উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী দেশ বিভাগের সময় বাঙালিদের চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, এরা বড়ই ষড়যন্ত্রপ্রিয়। অর্থাৎ সুযোগ পেলেই এরা একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একই সঙ্গে এরা কর্মসংগঠনে বা কর্মসম্পাদনে অদক্ষ ও দুর্বল। জার্মানিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী কর্মসূত্রে বেশ কিছুদিন ভারতবর্ষে অবস্থান করেছিলেন।
বসবাসযোগ্য সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে
- ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের মানুষের চরিত্র এবং আচার-আচরণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা হলেও ব্যতিক্রমধর্মী। এরা যেমন কাউকে সহজে আপন করে নিতে পারে, তেমনি সম্পর্কের সামান্য ব্যত্যয় ঘটলে তাদের মাঝে হিংস্রতার উদ্ভব ঘটতে পারে। অতীত সম্পর্ক ভুলে গিয়ে তাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে পারে। একবার সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে নদীতে জোয়ার-ভাটা প্রত্যক্ষ করে নাকি মন্তব্য করেছিলেন, যে দেশের নদীর পানি সকালে একদিকে এবং বিকেলে অন্যদিকে ধাবিত হয়, সে দেশের মানুষের মন বোঝা বড়ই কঠিন।
আজকাল অনেকের মুখে শোনা যায়, দেশটি বসবাসের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আগের সেই দিনকাল আর নেই। মানুষের মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টি এবং রক্ষার ক্ষেত্রে আন্তরিকতার অভাব দেখা দিয়েছে। দেশের বাস্তব পরিস্থিতিই সম্ভবত মানুষের মনে এই ধারণার জন্ম দিয়েছে।
একসময় বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল মূলত গ্রামকেন্দ্রিক। জিডিপির ৯০ শতাংশই আসত গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। এখন এই অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কয়েক বছর আগের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সামাজিক অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটছে। একসময় মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের মতো বাস করত গ্রামে। যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে কর্মসংস্থানের জন্য আসত, তারাও সপ্তাহান্তে গ্রামে পরিবারের কাছে ফিরে যেত। কিন্তু এখন সেই অবস্থা আর নেই। কেউ একজন গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন করলে সে আর গ্রামে ফিরে যেতে চায় না। বর্তমানে শহর হয়ে উঠেছে অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের মতো বাস করে শহরে। আর জিডিপির ৬০ শতাংশেরও বেশি অর্জিত হয় শহরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভরকেন্দ্র দ্রুত গ্রাম থেকে শহরে সরে আসছে। অন্যদিকে গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক রূপান্তর ঘটছে। আগে যারা প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী ছিল, তারা ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু পরিবারে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে একসময় যারা একেবারেই দরিদ্র ছিল, তাদের অনেকেই এখন দ্রুত নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হচ্ছে। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে বিদেশগামিতা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনশক্তি রপ্তানি খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি খাত। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যাঁরা কর্মসংস্থানের উপলক্ষে বিদেশে গমন করেন, তাঁদের বৃহদংশই গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা। তারা যেকোনোভাবেই হোক, জমিজিরাত বিক্রি করে বিদেশে চলে যাচ্ছে। একসময় প্রবাসী কর্মীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখছে। যে পরিবার থেকে কেউ একজন বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য গমন করেন, তাঁর পরিবারের প্রাথমিক কাজ হয়ে দাঁড়ায় প্রেরিত রেমিট্যান্স দিয়ে জমি ক্রয় এবং বাড়ি নির্মাণ। দেশে আসা রেমিট্যান্স শিল্পে বা অন্য কোনো বিকল্প আয়বর্ধক কাজে ব্যবহার করা গেলে গ্রামীণ অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হতো।
কয়েক বছর আগে একটি বিদেশি সংস্থার গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছিল, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিন দশক আগেও বাংলাদেশের ১২ শতাংশ পরিবার মধ্যবিত্ত ছিল। এখন তা ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই উত্থানের পেছনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে শুধু যে মধ্যবিত্ত পরিবারের হার বেড়েছে তা নয়, তাদের ক্রয়ক্ষমতা বা ভোগ ব্যয়ের সামর্থ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। শহুরে জীবনে যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হতো, তা এখন গ্রামীণ এলাকায়ও সম্প্রসারিত হয়েছে। কালার টিভি, ফ্রিজ, এমনকি এসি এখন গ্রামীণ পরিবারেও ব্যবহার করতে দেখা যায়।
তবে বিগত সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে শহুরে জীবনের মতো গ্রামীণ সমাজব্যবস্থাও কলুষিত হয়েছে। চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, খুন-জখম, রাজনৈতিক হানাহানি এখন শহরের মতো গ্রামীণ জীবনেও সঞ্চারিত হয়েছে। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে যাঁরা গ্রামে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন, তাঁদের সবাই সম্মান করত। এখন যাঁরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তাঁরা জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হন না। ভোট কারচুপির মাধ্যমে তাঁরা ক্ষমতা দখল করে নেন। নির্বাচিত হয়েই তাঁরা চাঁদাবাজি-দখলবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়েন। গ্রামীণ সমাজে এখন টাউট-বাটপাড়ের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায় আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। গ্রামীণ এলাকায় প্রতারক শ্রেণি নানাভাবে সাধারণ মানুষের সম্পদ ও অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
শুধু গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায়ই নয়, পুরো দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এক ধরনের কলুষতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজের প্রভাবশালী একটি শ্রেণির অনৈতিক কর্মকাণ্ড যেকোনো বিবেকবান মানুষকেই ব্যথিত করবে। এখন যেন অর্থই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিভাবে সেই অর্থ উপার্জিত হচ্ছে, তা ভেবে দেখার কোনো অবকাশ কারো নেই। সবাই অর্থের পেছনে ছুটছে। একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বলেছিলেন, অর্থ হচ্ছে সেকেন্ড গড বা দ্বিতীয় প্রভু। কিছু মানুষের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করলে অনুধাবন করা যায়, এই প্রবাদ বাক্যটি যথার্থই ছিল। দুর্নীতির বিষবাষ্প শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রাম এলাকায়ও কেউ একজন জনপ্রতিনিধি হতে পারলে তাঁর পক্ষে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া বিচিত্র নয়। তাঁরা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য যেকোনো ঘৃণ্য পন্থা অনুসরণ করতেও দ্বিধা করেন না।
সমাজব্যবস্থার এই অধঃপতনের জন্য আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বহুলাংশে দায়ী। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি পরিশীলিত এবং মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা। মানুষের মনোজগতে বিদ্যমান মানবিক গুণাবলিকে জাগিয়ে তোলা, যাতে তারা সমাজের উন্নয়নে নিজেদের উৎসর্গ করতে পারে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেটি করতে পারেনি। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে দক্ষ এবং কর্মক্ষম মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ তৈরি করা, কিন্তু সেটি হচ্ছে না। আমরা প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীকে শিক্ষা সমাপন করে বের হতে দেখছি। কিন্তু তাদের মধ্যে কজন আছে, যারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত? বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম যাতে সত্যিকার শিক্ষিত এবং মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠতে না পারে, সে জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চক্রান্ত করা হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মোটেও কর্মমুখী নয়। একজন উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পরও নিশ্চিত হতে পারছে না সে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে কি না। কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা না থাকার কারণে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বিদেশ গমনের প্রবণতা বাড়ছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চশিক্ষিত অহমিকাপূর্ণ বেকার তৈরি করছে মাত্র। যারা দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারছে না, তারা বিদেশে চলে যাচ্ছে এবং অনেকেই সাধারণ মানের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুুষ অত্যন্ত সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু তারা প্রতিভা বিকাশের মতো উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে না।
সমাজে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি এবং নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতাও অনেকাংশে দায়ী। রাজনীতিবিদদের অনেকেই ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি এবং অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত। সুনাগরিক হতে হলে একজন মানুষকে সৎ এবং মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন দেশপ্রেমিক হতে হবে। কিন্তু আমরা শিক্ষার্থীদের মাঝে এই গুণাবলি সঞ্চারিত করতে পারছি না। সর্বস্তরে ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণ, রাজনৈতিকীকরণের কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে। সুনাগরিক হওয়ার শিক্ষা প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবার থেকে দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যমে সেই গুণাবলিকে আরো পরিশীলিত এবং ব্যাপৃত করতে হবে। বর্তমানে যারা তরুণ প্রজন্ম, তাদের মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় তারা প্রমাণ করেছে কিভাবে স্বৈরাচারী সরকারের মসনদ উল্টে দিতে হয়। এই প্রজন্মকে যদি আমরা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে তারা ভবিষ্যতে দেশ ও সমাজের চেহারা বদলে দিতে পারবে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে আমাদের কি তেমন কোনো পরিকল্পনা আছে?
দেশে যদি সুনাগরিক গড়ে তোলার উপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করা যেত, তাহলে দুর্নীতির মাত্রা অনেকটাই হ্রাস পেত। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সত্যিকার দেশপ্রেমিক একজন মানুষ কখনোই দুর্নীতি করতে পারে না। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে আমরা প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীকে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করছি, কিন্তু তাদের মধ্যে কতজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক এবং আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছে তার খোঁজ রাখছি না। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের সুকুমারবৃত্তিকে জাগ্রত করে তাকে একজন আদর্শ দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
দেশ অনেক দিন গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে ছিল। ছিল স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অধীনে। গণতন্ত্রহীন সমাজে সুকুমারবৃত্তির যথাযথ বিকাশ ঘটে না। মানুষের মাঝে হানাহানি, প্রতারণা এবং দুর্নীতির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের সামাজিক অবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে কলুষিত করা হয়েছে। সমাজব্যবস্থা এখন দুর্নীতি আর অনাচারের কবলে পতিত হয়েছে, যার পরিণতি এখন আমরা ভোগ করছি। ভবিষ্যতেও অনেক দিন আমাদের স্বৈরাচারের কুফল ভোগ করতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উন্নয়নের জন্য মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো। আর এটি সম্ভব একমাত্র উপযুক্ত জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে নৈতিক শিক্ষা বিস্তার শুরু করতে হবে। সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা, যেখানে সমাজের প্রতিটি মানুষ তার ন্যায়সংগত অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে। এভাবেই একটি সুখী-সমৃদ্ধিশালী সমাজ বিনির্মাণে আমরা এগিয়ে যেতে পারি।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd