<p>দেশের ডলার সংকট যেন কাটছেই না, অথচ বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই সংকট উতরে যাওয়া সম্ভব। বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স টার্গেট করে এগোতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। যে দেশের এক কোটির বেশি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>সে দেশের ডলার সংকট হবে কেন<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">? </span>একটি সহজ হিসাব থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। যদি এক কোটি প্রবাসী প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজার ডলার করে দেশে প্রেরণ করে, তাহলে বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসার কথা। আরো একটি তথ্য হচ্ছে, যদি ৫০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে গড়ে ২৫ হাজার ডলার মূল্যের বিশেষ ধরনের প্রবাসী ডলার বন্ড বিক্রি করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের ১২৫ বিলিয়ন ডলারের একটি নিজস্ব ডলার ফান্ড তৈরি হবে। এ কথা ঠিক যে এই ১২৫ বিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করতে প্রায় তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারলে এক বছরে অন্তত ২৫ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব। ডলার সংগ্রহের এই দুটি অপার সম্ভাবনাকে আমরা মোটেই কাজে লাগাতে পারিনি এবং কাজে লাগানোর মতো কার্যকর কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করতে দেখিনি। স্বাভাবিকভাবে এই বিশাল অঙ্কের রেমিট্যান্স এমনিতেই দেশে আসবে না। সাধারণভাবে বছরে যে ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে, সংখ্যাটি সেখানেই থাকবে। যদি প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ কাজে লাগাতে হয়, তাহলে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ, বিশেষ করে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।</p> <p>প্রবাসে যত বাংলাদেশি বসবাস করেন, তাঁদের মোটাদাগে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা প্রয়োজন। একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্য<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আছে শুধু কাজ করার উদ্দেশ্যে। আরেকটি অংশ স্থায়ীভাবে বসবাস করে যুক্তরাষ্ট্র<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>কানাডা, ইউরোপসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে। এই দুই শ্রেণির প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপার্জনক্ষমতা, জীবনযাত্রা প্রণালী এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের ধরন, পরিমাণ এবং উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনায় নিয়ে দুই শ্রেণির প্রবাসীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রেরণের মাধ্যম তৈরি করতে না পারলে দেশে তাঁদের রেমিট্যান্স পাঠানোর সক্ষমতার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। উন্নত বিশ্বে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাধারণত দেশে নিয়মিত রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন না এবং তার প্রয়োজনও হয় না। কেননা তাঁরা গাড়ি-বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ফলে যা উপার্জন করেন তার পুরোটাই খরচ হয়ে যায়। বরং তাঁদের বেশির ভাগের থাকে অনেক ব্যক্তিগত ঋণ বা ক্রেডিট কার্ডের ঋণ। ফলে তারা নিয়মিত ডলার দেশে পাঠাবে কোথা থেকে। বৃদ্ধ মা-বাবা বা আত্মীয়<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">-</span>স্বজনের <img alt="ডলার সংকট মোকাবেলায় রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে হবে" height="335" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/25-06-2024/4.jpg" style="float:left" width="324" />জন্য কিছু অর্থ পাঠায়, কিন্তু তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। পক্ষান্তরে এসব দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অল্প সুদে বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহের সুযোগ আছে, যা তাঁরা ভালো বিনিয়োগের সুযোগ পেলে দেশে পাঠাতে পারেন। বছর দুয়েক আগে যখন সুদের হার কম ছিল, তখন এই সুযোগ অনেক বেশি ছিল। আশা করা যায়, আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে সুদের হার কমতে শুরু করবে এবং সেই অল্প সুদের হার কাজে লাগানোর প্রস্তুতি এখন থেকে নেওয়া প্রয়োজন। </p> <p>এই বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে দেশে প্রবাসীদের বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত প্রডাক্ট তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের শেয়ারবাজার একটি ভালো বিনিয়োগের স্থান হতে পারে, যদিও দেশের শেয়ারবাজার কয়েক বছর ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এই বাজারকে প্রথমে কার্যকর বা বিনিয়োগবান্ধব করতে হবে। প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ডলার ফান্ড তৈরি করে সেই ফান্ডের ইউনিট প্রবাসীদের মাঝে বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে একান্তই প্রবাসীদের জন্য সর্বনিম্ন ঝুঁকির ফান্ড<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>মধ্যম ঝুঁকির ফান্ড এবং অধিক ঝুঁকির বিনিয়োগ ফান্ড গঠন করা সম্ভব। আর এই ফান্ড গঠন এবং ম্যানেজ করার দায়িত্ব দিতে হবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। যেসব ব্যাংক এখনো ভালো অবস্থায় আছে, তাদের এই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এখানেও সেই সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট এবং পর্যাপ্ত বন্ডের বিষয়টি চলে আসে। কেননা এই সুযোগ ছাড়া স্বল্প ঝুঁকির এবং মধ্যম ঝুঁকির ফান্ড গঠনের সুযোগ নেই। সরকার প্রতিবছর যেভাবে বিশাল ঘাটতি বাজেট দিয়ে থাকে<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>যেভাবে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য একের পর এক মেগাপ্রকল্প গৃহীত হচ্ছে এবং আগামী এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে দেশে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট স্থাপন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সরকার যদি ব্যাংকঋণের পরিবর্তে বন্ড ইস্যু করে ঘাটতি মেটানো বা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে, তাহলে বন্ড মার্কেটে পর্যাপ্ত বন্ড থাকবে, যা বিভিন্ন মাত্রার ঝুঁকির তহবিল গঠনে সহায়ক হবে।</p> <p>উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বড় অঙ্কের অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে প্রেরণের কাজটি সহজ করতে হলে প্রতিটি দেশের এক বা একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে করেসপনডেন্ট রিলেশনশিপ স্থাপন করতে হবে এবং সেই সঙ্গে ডলার হিসাব<i style="font-size: 18.6667px;"> (</i>Nostro Account)<span style="font-size: 18.6667px;"><i>  </i></span>রাখতে হবে। এই ব্যবস্থা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ডলার দেশে নেওয়ার উদ্যোগ সফল হবে না। কারণ এসব দেশের মুদ্রানীতি বা মনিটারি পলিসির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে বড় অঙ্কের ডলার যেন দেশের বাইরে না যায়। কাগজে-কলমে মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বললেও বাস্তব অবস্থা একেবারেই ভিন্ন। এসব দেশের পলিসি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকলে এসব সূক্ষ্ম বিষয় সাধারণভাবে বোঝার উপায় নেই। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যেতে পারে। কানাডায় বসবাসরত একজন বাংলাদেশি যদি দেশে এক লাখ ডলার প্রেরণের জন্য কানাডার কোনো ব্যাংকে যান এবং বাংলাদেশের যে ব্যাংকে টাকা পাঠাবেন<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>সেই ব্যাংকের ডলার হিসাব যদি মধ্যপ্রাচ্য<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>এশিয়া বা এমনকি ইউরোপের কোনো ব্যাংকে থাকে, তখন কানাডার সেই ব্যাংক এমন কাগজপত্র দাবি করে বসবে, তাতে দেশে অর্থ প্রেরণ তো দূরের কথা<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>সেই ব্যাংকের ধারেকাছেও কেউ যেতে চাইবে না। কেননা এই রেমিট্যান্স প্রেরণ করলে ডলার কানাডার বাইরে চলে যাবে<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>সেটি যাতে না হয়<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>সে জন্য সব রকম পদক্ষেপ নিতে কার্পণ্য করবে না। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ব্যাংকের ডলার হিসাব যদি কানাডার কোনো ব্যাংকের সঙ্গে থাকে, তখন রেমিট্যান্স প্রেরণ করলেও ডলার মূলত কানাডার মধ্যেই থাকবে এবং সে ক্ষেত্রে সেই ব্যাংক খুব বেশি কাগজপত্র দাবি করবে না। ফলে বড় অঙ্কের অর্থ প্রেরণের কাজটি বেশ সহজ হয়ে যায়।</p> <p>মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে যে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মরত আছেন, তাঁদের উপার্জনের পুরোটাই দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে নেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে গতানুগতিক রেমিট্যান্সের পরিবর্তে বিশেষ ডলার বন্ড ইস্যু করে তাঁদের উপার্জন আগাম সংগ্রহ করে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি কিভাবে সম্ভব, তা আগের অনেক লেখায় বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। মোটকথা<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>দেশে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গুরুত্ব অপরিসীম এবং এর সুযোগও পর্যাপ্ত আছে। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য স্ব<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">-</span>উদ্যোগী হয়ে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে মাত্র। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে যেসব ব্যাংকারের ভালো ধারণা ও অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে এগোতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। ডলারের ওপর নির্ভরশীল দেশের জন্য আগামী বছরগুলো মোটেও সুবিধার হবে না। কথাগুলো আমার নয়<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt">, </span>এটি আইএমএফের প্রতিবেদনের ভাষ্য। তাই সময় থাকতে ভালো অঙ্কের ডলার ফান্ড সংগ্রহ করে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে এবং সে জন্য যা করা প্রয়োজন, তা-ই করতে হবে।</p> <p>লেখক<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt"> : </span>সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</p> <p><a href="mailto:nironjankumar_roy@yahoo.com">nironjankumar_roy@yahoo.com</a></p>