তাঁর ভাষায়, ‘গবেষণা হলো নতুন জ্ঞানের দরজা উন্মোচনের চাবিকাঠি।’ গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার বিকাশ সম্ভব, যা অর্থনীতি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক। বাস্তবমুখী শিক্ষা পরিকল্পনা, প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ এবং নেতৃত্ব গঠনের কাঠামো গড়ে তোলার আহবানও তিনি জানিয়েছেন।
শিক্ষা শুধু উন্নয়নের উপকরণ নয়, বরং মানবজীবনের মূলমন্ত্র—এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন : ‘অর্থাভাবে কোনো মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর পড়ালেখা থেমে থাকবে না।’ তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন (জেআরএফ) অসচ্ছল মেধাবীদের জন্য বৃত্তি চালু করেছে, যা নিঃসন্দেহে মানবিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য ও অস্থিরতা দূর করে একটি সুশৃঙ্খল ও অন্তর্ভুক্তি শিক্ষাব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে বিএনপি তাদের ৩১ দফার ২৪ নম্বর দফায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা পেশ করেছে।
এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, নিম্ন ও মধ্য স্তরের শিক্ষায় চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা চালু করা হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে। উচ্চশিক্ষায় জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে গবেষণার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে। একই মানের শিক্ষা সবার জন্য নিশ্চিত করা হবে এবং মাতৃভাষায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। নেতৃত্ব বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন আয়োজন করা হবে।
দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি নির্ভর খাত ঢেলে সাজানো হবে। শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উৎপাদন খাতে গবেষণা ও উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, যাতে উদ্ভাবনমুখী অর্থনীতি গড়ে ওঠে।
তরুণদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ক্রীড়াঙ্গনে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি করা হবে। জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষায় অনৈতিক আকাশ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে উপযুক্ত নীতিমালা গ্রহণ করা হবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল একটি শিক্ষানীতির অভিমুখ নয়, বরং এটি একটি নৈতিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও মানবিক সমাজ গঠনের দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা। ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে সেতুবন্ধ এবং বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ একটি আত্মনির্ভরশীল ও সৃজনশীল জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
‘শিক্ষা জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে’—এই চেতনায় অটল তারেক রহমান। তাঁর শিক্ষার দর্শনে শিক্ষা কেবল পরীক্ষা নয়, বরং জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রাসঙ্গিক ও ব্যাবহারিক হতে হবে।
প্রাথমিক স্তরে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন নৈতিকতা, মানবিকতা ও সৃজনশীলতার বিকাশে। শিশুদের শেখানো হবে পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি, পরিবেশ পরিচর্যা এবং সমাজ ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ। তারা প্রকৃতি ও বিজ্ঞানকে অনুভব করবে; যেমন—বাগান করা, প্রাণীর যত্ন নেওয়া, মাটির সংস্পর্শে শেখা।
শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে পাঠ্যক্রমে থাকবে ভাষা শিক্ষা, খেলাধুলা, সংগীত, চারুকলা, আবৃত্তি, বাদ্যযন্ত্র ও লোকভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি। স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যুক্ত করা হবে শ্রেণিকক্ষে, যাতে শিশুদের সঙ্গে শিক্ষার যোগসূত্র গভীর হয়।
নৈতিক ও মানবিক শিক্ষাই হবে মূলস্তম্ভ। ছোটগল্প, নাটক, দলীয় আলোচনা ও সহমর্মিতা শেখানোর পদ্ধতিতে পাঠ্যসূচি সাজানো হবে। পাশাপাশি থাকবে কৃষি, বাগানবিদ্যা, কারিগরি ও পেশাগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ; যেমন—ছবি আঁকা, সেলাই, কাঠের কাজ, বেসিক ইলেকট্রনিক, তথ্য-প্রযুক্তি ও কোডিং। ব্যক্তিগত ও সামাজিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শেখানো হবে যোগাযোগ কৌশল, সময় ব্যবস্থাপনা, লক্ষ্য নির্ধারণ ও সমস্যা সমাধানের কৌশল।
মূল্যায়ন পদ্ধতিও হবে আধুনিক ও বৈচিত্র্যময়— পরীক্ষাভিত্তিক নয়, বরং প্রকল্প, পর্যবেক্ষণ ও আগ্রহনির্ভর মূল্যায়নের মাধ্যমে দক্ষতা ও মনোভাব মূল্যায়ন করা হবে।
একুশ শতকের বিশ্বে প্রতিযোগিতার জন্য একাধিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন অত্যাবশ্যক—এই উপলব্ধি থেকে তারেক রহমান প্রাথমিক স্তর থেকেই আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষার পরিকল্পনা করেছেন। মাতৃভাষা ও ইংরেজির পাশাপাশি পাঠ্যক্রমে থাকবে মান্দারিন, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইতালীয় ও অ্যারাবিক ভাষা।
তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী যদি প্রাথমিক পর্যায়ে জার্মান শেখে, এরপর মাধ্যমিকে আরো একটি ভাষা আয়ত্ত করে—তবে ধীরে ধীরে সে চারটি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে।
ছুটির সময়ও শিক্ষার অংশ হিসেবে কাজে লাগানো যাবে—‘যদিও শুরুতে শিশুরা কিছুটা বিরক্ত হতে পারে, তবে বিষয়টি আনন্দদায়ক ও অর্থবহ করে তুললে দীর্ঘ মেয়াদে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
এই রূপরেখা বাস্তবায়নে তিনি জোর দিয়েছেন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অভিভাবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় সম্পদের সৃজনশীল ব্যবহারে। নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বগুণ বিকাশের পরিবেশ তৈরি করা হবে।
তারেক রহমানের শিক্ষা পরিকল্পনা কেবল একটি পাঠ্যক্রম নয়, এটি একটি জাতীয় রূপান্তরের নকশা। এর মাধ্যমে শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, ক্রীড়া ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠবে একটি সৃজনশীল, দক্ষ ও নৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এই রূপরেখা বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আত্মবিশ্বাসী, মানবিক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম হয়ে উঠবে।
শিক্ষাবান্ধব রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের শিক্ষা চিন্তা ও দর্শন ছিল আধুনিক, বাস্তবমুখী ও অগ্রসর। তাঁর সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে উপযোগী ও উৎপাদনমুখী করে গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় আয়োজিত ‘জাতীয় শিক্ষা ওয়ার্কশপ’-এ তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষা মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের মূল উপাদান।’ তাঁর শাসনামলে বাস্তবমুখী ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে খালেদা জিয়া নারীশিক্ষায় বিপ্লব ঘটান। ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে তাঁর নেতৃত্বে মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয় এবং মেয়েশিশুদের ঝরে পড়া রোধে শিক্ষা উপবৃত্তি চালু হয়। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিদ্যালয়ে টিকিয়ে রাখতে চালু করা হয় ‘শিক্ষার জন্য খাদ্য’ কর্মসূচি, যা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি গঠনমূলক সামাজিক প্রভাব ফেলে।
বিএনপি মনে করে, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরতার পথে অগ্রসর হতে হলে শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রসার অপরিহার্য। ভিশন ২০৩০-এ দলটি যে শিক্ষা রূপরেখা উপস্থাপন করেছে, তা কেবল গুণগত শিক্ষার নিশ্চয়তা দেয় না, বরং এটিকে যুগোপযোগী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও মানবসম্পদ বিকাশকেন্দ্রিক করে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়। সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা সম্প্রসারণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করে এক দশকের মধ্যে নিরক্ষরতা নির্মূল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করা হবে, যাতে জনগণের মৌলিক সক্ষমতা গঠনের ভিত্তি মজবুত হয়।
বিএনপি সরকার গঠন করলে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য দূর করে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সুশৃঙ্খল ও গুণগত উন্নয়ন সাধন করা হবে। গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পেশাগত প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা এবং উৎপাদন খাতে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হবে।
মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলা হবে, যাতে সেখানকার শিক্ষার্থীরাও সমানভাবে উচ্চশিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়নে অংশ নিতে পারে। পাশাপাশি ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি খাতে উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিপরীতে বিএনপি একটি ইতিবাচক, দায়িত্বশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে গণমাধ্যম, শিক্ষা কারিকুলাম, ধর্মীয় শিক্ষা এবং সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে নৈতিক চেতনার পুনরুদ্ধারে কার্যকর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।
এভাবে শহীদ জিয়া, খালেদা জিয়া ও বিএনপির সামগ্রিক শিক্ষা দর্শন একসঙ্গে মিলিত হয়ে শিক্ষা, প্রযুক্তি, ক্রীড়া এবং নৈতিকতার চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড় করাতে চায় এক নতুন বাংলাদেশ, যা হবে সৃজনশীল, আত্মনির্ভর, মানবিক মূল্যবোধে শক্তিশালী এবং জ্ঞানভিত্তিক জাতি গঠনের পথপ্রদর্শক।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক