শৈশবে যখন বই পড়া, পত্রিকার পাতার ছবি দেখা ও রেডিওতে সংবাদ শোনার জ্ঞান হচ্ছিল, তখন থেকে ফিলিস্তিনি বালকদের ইসরায়েলি সেনাদের বুলেটের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ঢিল ছুড়ে প্রতিবাদ করার দৃশ্য মনে দাগ কেটেছিল। কৈশোরে-যৌবনে ফিলিস্তিন ইস্যু ও ইয়াসির আরাফাতের কালো বর্ডার আঁকা গলার স্কার্ফ পরিহিত এক অবিসংবাদিত আরব নেতার দৃঢ় ভূমিকা হৃদয়জুড়ে স্থান করে নিয়েছিল। এরপর ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ও স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্য একটি ইতিবাচক মুসলিম ভ্রাতৃত্বের জাগরণ তৈরি করেছে, যেটি আমাদের ‘জেন-জি’রা চোখে না দেখলেও ইতিহাস থেকে শিখে অদ্যাবধি সঠিকই মনে রেখেছে; যার এত বড় পুনর্জাগরণ হয়ে গেল ২০২৫-এর ৫ এপ্রিলের অব্যবহিত পর বেশ কয়েক দিন ধরে।
ইসরায়েলিদের নির্মম অত্যাচারের মাত্রা ২০২৩ সালে নতুন করে শুরু হয়ে ২০২৫-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে যখন ৫০ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনবাসী নারী-শিশুর প্রাণ কেড়ে নেওয়া সাঙ্গ করেছে, তখন তাদের খায়েশ আরো অন্য কিছু।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের জঘন্য ইচ্ছা জেগেছে গাজার শিশুদের কবরস্থানের ওপর বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরির। সেখান থেকে আরবদের কিছু লোভী নেতার যোগসাজশে তেলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করে নতুন করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের চিন্তা। এই কাজে উৎসাহী হয়েছে নরঘাতক নেতানিয়াহু ও তাঁর দোসররা। কিন্তু সারা বিশ্বের মুসলমানরা এখন সরব হয়েছে, গর্জে উঠেছে একসঙ্গে। মুসলমানরা জানে যে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের একবারে নির্মূল করার পরিকল্পনার কাজ শুরু করলে সেটিই হবে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের জন্য বড় বিপর্যয়ের সূত্রপাত।
ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের নির্মম অত্যাচার নতুন কোনো ঘটনা নয়। এই নির্মমতার পেছনে মার্কিন, ইউরোপীয় ও ভারত সরকারের ন্যক্কারজনক সমর্থন, অর্থ ও মারণাস্ত্রের রসদ জোগানোও নতুন কোনো ব্যাপার নয়। এমনকি নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের বর্বরতার সময় সারা বিশ্ব যখন প্রতিবাদে উত্তাল, তখন আরবরা নীরব কার স্বার্থে? বিশেষ করে সৌদি ও মিসরীয়রা নিশ্চুপ থেকে কোন বার্তা দিচ্ছে? আবার ইসরায়েলের ভেতরে ফিলিস্তিনিদের জন্য সহানুভূতি দেখিয়ে কসাই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তেল আবিবের রাস্তায় ইসরায়েলিদের মিছিল তাঁকে শিশু হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত হতে বিন্দুমাত্র টলাতে পারছে না!
