এ বছর আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসের (২২ মে ২০২৫) প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘হারমোনি উইথ নেচার অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’। এটির বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি এবং সুস্থায়ী/টেকসই উন্নয়ন’। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবহার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (কনভেনশন)—সিবিডি (কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি) সেক্রেটারিয়েট এই প্রতিপাদ্যটি নির্বাচন ও প্রচারের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এই প্রতিপাদ্যের প্রথম অংশ, প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি বলতে প্রকৃতির জীব (অণুজীব, উদ্ভিদ, প্রাণী) ও জড় (মাটি, পানি, বায়ু ইত্যাদি) উপাদানগুলোর ক্ষতি না করে তাদের সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান করার বিষয়টির ইঙ্গিত দেয়।
আর সুস্থায়ী বা টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার নিশ্চিত করা সাপেক্ষে যে উন্নয়ন। আসলে সুস্থায়ী উন্নয়ন কখনো প্রকৃতি, বিশেষ করে জীব ও জড় উপাদানগুলো এবং তাদের পারস্পরিক ভারসাম্যময় অবস্থাকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। এবারের এই প্রতিপাদ্য, প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি এবং সুস্থায়ী উন্নয়নের মাধ্যমে প্রকৃতির উপাদানগুলোকে ঠিকভাবে বাঁচিয়ে রাখা, তাদের অস্তিত্বকে স্বীকার করা এবং তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার আহবান জানানো হয়েছে।
প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি ধারণাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেড় দশক আগে থেকেই বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে।
২০০৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রতিবছর ২২ এপ্রিলকে ধরিত্রী দিবস হিসেবে ঘোষণা ও পালন করার জন্য যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তাতে প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি বিষয়টিকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে প্রতিবছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ধরিত্রী দিবসকে কেন্দ্র করে গৃহীত সিদ্ধান্তে এবং পৃথকভাবেও প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। এর থেকে বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এই গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে নেওয়া কর্মসূচি দ্য টু থাউজেন্ড থার্টি এজেন্ডা ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) গৃহীত হওয়ার পর। এসডিজি ঘোষণাপত্রের অভীষ্টসহ অনেক জায়গায় প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি ও এসডিজি বিষয় দুটি অনেক সময় একসঙ্গেই উচ্চারিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস ২০২৫-কে কেন্দ্র করে সিবিডির ওয়েবসাইটে বার্তা হিসেবে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে :
১. জীববৈচিত্র্য পৃথিবীর সব জীবনের ভিত্তি। মানুষের কল্যাণ, একটি সুস্থ গ্রহ এবং সব মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য জীববৈচিত্র্য মৌলিক উপাদান হিসেবে কাজ করে।
আমরা খাদ্য, ওষুধ, শক্তি, বিশুদ্ধ বাতাস ও পানি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষার পাশাপাশি বিনোদন এবং সাংস্কৃতিক অনুপ্রেরণার জন্য জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করি।
২. কেএমজিবিএফ (কুনমিং-মন্ট্রিয়ল গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ফ্রেমওয়ার্ক : ২০২১ এবং ২০২২ সালে যথাক্রমে কুনমিং ও মন্ট্রিয়লে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্যবিষয়ক সম্মেলনে গৃহীত চুক্তি)—টেকসই উন্নয়ন ২০৩০ এজেন্ডাকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের সমাজকে প্রকৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে রূপান্তরের জন্য একটি উচ্চাভিলাষী নীলনকশা প্রণয়ন করেছে।
৩. কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা, অবকাঠামো, শিল্প, জ্বালানি ব্যবস্থার ব্যবহার এবং উৎপাদন ধরন, পানি ও বাস্তুতন্ত্র ব্যবস্থাপনা, নগর পরিকল্পনা, শিক্ষা ও লিঙ্গ সমতাসহ সমাজ ও অর্থনীতি রূপান্তরের জন্য এসডিজি (বাস্তবায়ন) সাহায্যকারী বা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কেএমজিবিএফ অর্জন এবং এর রূপকল্প প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন পূরণের জন্য উপরোক্ত
রূপান্তরগুলো একান্তভাবে হওয়া প্রয়োজন।
৪. কেএমজিবিএফের ২৩টি লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করা হয়েছে এসডিজি ২০৩০-এর সুস্থায়ী উন্নয়ন ও এর ১৭টি উন্নয়ন অভীষ্টের সঙ্গে সংগতি রেখে এবং তাদের অর্জনে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে। কেএমজিবিএফ এবং এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি দেশকে এই সংগতিকে বিবেচনায় নিয়ে অবশ্যই এই দুটি বিষয়ের সার্বিক একীকরণ ও সমন্বয় করতে হবে।
৫. সিবিডির সব সদস্য দেশ তাদের জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনায় (ন্যাশনাল বায়োডাইভার্সিটি স্ট্র্যাটেজিস অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (এনবিএসএপিএস) কেএমজিবিএফের উচ্চাভিলাষের প্রতিফলন ঘটাবে বলে আশা করা যায়। এই বিষয়ে সর্বোচ্চ ফলাফলের জন্য এনবিএসএপিএসকে এসডিজি এবং ভবিষ্যতের চুক্তি দ্বারা পরিচালিত জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে সমন্বয় করা প্রয়োজন।
৬. কেএমজিবিএফ এবং এসডিজি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও সমাজের সবার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, স্থানীয় সম্প্রদায়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, নারী, যুবসমাজসহ আমাদের সবার সহযোগিতা দরকার।
উপরোক্ত বিষয়গুলো জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও আমাদের সুস্থায়ী উন্নয়নের জন্য বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস ২০২৫-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সিবিডির ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে :
১. এসডিজিতে বর্ণিত দারিদ্র্য ও বৈষম্য মোকাবেলাসহ জীববৈচিত্র্য যে পৃথিবীর সব জীবনের মৌলিক ভিত্তি—এই বাস্তবতা সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
২. কেএমজিবিএফের সঙ্গে সংগতি রেখে এবং এসডিজির কাউকে পেছনে ফেলে নয়—এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বিবেচনায় নিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দ্রুত এনবিএসএপিএস তৈরির জন্য আহবান করা।
৩. কেএমজিবিএফ এবং এসডিজির আলোকে সরকার, সমাজ, জাতিসংঘসহ সব স্তরের সমন্বয়ের গুরুত্ব তুলে ধরা।
৪. বেসরকারি খাত, সুধীসমাজ, গণমাধ্যমসহ সব পক্ষের সাহসী উদ্যোগগুলো উৎসাহিত করা।
বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস ২০২৫-এর উপরোক্ত বার্তা ও উদ্দেশ্যকে বিবেচনায় নিয়ে তার আলোকে জীববৈচিত্র্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড নির্বাহ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যে ডকুমেন্টগুলো (ন্যাশনাল রিপোর্টস, এনবিএসএপিএস, থিমেটিক রিপোর্ট ইত্যাদি) সিবিডিতে জমা দিয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসবের মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা/সংরক্ষণ দর্শন অনুপস্থিত। এগুলোতে মেরুদণ্ডী প্রাণী, বিশেষ করে চতুষ্পদ (স্তন্যপায়ী