<p>চলতি বছরসহ বিগত আট অর্থবছরে অব্যাহতভাবে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশ পিছিয়ে পড়লেও বছর বছর রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে শতকরা ১৭ থেকে ২০ ভাগ। যথেষ্ট উচ্চ প্রবৃদ্ধি (৪০ শতাংশের বেশি) প্রাক্কলন করেই জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হচ্ছে। বাস্তবায়নের অবস্থা বিবেচনায় বছরের মাঝপথে গিয়ে হয়তো উন্নয়ন বাজেট বা এডিপি বড় কাটছাঁটের শিকার হবে। অনুন্নয়ন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাত, বিশেষ করে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণসহ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হিস্যা হ্রাস পেতে পারে। ব্যাংকঋণসহ নানা সংস্কারের শর্তসংবলিত দাতা সংস্থার বাজেট সাপোর্ট ফান্ডের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। কর রাজস্ব জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত রাজস্ব আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের যৌক্তিকতা থেকেই যাবে। আসল কথা হলো, করের হার না বাড়িয়ে করজালের সম্প্রসারণ ঘটিয়েই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যত্নবান হতে হবে।</p> <p>বাস্তবতা উপলব্ধি করে সব পক্ষকেই এভাবে ভাবতে হবে যে বাঞ্ছিত পরিমাণ রাজস্ব বা অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষম করে সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিত করতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়নবৈষম্য দূর করার জন্যও জরুরি। দেশকে স্বয়ম্ভরের গৌরবে গড়তে এবং পরনির্ভরতা থেকে বের করে আনতে কর রাজস্ব অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তরফে সরকারের সামষ্টিক আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে উন্মোচিত আত্মবিশ্বাসের, সহযোগিতার মনোভঙ্গি। পদ্ধতি সহজ করা করদাতার আস্থা অর্জনের অন্যতম উপায়। গতানুগতিক কর্মধারায় নয়, নীতিনির্ধারক, বাস্তবায়নকারী ও নাগরিক-নির্বিশেষে সবাইকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণে সক্রিয় ও সচেষ্ট হতে হবে। আগামী নতুন জাতীয় বাজেটে সে মর্মে দিকনির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনার পথনকশা প্রত্যাশিত থেকেই যাবে।</p> <p><img alt="কর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা" height="712" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/05-06-2024/1.jpg" style="float:left" width="500" />২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বৃত্তাবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণে সাফল্য অর্জিত হয়। এর পরবর্তী পাঁচ বছরে পেছনে তাকাতে হয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। পরবর্তী পাঁচ অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পায়। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পেছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকায় ছিল। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাস্তবায়িত এডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। ২০২০-২১-এ তা ২০৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত অর্থবছরগুলোতে এডিপির বাস্তবায়ন পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক হারে অধিক পরিমাণে রাজস্ব অর্জিত হয়নি। বিষয়টি বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। দেখা গেছে, আগের পাঁচ অর্থবছরে কম্পানি ও কম্পানি ব্যতীত করের অনুপাত ৫৯ঃ৪১ থেকে ৫৫ঃ৪৫-এর মধ্যে ওঠানামা করলেও পরবর্তী দু-তিন অর্থবছরে এই অগ্রগতি অনুপাত পরিলক্ষিত হয়নি। রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২৫ থেকে ৩৩-এর মধ্যে ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এখনো আয়কর কর রাজস্ব প্রাপ্তির পরিবারে অন্যতম শরিক হওয়ার পথে। অর্থনীতির আকার, অবয়ব, চেহারা ও চরিত্র অনুযায়ী আমদানি শুল্ক (আশু) ও মূল্য সংযোজন করকে (মূসক) টপকিয়ে আয়করের অবস্থান অনেক ওপরে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কি? সার্বিক রাজস্ব আয়ে অধিক পরিমাণে মূসক হিস্যা এখনো শতকরা ৩৫ আর আশু ৩৩ ভাগ। সামষ্টিক অর্থনীতিতে আয়করের অবদানকে অগ্রগামী গণ্য হতে হলে আরো জোরে চালাতে হবে পা, হতে হবে আরো গতিশীল, চাই অধিকতর সমন্বিত উদ্যোগ।</p> <p>দেখা যাচ্ছে, আয়কর আয়ের প্রবৃদ্ধির মাত্রা এখনো ধীর, মিশ্র ও নৈরাশ্যজনক, অথচ অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ী এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করের মুখ্য ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্রমেই কম্পানি ও কম্পানি ব্যতীত কর আয়ের অনুপাত ৭০ঃ৩০ থেকে ৫৮ঃ৪২-এ পৌঁছেছে। দেশে করপোরেট ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও কম্পানি প্রদত্ত আয়করের প্রবৃদ্ধি সেভাবে বা সে হারে বাড়েনি বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে কম্পানি ব্যতীত করদাতার মধ্যে ব্যক্তি করদাতা, পার্টনারশিপ ফার্ম, অ্যাসোসিয়েশন অব পারসন, আর্টিফিশিয়াল জুরিসডিক্যাল পারসন রয়েছেন—তাঁদের করনেটের আওতায় আনার উদ্যোগ আরো জোরদার করার অবকাশ রয়েছে। ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা (টিআইএনধারীর হিসাব অনুযায়ী) নিকট অতীতেও যথাযথভাবে শুমার ও সংরক্ষণ করা না হলেও যখন থেকে এসবের অগ্রগতির পরিসংখ্যান পর্যালোচিত হচ্ছে, তখন থেকে অগ্রগতির ধারা বেগবান করার প্রয়াস চলছে। যাঁরা আয়কর নথি খুলেছেন, তাঁদের শতকরা মাত্র ২৫ থেকে ৩০ ভাগ করদাতা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, বাকিদের উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসরণের উদ্যোগ জোরদার করার আবশ্যকতা রয়েছে। আয়কর বিভাগের লোকবল বাড়ানো ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যমান লোকবল ও কাঠামোকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর প্রশাসন-ব্যবস্থাপনা-প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ধার্য ও আদায়কৃত আয়কর যথাসময়ে এবং প্রকৃত পরিমাণে কোষাগারে আসার ব্যাপারে নজরদারি ও পরিবীক্ষণ যেমন জরুরি, তেমনি করারোপ, হিসাবায়ন ও জমাদান পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব করদাতাবান্ধব বা সহজ বা অনলাইন করা যাবে, তত দূরত্ব কমবে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে। আর এভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলে করনেটের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকবে। দেশের কর জিডিপি রেশিও উপযুক্ত পর্যায়ে উন্নীত করার ক্ষেত্রে এ কথা অনস্বীকার্য যে সার্বিক রাজস্ব আয়ের পরিবারে প্রত্যক্ষ করকেই মোড়লের ভূমিকায় আসার যথেষ্ট অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে।  </p> <p>বোঝা যাচ্ছে না করদাতা সত্যি বাড়ছে কি না। সার্বিকভাবে উৎস কর ও কম্পানির করের ওপরই আয়কর নির্ভর হয়ে পড়েছে। এটি বাড়ছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। দেখতে হবে করের প্রকৃত পরিধি বাড়ছে কি না, করদাতার সংখ্যা বাড়ছে কি না এবং সেই হারে করের পরিমাণ বাড়ছে কি না। আবার এর সঙ্গে ঢালাও রেয়াত ও অব্যাহতি প্রদানসহ কর ফাঁকি রোধ বা সীমিত করতে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কপোরেট করও যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরা সবাই সঠিক পরিমাণে দিচ্ছেন কি না, সেটিও দেখার বিষয় রয়েছে। কারণ প্রায়ই প্রতিবেদনে দেখা যায়, অমুক প্রতিষ্ঠান বা কাম্পানির এত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি। অমুক ঠিকাদার, নির্বাচন প্রার্থী অঢেল সম্পদের মালিক, তমুক ক্যাসিনোওয়ালার ঘরে এন্তার টাকার পাহাড়। এটি তো ছেলেখেলার বিষয় নয়। এখানে কর আহরণকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ সেখানে কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ের, প্রয়াস, দক্ষতা, সততা ও দায়িত্বশীলতার ঘাটতির প্রতি ইঙ্গিত আসতে পারে।</p> <p>কয়েক বছরে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনবিআরের বেশ কিছু সংস্কার ও জনবল ও কাঠামোতে ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে ভেবে দেখতে হবে, যে হারে সংস্কার ও সম্প্রসারণ হযেছে, সে হারে কর বা করদাতা বাড়ছে কি না কিংবা যাঁরা যুক্ত হচ্ছেন, তাঁরা পরে থাকতে পারছেন কি না? বিদ্যমান করব্যবস্থায় কিছু সীমাবদ্ধতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে কর বিভাগের অপারগ পরিস্থিতির কারণে করদাতারা যেন হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। করের বেজ বাড়ানোর জন্য এটি জরুরি।</p> <p>মোট কর রাজস্বে আমদানি শুল্কের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৪২ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩০ শতাংশের পর্যায়ে এবং ২০১৯-২০-এ ২৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কখনো ২৭ শতাংশ, কখনো মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ বড় এলোমেলো এবং অপরিকল্পিত পরিস্থিতি নির্দেশ করে। ডাব্লিউটিওর অনুশাসন মেনে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় যে পরিবর্তন আসছে, তাতে ক্রমান্বয়ে আমদানি শুল্ক হ্রাস পেতে থাকবে—এমন একটা ধারণা বা যুক্তি বিদ্যমান থাকলেও ক্রমান্বয়ে উচ্চ শুল্কায়নযোগ্য সামগ্রীর আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে শুল্ক আয় সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধির কার্যকরণ সম্পর্কটিও পরীক্ষা ও পর্যালোচনার অবকাশ থেকে যাচ্ছে। মূল্য ওঠানামার সঙ্গে ট্যারিফ স্ট্র্যাকচারের সমন্বয় সাধন, ভ্যালুয়েশনসহ শুল্কায়নে অধিকতর একাগ্রতা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও প্রকৃষ্ট প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য থেকে যায়। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর আয়ের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৩৩ শতাংশ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৯ শতাংশে এবং ২০১৯-২০-এ ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আয়কর আয়ের সামঞ্জস্যহীন পরিস্থিতি নির্দেশ করে। মূসক আয়ের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির মিশ্র হারও মূসক আয়ের টেকসই ও ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা পূরণ করে না। এ সময়ের (২০০৬-২০) গড় প্রবৃদ্ধি আমদানি (২২ শতাংশ), জিডিপি (৫ থেকে ৭ শতাংশ) ও মূল্যস্ফীতির (৭ থেকে ৯ শতাংশ) হিসাব এবং স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় আনলে স্থানীয় পর্যায়ে পরোক্ষ কর থেকে আয়ের প্রবৃদ্ধি ন্যূনতম ২৫ শতাংশের বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত প্রতীয়মান হয়। মোট কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২০০৭-০৮-এর ২৫ শতাংশ থেকে ২০১৬-১৭-তে ৩৪ শতাংশ এবং ২০১৯-২০-এ ৩৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী সময়গুলোর তুলনায় বেশ সন্তোষজনক অগ্রগতি, এ ধারা আরো বেগবান হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তবে আয়করের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২৭ শতাংশ, ১১ শতাংশ, ১৮ শতাংশ, ২৮ শতাংশ এবং ১৯ শতাংশ অর্থাৎ সুস্থিরভাবে ঊর্ধ্বগামী হতে পারেনি। আয়কর দাতার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। তা বাড়ানোর উদ্যোগ থাকতে হবে। এন্তার কর রেয়াত পরিহার, দুর্নীতিজাত কালো টাকাকে বিনা জরিমানায়, স্বল্প কর হারে ও বিনা ব্যাখ্যায় সাদা করার অবারিত সুযোগ প্রত্যাহার করে দক্ষ ও দায়িত্বশীল লোকবল নিশ্চিত করে সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা দূর করতে পারলে মোট রাজস্ব আয়ের হিস্যা বাড়ানো সহজ হবে। কর জিডিপি রেশিও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাগ্রে তাই প্রয়োজন সবার সমন্বিত প্রয়াস।</p> <p> </p> <p> লেখক : সাবেক সচিব ও সাবেক</p> <p>চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড</p> <p> </p> <p> </p>