বাংলাদেশে ২০২৫ ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের নির্মমতার বিরুদ্ধে এত বড় প্রতিবাদের পক্ষে মানুষ রাস্তায় নেমেছে, তা বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর।
আসলে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সন্দেহজনক নীরবতা এত দিন লাই দিয়েছে ইসরায়েলিদের আরো বেশি আগ্রাসী হতে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম ভোটাররা সেখানকার চরম মুসলিমবিদ্বেষী, হঠকারী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভোট দিয়ে জিতিয়ে এনে এখন চরম খেসারত গুনছে।
মুসলিমরা আজ মুসলমানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। আরবরা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। মার্চে গাজা হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতায় ইসরায়েলিদের নির্মমতার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের মানুষ ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে উত্তাল, তখনো সৌদি আরবের মানুষ নীরব, নিশ্চুপ।
মিসরীয়রাসহ আরবের ধনাঢ্য বহু দেশ ঈদ আনন্দে মাতোয়ারা। আশ্চর্যজনকভাবে আরবের শক্তিশালী দেশগুলো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং দিচ্ছে তাদের প্রতিবেশী মুসলিম ভাইদের প্রাণ রক্ষায়।
এ যেন বাকরুদ্ধ মানবতা! আরবদের নিশ্চুপ থাকলে হবে কী? আরবদের সন্দেহজনক নীরবতা সারা বিশ্বের মুসলমানকে তাদের ওপর ঘৃণার বাণী ছুড়ে দিয়েছে। তারা আজ হেয় হয়ে গেছে বিশ্বের কাছে। কেউ কেউ তাদের দাজ্জালের সহচর বলে উপহাস করছে। দাজ্জাল নামক শব্দটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে আবেগপ্রবণ এবং প্রতীকী। এখানে ‘দাজ্জাল’ শব্দটি কোরআন ও হাদিসে এসেছে ভবিষ্যতের এক প্রতারক ও ধ্বংসকারী চরিত্র হিসেবে, যাকে অনেক মুসলিম কেয়ামতের আগে আসবে বলে বিশ্বাস করে। তবে আধুনিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গে অনেকেই দাজ্জাল শব্দটি ব্যবহার করে প্রতীক হিসেবে—অন্যায়কারী, মিথ্যাবাদী ও ধ্বংসকারী শক্তিগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে।
তবে সবাই কি দাজ্জালের সহচর? ইতিহাস কী বলে? সেটির ব্যাখ্যাও মনে রাখতে হবে বিশ্বাসীদের। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বহুসংখ্যক ফিলিস্তিনি তাদের ভূমি ও ঘরবাড়ি থেকে উত্খাত হয়। আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নিয়ে ইসরায়েলের এই ভূমি দখলকে অবৈধ ও অন্যায় বলে মনে করে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা, গোলান মালভূমি ও সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়। এই আগ্রাসন আরব দেশগুলোর মধ্যে ক্ষোভ বাড়ায়। এর পরও অনেক আরব দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে (যেমন—সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো)। ফলে তারা গাজার মানুষের জন্য কার্যকর কোনো অবস্থান নেয় না। এটি অনেকের চোখে এক ধরনের ‘দাজ্জালীয় ভণ্ডামি’। অনেক মুসলিম নেতৃত্ব কেবল বিবৃতি দেয়, বাস্তবে কিছুই করে না। ইসরায়েলকে অস্ত্র, প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে বছরের পর বছর। জাতিসংঘে প্রস্তাব ঠেকানো, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে চুপ থাকা ইত্যাদি কারণে তাদের অনেকেই এই সহিংসতার ‘নীরব সমর্থক’ হিসেবে বিবেচিত। অনেকে বলেন, গাজার বাস্তবতা আড়াল করে প্রোপাগান্ডা চালানো, ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’কে প্রাধান্য দিয়ে নিরস্ত্র শিশুদের মৃত্যু আড়াল করাও এক ধরনের ‘প্রতারণা’, যা দাজ্জালের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
তবে জেরুজালেম শহরটি ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিস্টান তিনটি ধর্মের জন্যই পবিত্র স্থান। ইসরায়েল পুরো জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী হিসেবে দাবি করে, যেখানে পূর্ব জেরুজালেমকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দেখতে চায় মুসলিম বিশ্ব। কিন্তু গাজার ওপর বিমান হামলা, অবরোধ, নির্বিচারে বোমাবর্ষণ, অসংখ্য বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ও মানবিক সংকট সৃষ্টির জন্য সরাসরি দায়ী ইসরায়েলের সামরিক অভিযান। জাতিসংঘ এখানে চরম শিথিলতা দেখাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কর্তা-কর্মীরা কোনো ‘রা’ করছেন না গাজায় নির্বিচার হত্যার বিরুদ্ধে। তবে তাঁরা সবাই কি মার্কিনদের ভয়ে তটস্থ, নাকি কথিত দাজ্জালের সহচর তাঁরাও? এই প্রশ্নগুলো নতুন করে দেখা দিয়েছে ২০২৫-এর ৫ এপ্রিলের পর থেকে!
একটি দেশ দখল করে কেউ বিলাসবহুল রিসোর্ট বানাবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। মাৎস্যন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা কথা বলে, গণতন্ত্রকে তাদের বাহুতলে বারবার অন্যায়ভাবে পিষ্ট হতে দেখে বাংলাদেশের মানুষ দল-মত-নির্বিশেষে ফুঁসে উঠেছে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বিশ্বের সব কর্নারে এই প্রতিবাদের ভাষা বার্তা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সার্বক্ষণিকভাবে। তবে সেটি কি এ পর্যন্ত আসল জায়গায় আঘাত করতে পেরেছে? অথবা না পারলে কবে সেই সঠিক জায়গায় পৌঁছবে বলে মনে হয়?
যত দিন যাচ্ছে, এই প্রতিবাদ ততই প্রতিরোধের দিকে গড়াচ্ছে। আমাদের দেশে এই আন্দোলন তুমুল হয়ে উঠছে দিন দিন। ছাত্র-জনতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোও নেমে পড়েছে রাস্তায়। বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, আহলে হাদিস আন্দোলন, ইসলামী যুব আন্দোলন, একুশে চেতনা ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, মোর্চা আলাদাভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমে পড়েছে। তারা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চায়, ইসরায়েলি পণ্য বয়কট চায়, ইসরায়েলকে হেদায়েত দিতে গায়েবি সাহায্য চেয়ে মহান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করে অথবা হেদায়েতপ্রাপ্ত না হলে ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়ার আকুতি জানায়। এভাবে বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের একতা, সহমর্মিতা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে বলে অনেকের যে ধারণা ছিল, যা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে।
প্রতিদিন-রাত ইসরায়েলিদের নির্মমতার বলি ফিলিস্তিনি নারী-শিশুদের নতুন নতুন মৃত্যুসংখ্যা শোনায় পশ্চিমা মিডিয়া। আমরা সেটি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা করে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছি। কিন্তু আরববিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ওদের নির্যাতিত প্রতিবেশী ভাইদের প্রতি ভূমিকা কী? তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখাল? তারা কে কী দায়িত্ব পালন করছে বা করল সেসব প্রশ্ন উঠছে। বিলাসী শেখদের বিরুদ্ধে সমালোচনা দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে।
আরব নেতাদের সবার উচিত বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দ্রুত জেগে ওঠা। অবশিষ্ট ফিলিস্তিনি নারী-শিশুদের প্রাণ রক্ষা ও স্বাধীন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের জন্য আমাদের গর্জন ও আহ্বানের সঙ্গে নির্লিপ্ত, অথচ শক্তিশালী আরব দেশগুলো একটু হুংকার ছাড়লেই মার্কিন প্রশাসন সুর পাল্টাতে বাধ্য হবে বলে বিশ্লেষকরা আশা প্রকাশ করেন। মার্কিন সমর্থন জিরো হলে গাজা থেকে নেতানিয়াহু লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবেন শিগগিরই।
এ জন্য আমাদের সবার সেন্টিমেন্টের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিবাদ করতে হবে জোর গলায়। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব নেতাদের নিয়ে ড. ইউনূস খুব দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করতে পারেন ঢাকায়—এই নতুন বাংলাদেশে, যা বাংলাদেশকে আরো এক ধাপ সামনে এগিয়ে নিতে পারে। এভাবে আমাদের নবজাগরিত উত্তাল জনতার গর্জে ওঠা বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আসল জায়গায় আঘাত করুক, ফিলিস্তিন সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তা সরব থাকুক—এই প্রত্যাশা।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন