সুস্থ-সচেতন মানুষ কখনোই স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকতে চাইতে পারে না। কিন্তু স্বাধীনতা এমনই এক বিষয়, যা চাইলেই পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল।
স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে
- ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার যে স্বাধীনতার জন্য আমরা সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হই তার পটভূমি রচিত হয়েছিল অনেক আগেই। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে নিলে বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু তা নীরবে সহ্য করেনি। বরং তারা নানাভাবে ইংরেজ শাসনযন্ত্রকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।
পরবর্তী সময়ে ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে বাংলাকে আলাদা স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বিধান রাখা হয়েছিল। মূল লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সন্নিহিত এলাকায় অবস্থিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে এক বা একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। পরে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ টাইপিং মিসটেক হিসেবে উল্লেখ করে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের বিধানটি বাতিল করেন। অখণ্ড ভারতে যাঁরা বাঙালি নেতা ছিলেন তাঁরা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন দেড় হাজার মাইলের ব্যবধানে দুটি অঞ্চল, যাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন, তারা শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে একক জাতিসত্তা গঠন করতে পারে না। যাহোক, সেই সময় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার বাসনা জলাঞ্জলি দিতে হলেও তাঁরা হৃদয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তাই যখনই অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে তাদের স্বাধীনতা এবং কৃষ্টি-কালচারের ওপর আঘাত এসেছে তখনই বাংলাদেশের মানুষ তা রুখে দাঁড়িয়েছে। বুকের রক্ত দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালেই প্রথম সংকট দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটে বিস্ফোরণ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ বাংলাভাষী হলেও উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে পাকিস্তানিদের চক্রান্ত রুখে দেয়। সেই সময়ই বাংলাদেশের মানুষ বুঝে নেয় পাকিস্তানের সঙ্গে একত্র থাকা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকচক্রের হঠকারিতার জন্যই বাংলাদেশের মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের কাছে যদি শাস্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হতো, তাহলে পাকিস্তানের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের বেলা পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড শুরু করলে বাংলাদেশের মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ২৬ ও ২৭ মার্চ কালুর ঘাট রেডিও স্টেশন থেকে তৎকালীন মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পরবর্তী সময়ে দিবসগুলোতে সেই ভাষণই কিছুটা পরিবর্তিত আকারে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে পুনরায় ঘোষণা করা হয়। রেডিওতে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে আমার যে কি অনুভূতি হয়েছিল তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মেজর জিয়ার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার পর আমি স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। আমার সৌভাগ্য, আমি মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমার মানসপট থেকে কখনো বিদূরিত হবে না। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে আমি সূর্য সেন হলের একটি ফ্ল্যাটে অবস্থান করছিলাম। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মার্চ মাসের মাঝামাঝি কিছুদিনের জন্য নিজ শহর ফেনীতে চলে যাই। আমি ঢাকা আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু আমি ঢাকা আসতে পারছিলাম না। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর সামরিক অভিযান শুরু করে। ঢাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জেলা ও মহকুমা শহরগুলোতে অভিযান শুরু করে। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফেনী শহরে সামরিক অভিযান শুরু করে। স্থল বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে নিরাপদ করার জন্য প্রথমে বিমানবাহিনী ফেনী শহরে হামলা শুরু করে। প্রথম যেদিন ফেনীতে বিমান হামলা করা হয় সেদিন আমি পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ ফেনী শহরেই ছিলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি আসলে কী হচ্ছে। পরে আমরা বুঝতে পারি পাকিস্তানি বাহিনী একতরফা বিমান হামলা শুরু করেছে। আমরা বাসার সবাই ভয়ে খাটের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করি। বিমান হামলা থেমে গেলে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি মানুষ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। পরদিন আমি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শহরের অদূরে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।
এলাকার যুবসমাজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। আমাদের এলাকায় মকবুল হোসেন মকু মিয়া নামের এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় তিনি গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। আমি মকু মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করি এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণদানের জন্য অনুরোধ জানাই। মকু মিয়া আমার অনুরোধে সাড়া দেন। আমরা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে সভা আহ্বান করি। সেই সভার পর আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণেচ্ছুদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
সেই সময় যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত মিথ্যা সংবাদ কেউ বিশ্বাস করত না। সেই সময় যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা। গ্রামে কয়েকটি রেডিও ছিল। শ্রোতারা জটলা পাকিয়ে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরও তারা মনোযোগ দিয়ে শুনত।
রেডিওতে ঘোষণা করা হয়, ১ জুন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। এ অবস্থায় আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকি। আমি কি ঢাকায় ফিরে যাব, নাকি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যা্ব? নাকি গ্রামেই অবস্থান করব? কিন্তু অনেকেই পরামর্শ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরও আমি যদি যোগদান না করে গ্রামে অবস্থান করি অথবা ভারতে চলে যাই, তাহলে পুরো পরিবার বিপদে পড়তে পারে। তাই শেষ পর্যন্ত ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং ৩১ মে আমি ঢাকা চলে আসি।
ঢাকা আসার পর আমি ডাকযোগে জীবননাশের হুমকিসংবলিত একটি চিঠি পাই। যমদূত বাহিনীর এই চিঠি পাওয়ার পর আমি ঢাকা শহর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কারণ ঢাকা শহর আমার জন্য তখন আর নিরাপদ ছিল না। আমি ৩১ মে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার মানসে রাজধানী ত্যাগ করি।
আমি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের পথে যাত্রা শুরু করি। এর মাধ্যমে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অধ্যায় শুরু হলো।
কিছুদিন আগরতলায় অবস্থান করার পর আমি কলকাতা গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। উদ্দেশ্য ছিল বৃহত্তর পরিসরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। কলকাতা পৌঁছানোর পর আমরা কয়েকজন মিলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনের কাজে নিয়োজিত হই। বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার চেষ্টা করি। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানা সংকট পেরিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করি।
আমরা সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অবদান রাখার অঙ্গীকার করি। আমার অঙ্গীকার ছিল মানবিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সত্যিকারার্থে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হতে বিলম্ব হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনো একক দলের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। সব দল-মতের মানুষ এতে অংশ নিয়েছি। এটা ছিল মূলত জনযুদ্ধ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেয়। অথচ সেই সময় জাতীয় সরকার গঠন করে সম্মিলিতভাবে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল জরুরি। জাতীয় সরকার গঠিত হলে সম্মিলিতভাবে দেশের পুনর্গঠনে কাজ করা সম্ভব হতো। তখনকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এক শ্রেণির নেতাকর্মী দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গণবাহিনী তৈরি করে। সে সময় সরকার রক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দলের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালায়। বিশেষ করে সরকারি দলের লোকদের নির্বিচার লুটপাটের কারণে ১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়। অসংখ্য মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যায়। পরে বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পেছনে খাদ্যের স্বল্পতা যতটা না দায়ী ছিল তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল খাদ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারা। সরকারদলীয় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সেই সময় দেশের বাইরে খাদ্য পাচার করেছিল। সরকারি দলের এক শ্রেণির নেতাকর্মীর ব্যাপক লুটপাটের কারণে দেশে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এমনকি এক অবস্থায় বাকশাল গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতা চিরদিনের জন্য কুক্ষিগত করার চেষ্টা চালানো হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা। সেনাবাহিনীর একটি বিক্ষুব্ধ অংশের হাতে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। কিন্তু দেশে যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা কোনো না কোনোভাবে এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া বিনা ভোটে নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। আগে বিদেশি শাসকরা আমাদের দেশ থেকে অর্থ-সম্পদ লুটে তাদের দেশে নিয়ে যেত। আর এখন আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষ দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অর্থ উপাজন করে তা বিদেশিদের কাছে দিয়ে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের মাধ্যমে বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতির মাধ্যমে যেভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটে নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে তার কোনে নজির নেই। উন্নয়নের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতে পলায়ন করেছেন। দেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের পূর্বাকাশে নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে। উদীত নতুন সূর্যের আলোয় আমাদের আগামী দিনে পথ চলতে হবে। এর আগেও বেশ কয়েকবার আমরা দেশ গড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থপরতা ও দূরদর্শিতার অভাবেব কারণে সেই সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। কিন্তু এবার ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি ৫ আগস্টের নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে বাধ্য। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতি গঠনে সবাইকে তৎপর হওয়া। ক্ষুদ্র স্বার্থে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হলে আগামী প্রজন্ম আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না।
লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd