ইংরেজি অভিধানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ আছে। প্রথমটি হলো, কনটেক্সট। আর দ্বিতীয়টি হলো, কনজেকসচার। পৃথিবীর কোনো ঘটনা তার প্রেক্ষিত বা কনটেক্সট ছাড়া অনুধাবন করা যায় না, আর করার চেষ্টাও অবৈজ্ঞানিক।
দিল্লির চিঠি
মোদির রাশিয়া সফর ও ‘ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট’
- জয়ন্ত ঘোষাল

এর আগের সপ্তাহে আলোচনা করেছিলাম শেখ হাসিনার চীন সফরকে ভারত কিভাবে দেখছে, সে বিষয়ে। এবার আলোচনা করছি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাম্প্রতিক আলিঙ্গনের ভাইরাল হয়ে যাওয়া চিত্র নিয়ে। এই রাশিয়া সফরের তাৎপর্য কী? আমেরিকা, চীন—কে, কিভাবে এই সফরকে দেখছে? আবার ভারত কেন আংকেল স্যামের ভ্রুকুটি সত্ত্বেও রুশ সফর বাতিল করছে না? সেটাও আমেরিকাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে ভারত। এই হলো ভারতের সাবেক জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি।
আসুন, আমরা মোদির রুশ সফরের রহস্য উন্মোচিত করি।
ছোটবেলায় সার্কাসে দেখতাম, একটি সুদীর্ঘ দড়ির ওপর সাইকেলে চেপে হাতে লম্বা লোহার রড নিয়ে চলেছে দুজন। আবার তাদের দুজনের ওপর এক পাটাতনে চেয়ার রেখে উপবিষ্ট তৃতীয় খেলোয়াড়। তার হাতেও একটি লাঠি। আনুভূমিকভাবে লাঠিগুলো রেখে তিনজনেই চলেছে দড়ির ওপর দিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এখন ঠিক এই কঠিন কাজটাই করতে হচ্ছে। হ্যাটট্রিক করার পর নরেন্দ্র মোদির বিদেশনীতির নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে। পাঁচ বছর পর তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করলেন। হাজারো ক্যামেরার সামনে পুতিন-মোদি আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন। মনে রাখতে হবে, গত মাসেই পুতিন উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে সে দেশের সর্বশক্তিমান প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে জড়িয়ে ধরেন। সে আলিঙ্গন দেখে বেইজিং খুশিতে ডগমগ ছিল। এবার মোদি-পুতিনের আলিঙ্গন দৃশ্য দেখে বেইজিং উদ্বাহু নৃত্য করছে না। তবে বেইজিংয়ের চেয়েও বেশি ভ্রু কুঞ্চিত আমেরিকার। বাইডেনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বললেন, ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্ব নিয়ে দিল্লির কাছে আমরা নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। রাশিয়ায় গিয়ে মোদি কী বক্তব্য রাখছেন, সেদিকে আমরা নজর রেখেছি।
ভারত-ইউক্রেন সম্পর্ক
নরেন্দ্র মোদি রাশিয়া যাওয়ার আগে অবশ্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও একপ্রস্ত বৈঠক সারেন। এবার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণের কিছুদিন পরেই মোদি ‘জি৭’ বৈঠক করতে গেলেন ইতালিতে। জি৭ ক্লাবে রাশিয়া নেই। আগে এটি ছিল জি৮। রাশিয়া এই ক্লাব থেকে বহিষ্কৃত হয় ২০১৪ সালে। ১৯৯৭ সালে তারা এই রাজনৈতিক ফোরামে যুক্ত হয়। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের পর রাশিয়ার সদস্য পদ অনির্দিষ্টকালের জন্য খারিজ করে দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে রাশিয়া যুক্ত হওয়ার পর সেটি জি৭ থেকে জি৮ হয়, রাশিয়ার বহিষ্কারের পর জি৮ আবার জি৭ হয়ে যায়। রাশিয়ার অনুপস্থিতিতে ইতালিতে জি৭ বৈঠকে আলোচনা হলো ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে। ইউক্রেনকেও সেখানে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়। আবার ভারত জি৭-এ সদস্য না হলেও বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে মোদি গেলেন। ফোরামের বৈঠকের পাশাপাশি তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গেও বৈঠক করলেন। মোদি-জেলেনস্কির আলিঙ্গনের ছবি ইতালি থেকে বহুল প্রচারিত হলো।
এরপর কূটনীতির ভারসাম্য রক্ষা করতে মোদি হাজির হলেন মস্কোয়। পুতিন-মোদি আলিঙ্গনে উষ্মায় ফেটে পড়লেন জেলেনস্কি। জেলেনস্কির মন্তব্য, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নেতা একজন খুনি ও অপরাধী নেতাকে আলিঙ্গন করছেন! বেশ কঠোর বিবৃতি সন্দেহ নেই।
মোদি-পুতিন নরম-গরম
মোদির এই মস্কো সফর অত্যন্ত জরুরি ছিল পুতিনের কাছে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পরও এ বিশ্বে পুতিন যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি, সেটার প্রমাণ দেওয়া ছিল বিশেষ জরুরি। তাই ইলেকট্রিক গাড়িতে পুতিন নিজেই মোদি ও আরো দুজন প্রতিনিধিকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর বাসভবনে। এই ছবি সেদিনই ‘ভাইরাল’ হয়ে গেল দুনিয়ায়। রাশিয়া পৃথিবীকে দেখাল, ন্যাটো যতই বৈঠক ডাকুক, বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত আসলে আমাদের পাশে।
এ তো গেল পুতিনের প্রেক্ষিত! কিন্তু ভারত? মোদি কেন মস্কো গেলেন? ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রেম তো এখন ইতিহাস; নেহরু থেকে ইন্দিরা—‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ পর্বের ইতিহাস। তবে সত্যি কথা বলতে কি, এখনো কিন্তু রাজ কাপুরের ‘সির পে লাল টোপি’ গানের স্মৃতি অমলিন।
রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বিচার করলে ভারতের প্রয়োজন সস্তায় রুশ যুদ্ধাস্ত্র। আর দরকার তেল। আর তাই যতই আমেরিকার চাপ থাকুক, ভারত এই ভারসাম্য রক্ষার সার্কাসে যে সফল, তা-ই প্রমাণ করছে। এদিকে রাশিয়ায় গিয়ে মোদি আবার প্রকাশ্যে যুদ্ধবিরোধী বক্তব্যও রেখেছেন।
২০২১ সালে দিল্লিতে মোদি-পুতিন বৈঠক হয়। এর পরই ২০২২ সালে শুরু হয়ে যায় ইউক্রেন যুদ্ধ। আমেরিকা ও ইউরোপ ভারতকে প্রকাশ্য রাশিয়াবিরোধী অবস্থান নিতে চাপ দেয়। ন্যাটোর শক্তি ইউক্রেনের পাশে। ২০০০ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ি রাশিয়ার সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ স্বাক্ষর করেন। ২০২৪ সালের ৮-৯ জুলাই মস্কো সফরে ভারতের হয়ে মোদিও সেই ট্র্যাডিশন বজায় রাখলেন। কাজটা মোটেই সহজ নয়। আবার মস্কো গিয়ে মোদি পুতিনকে একান্তে যা বলেছেন, তা প্রকাশ্যেও বলেন— নিরপরাধ শিশুর মৃত্যু হৃদয়বিদারক। তাই যুদ্ধের ময়দানে কোনো সংকটের সমাধান খোঁজা যায় না। মস্কোয় নৈশ ভোজের পর তিনি আরো বলেন, শান্তি ফেরানো প্রসঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বক্তব্য শুনে তিনি আশাবাদী। তাঁর সাধু উদ্যোগে ভারত সব রকম সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।
রাশিয়া শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির পথে যাবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে মোদি পুরনো জোটনিরপেক্ষতার স্মৃতি উসকে দিয়েও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাতে আমেরিকা ও ইউরোপের তো খুশিই হওয়া উচিত।
‘আংকল স্যাম’ কী চাইছে
মোদি মস্কো গেলেন আর ১০ জুলাই বুধবার ন্যাটোর ‘ওয়াশিংটন সামিট’ হয়ে গেল। সেই সম্মেলনে ইউক্রেনকে আরো সহযোগিতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরো অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভারের প্রস্তুতি। যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে ন্যাটো কেন ভাবতে যাবে? ভারত ন্যাটোর সদস্য হয়নি, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদেরও কোনো প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু মোদি আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক অপরিবর্তিত রাখতে চান। আমেরিকায় এখন ভোটের রাজনীতি সরগরম। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রার্থী হবেন, নাকি অন্য কেউ? নাকি বারাক ওবামার স্ত্রী মিশেল? ট্রাম্পের পক্ষেই এখন হাওয়া— বলছে নানা নির্বাচনী সমীক্ষা। আর তাই মোদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কেও কিঞ্চিৎ ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে এগোচ্ছেন। আবার চীনের সাম্প্রতিক আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণবাদী নীতির মোকাবেলায় ভারতের প্রয়োজন আমেরিকাকে। আমেরিকা-চীনের দ্বৈরথে ভারত-মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক সহযোগিতা খুবই প্রাসঙ্গিক।
ভারত-চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
‘এসসিও’র ২৪তম বার্ষিক সম্মেলনটি হয়ে গেল কাজাখস্তানে, ৩ ও ৪ জুলাই। ‘এসসিও’ অর্থাৎ, ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’। চীন হলো এই সংস্থার বড় দাদা। রাশিয়া, চীন ছাড়া এই সংগঠনের রাষ্ট্রপ্রধানদেরই আসার কথা। চীন, রাশিয়া এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সেই সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও নরেন্দ্র মোদি কিন্তু গেলেন না। পাঠালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করকে। এটি বহুপক্ষীয় মঞ্চ, দ্বিপক্ষীয় নয়। পাকিস্তান অনেক দিন থেকেই আশা করে বসে, সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে একবার কথা বলবেন। এই মঞ্চে যেহেতু চীনের আধিপত্য, তাই আমেরিকা এ সংস্থাকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দিতে নারাজ। জি২০ সম্মেলনের আগে দিল্লিতে এসসিও বৈঠকে হোতা ছিল ভারত। সেবারও মোদি জি২০ সম্মেলনকে গুরুত্ব দিলেও এসসিও বৈঠকটি সারেন ভার্চুয়াল মাধ্যমে। আসলে মোদি চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ধীরে ধীরে শান্তিপ্রক্রিয়ায় যেতে আগ্রহী। এ নিয়ে তিনি এখনো তাড়াহুড়া করতে চাইছেন না।
চীনা ড্রাগন
এবার ভোটের আগেই মোদি বিদেশি এক সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ভারত চীনের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। আসলে আমেরিকার ভৌগোলিক দূরত্ব ভারত থেকে অনেকটা। কিন্তু চীন ভারতের প্রতিবেশী। তাই আমেরিকা চীনের সঙ্গে যতই সংঘাতের হুমকি দিক, আসলে ভারত মনে করে চীনের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনার রাস্তাতেই যেতে হবে। চীন যতই আক্রমণাত্মক কৌশল নিক, চীনেও আর্থিক মূল্যবৃদ্ধি-মুদ্রাস্ফীতি তীব্র। এ অবস্থায় দুই দেশের মধ্যে আলোচনাই একমাত্র পথ, যুদ্ধ কখনোই নয়। চীন, পাকিস্তান ও রাশিয়া একটি অক্ষ তৈরি করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারত বন্ধুত্ব রক্ষা করে চীনা ড্রাগনের শ্বাসকেও প্রতিহত করছে।
পাকিস্তানের অবস্থা শোচনীয়। তবে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তানে ফেরার পর বর্তমান শরিফ সরকারের সঙ্গেও ধীরে ধীরে আলাপ-আলোচনার আবহ তৈরি হচ্ছে। দুই দেশের হাইকমিশন অফিস আবার চালু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে আবার তাঁর পূর্বতন পদে মনোনীত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে অজিত ডোভাল ‘ট্র্যাক-টু’ কূটনীতি নিয়ে সক্রিয়।
ভারতের অভিন্ন বিদেশনীতি
তাই আবারও বলছি, নরেন্দ্র মোদির কাজটা সহজ নয়। তবু দক্ষতার সঙ্গে তিনি ভারসাম্যের কূটনীতি করছেন। মোদি মস্কো গিয়ে নিজেই বলেছেন, মাথায় লাল টুপি রুশি হলেও ‘দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’। ভারতের সর্বভৌম স্বার্থ নিয়েই মোদি এগোচ্ছেন।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় একদা আমাকে বলেছিলেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা দলের যতই ঝগড়া হোক, পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত দেশের সার্বিক হিতের কথা মাথায় রেখে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে এক অভিন্ন নীতি।
মোদির এই প্রয়াস তাই প্রশংসনীয়। এই পররাষ্ট্রনীতিকে বিজেপি-তৃণমূল, কংগ্রেস-সিপিএমের প্রিজমে নয়, দেশের স্বার্থের নিরিখে দেখা প্রয়োজন।
লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd