ঠুর রসিকতা হিসেবে প্রকাশ করে।
প্রশ্ন হতে পারে, পশ্চিমারা মূল্যবোধের এই স্তরে কিভাবে এসে পৌঁছল? কঠিন সত্য হলো তারা কখনো গণহত্যার চেতনা থেকে সত্যিকার অর্থে দূরে সরে যায়নি বা যেতে পারেনি।
ইতিহাস বলছে, পশ্চিমাদের গালভরা ‘আর কখনো নয়’ শব্দবন্ধ বা আপ্তবাক্যটি বাস্তবে কখনো ছিল না। পশ্চিমারা তাদের দর্শন ও সংস্কৃতি থেকে বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ, অমানবিকীকরণ, সামরিকবাদের মূল কারণগুলো কখনো বাদ দিতে পারেনি। পরিবর্তে, হলোকস্টকে ইন্ধন জোগানো একই মতাদর্শগুলো নতুন সময়ে নতুন অভিব্যক্তি খুঁজে পায়, নতুন সংস্থাগুলোকে লক্ষ্য করে।
জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্ট্যান্টন গণহত্যার ১০টি ধাপের রূপরেখা দিয়েছেন—শ্রেণিবিভাগ, প্রতীকীকরণ, বৈষম্য, অমানবিকীকরণ, সংগঠন, মেরুকরণ, প্রস্তুতি, নিপীড়ন, নির্মূলকরণ এবং অস্বীকার, যা তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনো এড়াতে পারেনি। ভাষাগতভাবেও তাদের প্রতিশ্রুতি সর্বদা ভঙ্গুর ছিল। তবে তাদের একটি মন্ত্র ভবিষ্যদ্বাণীতে পরিণত হয়েছে, ‘আবার চিরকাল।’
পশ্চিমে, বিশেষ করে অতীতের গণহত্যায় জড়িত দেশগুলোর সাংস্কৃতিক প্রচারণায় শিশুদের দুঃখ-কষ্ট ন্যায্য খেলায় পরিণত হয়েছে। পবিত্রতা এখন অপবিত্র। পশ্চিমা মিডিয়ায় শিশুরা সর্বদা একটি নির্দিষ্ট ‘বিনোদনমূলক’ মূল্য ধারণ করে। তাদের ব্যথা আলোকিত, তাদের অশ্রু আবেগগতভাবে শক্তিশালী। কিন্তু দুঃখ-কষ্টকে উপস্থাপন করা এবং তা শোষণ করার মধ্যে একটি সূক্ষ্মরেখা রয়েছে। এবং আজ সেই রেখাটি কেবল অতিক্রম করা হয় না, এটি মুছে ফেলা হয়। তাই লাইভস্ট্রিম করা যুদ্ধ এবং অ্যালগরিদমচালিত সম্পৃক্ততার যুগে গণহত্যা আর কেবল একটি অপরাধ নয়, এটি আত্মতৃপ্তিও বটে। ‘ওবামানা’ মানে বসনিয়ান গণহত্যা ছিল টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত প্রথম গণহত্যা। এরই ধারাবাহিকতায় গাজার গণহত্যা প্রথম সম্পূর্ণ ডিজিটাল গণহত্যা হয়ে উঠেছে।
স্মার্টফোনগুলো বাস্তব সময়ে শিশুদের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো ধারণ করে। লাইভস্ট্রিমে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া পুরো পরিবারগুলোকে দেখানো হয়—শুধু সেই ছবিগুলোকে ব্যঙ্গ, অস্বীকৃতি অথবা আরো খারাপ প্যারোডি দ্বারা ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য। এটি সিস্টেমের কোনো বাগ নয়। এটি আজকের ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে, তার একটি বৈশিষ্ট্য। গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ একই রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের সাংস্কৃতিক শিল্পে তার শিকারদের উপহাসকে বিকশিত হতে দেয়। তবে গাজা এই নির্মম সত্যকে নিশ্চিত করে : ‘একবার আমরা একটি গণহত্যাকে ক্ষমা করে দিলে, আমরা পরবর্তী গণহত্যাটিকে সক্ষম করে তুলব, অনিচ্ছা সত্ত্বেও।’
নেটফ্লিক্স শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের বিকৃত শ্রেণিবিন্যাস উন্মোচিত করে, যেখানে এমনকি স্বর্ণকেশী, নীল চোখের ইউরোপীয় মুসলিম গণহত্যার শিকারদেরও পূর্ণ মানবতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। রিড হেস্টিংস এবং ডেভিড হাইম্যান সিরিজটি অপসারণের অযোগ্য বলে মনে করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব নতুন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে; যার মূলমন্ত্র হিসেবে দাবি করা হয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি স্পষ্ট হতে থাকে—পশ্চিমাদের এই নীতিমালা সব দেশের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়, বরং একেক দেশের জন্য তা একেক রকম।
নেটফ্লিক্সের কথা বাদ দিন। পশ্চিমা দুনিয়ায় বিধর্মী শত্রু অথবা ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে মুসলমানরাই এখন প্রচারমাধ্যমের সবচেয়ে বড় টার্গেট। একটি তথ্য জানালেই সেটি টের পাওয়া যাবে। ডেনমার্কে গত বছরের ১৫ মে থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসের ছয়টি জাতীয় সংবাদপত্র এবং দুটি টিভি চ্যানেলের ওপর জরিপে দেখা গেছে, সেখানকার মিডিয়া কাভারেজের ৭৫ শতাংশই ইসলাম সম্পর্কিত এবং তার মধ্যে ৬০ শতাংশই নেতিবাচক অর্থাৎ উদ্দেশ্যপূর্ণ।
পশ্চিমের প্রচারমাধ্যম এমনভাবে মুসলমানদের সামাজিক পরিচয় বানায়, যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেওয়াটা একমাত্র তাদেরই বৈশিষ্ট্য। সহজেই পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলো ভুলে যায়, মুসলমানদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সন্ত্রাস পরিচালনা শুরু করার বহু আগে থেকে পৃথিবীতে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপকভাবেই ছিল। উদাহরণ হিসেবে ফিলিস্তিনে সারা দুনিয়ার ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘স্টার্ন গ্যাং’ ও ‘ইরগান’ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ বা এএনসি যেভাবে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ব্যবহার করেছে, তা যেকোনো মুসলিম সন্ত্রাসকে ম্লান করে দেয়। অথচ মুসলিমরাই এখন দুর্ভাগ্যে ভাগ্যবান!
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক